দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিনে বক্তারা

উন্নয়নের সঙ্গে নৈতিকতার সংযোগ থাকতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডিএসআইসি সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য দেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার চর্চা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ কারণে উন্নয়নের সঙ্গে নৈতিকতার সংযোগ থাকতে হবে। আর উন্নয়ন অধ্যয়নের কারিকুলাম হতে হবে সামগ্রিক। এ ক্ষেত্রে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগগুলোর উচিত হবে সমন্বিত একটা পাঠ্যসূচি তৈরি করা। অন্যদিকে সরকারকে উন্নয়ন ও গবেষণায় আরো বেশি অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। 

রাজধানীতে গতকাল ‘ফার্স্ট ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ঢাকা’ শীর্ষক সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নের পথ অনুসন্ধান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও বণিক বার্তা যৌথভাবে এ সম্মেলন আয়োজন করে। সম্মেলন হয় প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে। 

সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। আমি নিশ্চয়তা দিতে চাই, মানসম্মত ও প্রাসঙ্গিক গবেষণায় অর্থ কোনো সমস্যা নয়।’

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘গত দুই দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের চিহ্ন রেখেছে। শিল্প ও সেবা খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে “‍বাস্কেট কেস’’ থেকে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। যদিও বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে বাংলাদেশকে খাপ খাওয়ানোর জন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বৈচিত্র্য আনতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এরই মধ্যে প্রধান সামাজিক সূচকগুলোয় উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। যেমন দারিদ্র্য হ্রাস, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, পানি ও স্বাস্থ্যে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। যদিও মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়াই আমাদের শেষ লক্ষ্য নয়।’

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘নীতিগবেষণা, সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও পলিসি ডায়ালগের মাধ্যমে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ বাংলাদেশ সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নে অবদান রেখেছে। এ বিভাগ পলিসিভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের সহযোগিতা এবং সময় উপযোগী গবেষণার মাধ্যমে অবদান রাখে। আমরা তাদের বিশেষায়িত জ্ঞানকে যথাযথ ব্যবহার করতে চাই।’

সমাপনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন অধ্যয়নের পাঠ্যসূচি হতে হবে সামগ্রিক। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ একসঙ্গে বসে প্রয়োজনভিত্তিক কারিকুলাম উন্নয়ন করলে এ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। এখানে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের পাশাপাশি উন্নয়নের প্রভাবও দেখতে হবে।’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, ‘উন্নয়নকে একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে প্রবৃদ্ধি ও পরিবর্তনকে সামনে আনতে হয়। প্রবৃদ্ধিকে আমরা অর্থনীতিতে ফেললেও পরিবর্তনকে কোথায় ফেলব? এ পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও প্রযুক্তির মতো বিষয়। এতগুলো বিষয় একত্রে উন্নয়ন অধ্যয়নে এসে মিলিত হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন করলাম, কিন্তু ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় আমাদের সড়ক গলে যাচ্ছে। কতটুকু সড়কে কতটুকু বিটুমিন ব্যবহার করব, তাতে ফাঁকি দেব, আর উন্নয়ন উন্নয়ন বলে চিৎকার করব, তা হবে না। উন্নয়নের সঙ্গে নৈতিকতার জায়গাকে সংযুক্ত করতে হবে। উন্নয়নকে তখনই টেকসই করতে পারব, যখন আমরা শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার চর্চা করতে পারব। এ সমন্বয় করতে পারলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তনয়া যা দৃশ্যমান করেছেন, আমরা তা টেকসই করতে পারব।’ 

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত নানা বৈশ্বিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছি। এ অবস্থায় নীতি প্রণয়ন ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য উন্নত জীবন প্রদান খুবই কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে উন্নয়ন অধ্যয়নের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশককে আমরা আবিষ্কার করেছি। সেগুলো হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন কৌশলগুলোর ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করে নতুন উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন; সমাজবিজ্ঞানের উত্তর আধুনিক যুগের আদর্শিক সমালোচনার উন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের যুগে নতুন ধারণা, আদর্শ ও তত্ত্বের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ। এটি উন্নয়ন খাতে বৈশ্বিকভাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ ডিগ্রি প্রদানকারী বিভাগও। আমরা এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের জন্য গবেষণাপত্র আহ্বান করেছিলাম। সারা পৃথিবী থেকে ১৭০টি একাডেমিক পেপার আমাদের কাছে জমা পড়ে। তার মধ্যে মাত্র ৩১টিকে আমাদের সুযোগ দিতে হয়েছে।’ 

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আরো বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন খাতের পেশাজীবীদের জন্য প্রফেশনাল মাস্টার্স অন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ চালু করেছি। অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, অনেক “‍স্কুল অব থট”-এর সমন্বয়ে উন্নয়ন অধ্যয়নের কারিকুলাম সাজানো হয়েছে। ভিশন ২০৪১ অর্জনে আমাদের গবেষণা ও উন্নয়নে আরো বেশি উন্নয়ন করতে হবে। এর জন্য আমাদের এ খাতে আরো বেশি বিনিয়োগ দরকার।’ 

অনুষ্ঠান শেষে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীদের পোস্টার প্রদর্শনী ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সবশেষে হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পোস্টার প্রদর্শনীতে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রুফাইদা শফিক আনিলা ও তার দল। প্রথম রানারআপ হয় সৈয়দা মালিহা তাসনিম ও তার দল। দ্বিতীয় রানারআপ হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী তারান্নুম তাসনিম তন্দ্রা ও তার দল। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলামের সঞ্চালনায় সমাপনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, ঢাকা স্টক এক্স‌চেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা প‌রিচালক ড. এ‌টিএম তা‌রিকুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক ড. তৈয়েবুর রহমান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন