রেমিট্যান্স প্রবাহ

সৌদি আরবসহ প্রধান সব শ্রমবাজারে বিপর্যয় ব্যতিক্রম কেবল আমিরাত

হাছান আদনান

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের প্রধান সব শ্রমবাজার থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেবল সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) ইউএই থেকে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ৩২৭ কোটি ৭ লাখ ডলার। একই সময়ে প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে কেবল ১৯৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার এসেছে। অর্থাৎ সৌদি আরবের সঙ্গে আমিরাত থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহের ব্যবধান ৬০ শতাংশেরও বেশি। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শীর্ষ রেমিট্যান্সের বাজার হিসেবে ইউএই তার নাম ধরে রেখেছে।

সৌদি আরবের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকেও রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় বিপর্যয় হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশটি থেকে বাংলাদেশে প্রবাসী আয় এসেছে মাত্র ১৯৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। অথচ গত অর্থবছরেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেকর্ড ৩৫২ কোটি ২০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। আগের তিন বছরও প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহ। সেই প্রবাহে বিপর্যয়ের কারণে শীর্ষস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম নেমে গেছে চতুর্থে। সৌদি আরব নেমেছে তৃতীয় স্থানে। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ স্থিতিশীল থাকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যের নাম। সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, সিঙ্গাপুরসহ বড় শ্রমবাজারগুলোর রেমিট্যান্স প্রবাহ এখন বেশ শ্লথ।

প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে আসা প্রবাসী আয়ের বড় বিপর্যয় যেমন শঙ্কা তৈরি করেছে, তেমনি আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্সের বড় উল্লম্ফন নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি আরবের রেমিট্যান্সের বাজার ক্রমেই হুন্ডির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। বৈধ পথে দেশটি থেকে অর্থ পাঠানোও কঠিন হয়ে উঠছে। বিপরীতে আইনকানুন সহজ ও উদার করে দেয়ায় ইউএই এখন বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম শীর্ষ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। বাংলাদেশী বড় ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও দুবাইসহ দেশটির বিভিন্ন শহরে অফিস খুলেছেন। অনেকে দেশ থেকে সম্পদ পাচার করে আমিরাতে বিনিয়োগ করছেন। অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের পাশাপাশি পাচারকৃত অর্থের একটি অংশ এখন রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে ঢুকছে।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. জাফর আলম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমিরাতের দুবাই এখন বিশ্ব বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। দেশটির সরকার আইনকানুন সহজ করার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। বাংলাদেশী বিপুলসংখ্যক শ্রমিকও দেশটিতে কাজ করছেন। আবার বড় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ দেশটিতে অফিস খুলেছেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশীদের জন্য আমিরাত এখন আকর্ষণের জায়গা। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসবের প্রভাব থাকতে পারে।’

জাফর আলম আরো বলেন, ‘প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে উৎসাহিত করতে গত বছর আমি আমিরাত সফর করেছিলাম। সে সময় বেশ কয়েকটি রেমিট্যান্স হাউজের সঙ্গে চুক্তির পাশাপাশি বড় চারটি শহরে বাংলাদেশীদের সমাবেশে বক্তব্য রেখেছি। প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে নিজেদের কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন তখন। আমরা সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছি। এসব তৎপরতার ফলে আরব আমিরাত থেকে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশের তালিকায় তৃতীয় স্থানে ছিল ইউএই। ওই বছর আমিরাত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৪৩ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে ২০৭ কোটি ১৮ লাখ ডলারে নেমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলারে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৩২৭ কোটি ৭ লাখ ডলার। 

অভিবাসী হিসেবে প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমিরাতে গেছেন। তবে তার তুলনায় বহুগুণ বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন সৌদি আরবে। বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত গত দুই দশকে কাজের উদ্দেশ্যে ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৫ বাংলাদেশী শ্রমিক সৌদি অভিবাসী হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১৬ লাখ গেছেন গত তিন বছরে। অথচ দেশটি থেকে এ সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ না বেড়ে উল্টো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ ডলার। এর পর থেকেই প্রবাহ কমছে ধারাবাহিকভাবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এলেও গত অর্থবছরে তা ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারে নেমে আসে। আর চলতি অর্থছরে পরিস্থিতি আরো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সৌদি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৯৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। 

সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশী, এক্সচেঞ্জ হাউজ, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। সব পক্ষই বলছে, সৌদি আরবে রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হলেও তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন বেকার। অনেকে চাকরি পেলেও বেতন-ভাতা প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। জীবনধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে মাস শেষে অনেক বাংলাদেশী শ্রমিকের হাতেই দেশে পাঠানোর মতো উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে না। আবার সৌদি আরবে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের বড় অংশের আয় চলে যাচ্ছে হুন্ডি কারবারিদের হাতে। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় ডলারের দর বেশি পাওয়ায় প্রবাসীরাও হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশী কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সৌদি আরবে বসবাসকারী প্রবাসীদের ঘিরে হুন্ডির এ জমজমাট ব্যবসা গড়ে তুলেছেন বলেও জানা গেছে।

সৌদি আরবের জেদ্দায় একটি ইলেকট্রিক পণ্যের দোকান চালান বাংলাদেশী আবু বকর। প্রবাসীদের দুর্দশার কথা জানিয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পুরো সৌদি আরবের পুরনো শহর ও মার্কেটগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ভেঙে ফেলা জায়গায় সরকার আধুনিক শহর ও মার্কেট বানাতে চায়। এসব এলাকায় অনেক বাংলাদেশী উদ্যোক্তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা দোকান ছিল। এ ব্যবসায়ীরাই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতেন। শত শত পুরনো মার্কেট ভেঙে ফেলা কিংবা বন্ধ করে দেয়ার কারণে বাংলাদেশীদের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে। অন্যদিকে সৌদি সরকার আইন করে বিদেশী শ্রমিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। বাংলাদেশীদের আয় কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব আইনেরও প্রভাব আছে।’

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বৃহৎ অংশই দেশে আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির মাধ্যমে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেকটাই স্বাভাবিক আছে। চেষ্টা করছি আরো বেশি আনতে। সৌদি আরব প্রবাসীদের সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে হয়। আর দেশটির ব্যাংকের রীতিনীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন প্রবাসীদের আয়ের উৎস দেখিয়ে তবেই ব্যাংকে অর্থ জমা করতে হয়।’

তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানান, সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স এখন বড় হুন্ডি কারবারিদের হাতে চলে গেছে। তারা প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। সেই অংকটা বড় করে দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ডলারের মূল্য নিয়ে দরকষাকষি করছেন। দাম বেশি দিলে ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছেন, অন্যথায় হুন্ডিতে বিক্রি করে দিচ্ছেন।

প্রবাসী বাংলাদেশীরা গত বছর মোট ২ হাজার ১৯১ কোটি বা ২১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। আর আগের বছর দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে বিদায়ী বছরে প্রবাসীরা ৬৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বেশি পাঠিয়েছেন। এক্ষেত্রে ২০২৩ সালে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। যদিও গত বছর রেকর্ড ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ বাংলাদেশী জীবিকার সন্ধানে অভিবাসী হয়েছেন। ২০২২ সালে অভিবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩। অর্থাৎ গত দুই বছরে ২৪ লাখের বেশি বাংলাদেশী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গেলেও রেমিট্যান্স সে অনুপাতে বাড়েনি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আরো ২ লাখ ৩৬ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন