কাটা পড়া সাবমেরিন কেবলে যুক্ত ১৬ দেশ, সেবা ব্যাহত শুধু বাংলাদেশে

আরফিন শরিয়ত

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ ‘সি-মি-উই ৫’ সাবমেরিন কেবলে যুক্ত। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া অংশে এ কেবল কাটা পড়ে। কিন্তু এ ঘটনায় ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হচ্ছে শুধু বাংলাদেশেই। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাকি দেশগুলো ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো দু-একটি সাবমেরিন কেবলের ওপর নির্ভরশীল নয়। একাধিক বিকল্প থাকায় যেকোনো দুর্ঘটনায় তাদের ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হয় না। 

‘সি-মি-উই ৫’ দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল। এ সাবমেরিন কেবলের সক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ জিবিপিএস। দেশের প্রথম সাবমেরিন কেবল ‘সি-মি-উই ৪’-এর সক্ষমতা এর অর্ধেক; ৮০০ জিবিপিএস।

বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস পিএলসি (বিএসসিপিএলসি) সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ এপ্রিল ‘সি-মি-উই ৫’ কেবলটি সিঙ্গাপুর থেকে ৪৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে ইন্দোনেশিয়া অংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যায় সিঙ্গাপুর অভিমুখী সব ধরনের ট্রাফিক। এ অবস্থায় দেশের ৯০ শতাংশ ডাটা ট্রাফিক সিঙ্গাপুরভিত্তিক হওয়ায় এবং অধিকাংশ কোম্পানি সিঙ্গাপুরের সার্ভার ব্যবহার করায় ইন্টারনেট সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব দেশ দু-একটি কেবলের ওপর নির্ভরশীল, তাদের এ ধরনের সমস্যায় বেশি পড়তে হয়। কেবলের সংখ্যা বেশি হলে সেগুলো দিয়ে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক রাখা যায়। বাংলাদেশের হাতে পর্যাপ্ত বিকল্প না থাকায় ইন্টারনেট সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। 

বিএসসিপিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা কামাল আহমেদ বলেন, ‘সি-মি-উই ৫’ এখন পুরোপুরি বন্ধ। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যান্ডউইডথ প্রথম সাবমেরিন কেবলে স্থানান্তরের চেষ্টা করছি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসসিপিএলসির এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সার্ভার বেছে নেয়ার বিষয়টি নির্ভর করে আমাদের অপারেটরদের ওপর। তারা সিঙ্গাপুরের সার্ভার বেছে নেয়ায় আমাদের ৯০ শতাংশ ডাটা ট্রাফিক সিঙ্গাপুরকে ঘিরে হয়েছে। মূলত এ কারণেই বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগামীতে বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।’   

বিএসসিপিএলসি বলছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কাজ চলছে। তবে ইন্টারনেট স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে আরো এক মাস লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে মে মাসের শেষ সপ্তাহে ইন্টারনেটের ধীর গতি কাটতে পারে।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সি-মি-উই ৪ ওয়েস্ট সেগমেন্টের এবং সি-মি-উই ৫ ইস্ট সেগমেন্টের। ইস্ট সেগমেন্টে আমাদের প্রায় সব ডাটা সেন্টার সিঙ্গাপুরভিত্তিক। শুধু আমাদের নয়, গুগল, ইউটিউবসহ বৈশ্বিক বড় অংশীদারদের সার্ভার সিঙ্গাপুরেই। এ কারণে আমাদের ডাটা ট্রাফিক সিঙ্গাপুরমুখী। ইন্দোনেশিয়ায় কেবল কাটা পড়ায় সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন অতিরিক্ত ডাটা ভারত হয়ে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। ফলে সার্ভারের সঙ্গে সংযোগে কিছুটা বাড়তি সময় যাচ্ছে।’

টেলিযোগাযোগ খাতের বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেলিজিওগ্রাফির তথ্য অনুযায়ী, ‘সি-মি-উই ৫’-এর সঙ্গে ১৬টি দেশ ১৮টি ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে যুক্ত। ১৬টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, জিবুতি, মিসর, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে কম সাবমেরিন কেবলে যুক্ত।  

টেলিজিওগ্রাফির হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমার চারটি সাবমেরিন কেবলে যুক্ত। ‘সি-মি-উই ৫’ ছাড়াও তাদের রয়েছে ‘সি-মি-উই ৩’ এএই-১ ও ইউএমও। মালয়েশিয়া সাবমেরিন কেবলের ল্যান্ডিং স্টেশন ২৯টি। এসব কেবলের মধ্যে রয়েছে এপিসিএন-২, এএজি, এএই-১, এএলসি ইত্যাদি। সিঙ্গাপুর যুক্ত ৩৮টিতে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাপ্রিকট, এএজি, এসিসি-১, এডিসি, এএলসি, এপিজি ইত্যাদি। ইন্দোনেশিয়া ৬৫টি কেবলের মাধ্যমে সংযুক্ত। শ্রীলংকায় সাবমেরিন কেবলের সংখ্যা নয়টি। এসব কেবলের মধ্যে রয়েছে বিবিজি, ভারত-লংকা কেবল সিস্টেম, ফ্যালকন, ইন্ডিয়া এশিয়া এক্সপ্রেস, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা কেবল ইত্যাদি। 

পাকিস্তানে সাবমেরিন কেবল রয়েছে ১০টি। এসবের মধ্যে রয়েছে পিস কেবল, সি-মি-উই ৩, সি-মি-উই ৪, সি-মি-উই ৫, সি-মি-উই ৬ ইত্যাদি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাবমেরিন কেবলের সংখ্যা ২০টি। এসবের মধ্যে রয়েছে ফ্যালকন, এফওজি, এফইএ, কাতার-ইউএই ইত্যাদি। অন্যান্য দেশের মধ্যে ওমান ১৮টি, জিবুতি ১৩টি, ইয়েমেন ছয়টি, সৌদি আরব ২৩টি, মিসর ২২টি, তুরস্ক সাতটি, ইতালি সাতটি, ফ্রান্স ৩২টি এবং ইন্দোনেশিয়া ৬৫টি সাবমেরিন কেবলে সংযুক্ত রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের চাহিদা ও জোগান সমান। উদ্ধৃত ডাটা আমাদের নেই। এ কারণে আমরা সংকটে পড়ে গেছি। ইন্টারনেট জরুরি সেবা, সবসময় এর বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হয়। কিন্তু আমরা বিকল্পের চিন্তা এত দিন করিনি।’ 

ড. মইনুল বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া অংশে কেবল মেরামতের অনুমতি নিতে এক মাস সময়ের প্রয়োজন। টেকনিক্যাল কাজ করতে এত সময় লাগার কথা নয়। আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি, এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। এটাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। ইন্টারনেটের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জড়িত। শিগগিরই সমস্যা সমাধান না হলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা ক্ষতির মুখে পড়ব।’

মির্জা কামাল আহমেদ বলেন, ‘এত বড় বিপর্যয় আগে হয়নি। আমরা এ অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে কাজে লাগাব। জরুরি সময়ে পর্যাপ্ত ডাটা সরবরাহ কীভাবে স্বাভাবিক রাখা যায়, সে বিষয়ে আমরা চিন্তা করছি। আমাদের কোম্পানির বোর্ড বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছে। সামনের সভায় আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব, নতুন কী কী করা যায়, সে বিষয়েও আমরা সিদ্ধান্তে আসব।’

বিএসসিপিএলসির এ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আমাদের তৃতীয় সাবমেরিন কেবল সিমিইউ-৬ সংযোগের কাজ চলছে। এ সংযোগ চালু হলে ১৩ হাজার ২০০ জিবিপিএস ব‌্যান্ডউইডথ যুক্ত হবে। এটি ২০২৫ সালে চালু হওয়ার কথা। আশা করি পরবর্তী সময়ে এ ধরনের বিপর্যয়ে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন