উত্তাপ কমাতে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

ড. মো. সিরাজুল ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেসের (সিআইআরএস) পরিচালক। বুয়েট থেকে পুরকৌশলে স্নাতক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে স্নাতকোত্তর ও জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি ও তার কার্যকারণ নিয়ে কথা বলেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবরিনা স্বর্ণা

সারা দেশ তাপপ্রবাহে ভুগছে কয়েক সপ্তাহ হলো। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?  

সারা বিশ্বেই জলবায়ুতে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে চলতি মাসে প্রায় ২৫ দিন তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল এবং ১৯৪৮ সাল থেকে এক বছরে টানা বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের দিনের রেকর্ড এটি। অর্থাৎ ৭৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। তবে শুধু যে বাংলাদেশেই এমনটি ঘটছে তা কিন্তু না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ ধরনের খবর পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালের জুন-জুলাই অর্থাৎ গরমকালে দক্ষিণ ইউরোপ, আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল, মেক্সিকো ও চীন এ রকম বড় ধরনের তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছিল। ২০২১ সালের গ্রীষ্মে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহর স্মরণাতীতকালের উষ্ম তাপমাত্রায় আক্রান্ত হয়। ১৯৩৭ সালের পর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয় এখানে। ২০২৩ সালের চীনে তাপপ্রবাহ ছিল ২৫০ বছরের মধ্যে উষ্ণতম।   

কেন এমনটি হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন? 

গ্রিনহাউজ অ্যাফেক্টের ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যে বাড়ছে, এটি আজ সর্বজনস্বীকৃত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। এরই একটি ফলস্বরূপ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল সাম্প্রতিক সময়ে ‘হিট ওয়েভ’ বা তাপপ্রবাহে আক্রান্ত হচ্ছে বলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বিবেচনায় নিলে ১৮৮০ সালের পর থেকে, অর্থাৎ যখন থেকে তাপমাত্রার আধুনিক রেকর্ডকিপিং শুরু হয়, সে বিবেচনায় ২০২৩ সালটি ছিল পৃথিবীর উষ্ণতম বছর। শুধু তা-ই নয়, গত টানা ১০ বছর ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের রেকর্ডে সবচেয়ে উষ্ণতম ১০ বছর। এর বাইরে প্রাকৃতিক ভূমিরূপ পরিবর্তিত হয়ে গ্রামকে শহরে রূপান্তরের মাধ্যমেও তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে, যাকে নগর উষ্ণায়ন বলা হয়।

নগর উষ্ণায়ন বা তাপপ্রবাহ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলবেন কি? 

নগরে এ তাপপ্রবাহ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ছাড়াও হতে পারে। নগর উষ্ণায়ন যা ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ বা ‘নগর তাপ দ্বীপ’ হিসেবে পরিচিত - নগরবিজ্ঞানের আরেকটি বহুল প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, যাতে মূলত স্থানীয় নিয়ামকগুলোই অধিক প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ গ্রাম থেকে আপনি যখন শহরে প্রবেশ করবেন, ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। তাপমাত্রার এ ব্যবধান সর্বোচ্চ ১০-১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্তও হতে পারে। এ তাপমাত্রার ব্যবধান কেন হয় এবং এর থেকে পরিত্রাণ বা এর মাত্রা কীভাবে কমানো যায়—নগরবিজ্ঞানে এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা বর্তমান বিশ্বে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ আজকাল শহরে বাস করে এবং এ প্রবণতা দিন দিন আরো বাড়ছে। শহরগুলো প্রায়ই এ ‘তাপ দ্বীপে’ ভোগে, যা মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়, কর্মক্ষমতা হ্রাস তথা বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারের মতো অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।   

তুলনামূলকভাবে ঢাকা কেন দিন দিন বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে?  

যখন গাছপালা ও জলাধারসমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ভূমি-আবরণবিশিষ্ট একটি অঞ্চলকে শহরে রূপান্তর করা হয়, তখন তাকে ইট-পাথরের আবরণ যথা—ফুটপাত, বিল্ডিং, রাস্তা ইত্যাদি আরো বেশি ঘনত্বের আবরণের দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়, যা অধিক তাপ শোষণ করে এবং ধরে রাখে। এতে সে অঞ্চলটির তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এজন্য নগরবিজ্ঞানে একটি শহরে ন্যূনতম কিছু অংশ প্রাকৃতিক আবরণ তথা সবুজ বনায়ন নিশ্চিত করতে বলা হয়। সে হিসেবে একটি শহরের জন্য কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ সবুজ জায়গা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় এটি আছে মাত্র ৮ শতাংশের মতো। জলাভূমিও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। আপনি যখন সমুদ্রের কাছে যাবেন, দেখবেন মূল ভূমির তুলনায় শীতে গরম আর গরমে ঠাণ্ডা। আবহাওয়া সমভাবাপন্ন রাখতে পানির ভূমিকা আছে। অথচ আমাদের ঢাকার জলাভূমি সব ভরাট। খোলা জায়গা তথা খেলার মাঠ তো নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) বাড়ি নির্মাণে খোলা জায়গা রাখার নিয়ম আছে। এ নিয়ম এ কারণে রাখা হয়েছিল যে এই খোলা অংশটি প্রাকৃতিক আবরণ তথা গাছগাছালিপূর্ণ হবে। খোলা জায়গা দিয়ে মাটিতে পানি প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ধীরে ধীরে ভরাট করবে, এজন্য। কিন্তু বাস্তবে কী দেখলাম—গাড়ির গ্যারেজ, কেয়ারটেকার কিংবা দারোয়ানের থাকার জায়গা করে সেটি পাকা করে ফেলা হচ্ছে। অর্থাৎ এর গুরুত্ব কেউ বুঝছে না। ফলে প্রাকৃতিক ভূমিরূপ আসলে কিছুই রইল না। 

এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?  

সুপরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশের মতো একটি উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে যেখানে বছরের একটি লম্বা সময় ধরে আমাদের গরমকাল থাকে। ফলে চারপাশের পরিবেশ তথা খোলা জায়গা রাখা, গাছপালার পরিমাণ বাড়ানো, জলাশয় সংরক্ষণ এগুলো তো করতেই হবে। বলা হয়ে থাকে, একটি গাছ বছরে ১০টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সমান কাজ করে। পাশাপাশি, বাড়িঘর এমনভাবে তৈরি করা উচিত যাতে তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। ঘরবাড়ির নকশা আর নির্মাণসামগ্রীও সেভাবে ব্যবহার করা উচিত।  

কিন্তু আফসোসের বিষয়, ঢাকায় আমরা উঁচু দালান নির্মাণে এমন কিছু নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করছি যা বাংলাদেশের জলবায়ুতে মোটেই উপযোগী নয়, বরং ইউরোপ-আমেরিকার অনুকরণে। যেমন দেয়ালে কাচের ব্যবহার। কাচের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু বিকিরিত হওয়ার পর তা সে ঘরের ভেতর থেকে বের হতে পারে না। একটি কাচের ঘর এভাবে অধিক উষ্ণ হওয়ায় শীতলায়নের জন্য এসি ব্যবহার করতে গিয়ে বিদ্যুৎ খরচ বেশি হচ্ছে। আর ভেতরের সেই গরম বাতাস যখন বাইরে ছাড়া হচ্ছে, বাইরের তাপমাত্রা আরো বেড়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত নই, আমাদের দেশের স্থপতি-প্রকৌশলীরা কি বিষয়টি অবগত নন?  

শহরে স্থাপনা নির্মাণে কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে?

হ্যাঁ, অনেকটা তাই। বাড়ি ও স্থাপনা নির্মাণে পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু সহনশীল ‘গ্রিন বিল্ডিং’ ধারণাটি এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে, স্থাপনাটিকে পরিবেশবান্ধব ও আরামদায়ক হবে। এতে পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমে হবে, আবর্জনা কম উৎপন্ন করবে, পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হবে, ইত্যাদি। বলা হয় পৃথিবীতে যত বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, তার একটা বড় অংশ খরচ হয় বাসাবাড়ি আর অফিস-ফ্যাক্টরি জাতীয় স্থাপনায় আলোকিত করা ও তাপ নিয়ন্ত্রণের কাজে। এ কাজে কম বিদ্যুৎ খরচ মানে কম জ্বালানি ব্যবহার, কম গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ, কম খরচ। বাড়িতে কোন ধরনের রঙ ব্যবহার করলে সূর্যালোক শোষিত না হয়ে বিকিরিত হয়ে ফিরে যাবে, এটিও এখানে হিসাবে আনা হয়। যেমন সাদা বা হালকা রঙের ব্যবহারের ফলে স্থাপনা কম উত্তপ্ত হয়। আবার গাঢ় রঙ ব্যবহার করলে স্থাপনা বেশি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে ইত্যাদি। তেমনি ঘরের ভেতর দিয়ে আলো ও বায়ুপ্রবাহ বৈজ্ঞানিকভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আপনি ঘরটি উত্তপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেন। দেয়ালে কোন ধরনের ইট বা নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করবেন, এসব বিষয়ও বিবেচনায় নেয়া হয়। ছাদে করতে পারেন ছাদ-কৃষি। বলা হয়, গ্রিন বিল্ডিংয়ের ধারণার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারেন। চারপাশের পরিবেশ উন্নত হবে একই সঙ্গে।     

বাংলাদেশে অনেকগুলো গার্মেন্ট কোম্পানি ‘গ্রিন বিল্ডিং’ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বিল্ডিং বানালেও সাধারণভাবে অফিস-আদালত বা বাড়ি নির্মাণে সাধারণ মানুষের মাঝে এর কোনোই আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এর একটি কারণ, শুরুতে খরচ বেশি হওয়া। অথচ দূরভবিষ্যতের কথা মাথায় নিয়ে এ ধরনের পরিবেশবান্ধব স্থাপনা নির্মাণ করলে পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে এটি পরিশেষে লাভজনক হবে নিশ্চিত। ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’-এর প্রভাব হতো কম। রাজউক কিংবা বিএনবিসি নির্মাণ বিধিমালায়, এ নিত্যনতুন ধারনাগুলো সংযোজনের মাধ্যমে আমাদের নগর পরিবেশ অনেকাংশেই উন্নত করা সম্ভব ছিল।   

সর্বোপরি আর কি কি উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে?

জলাশয় ও সবুজ পরিসর বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। অবশিষ্ট যা আছে, সেগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং দূষণ মুক্ত করতে হবে। নির্মিত ভবনগুলোয় ছাদবাগান করায় উদ্যোগী হওয়া জরুরি। পরিবেশবান্ধব স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের মাটিকে দূষণমুক্ত করে গাছপালা জন্মানোর উপযোগী করাও প্রয়োজন। মোটকথা, পরিবেশ দূষণ রোধে সবাই সচেষ্ট হলে জলবায়ুজনিত এ বিপর্যয় মোকাবেলা সম্ভব। তবে সবকিছুই করতে হবে সুপরিকল্পিতভাবে। নগরবিদ, পরিকল্পনাবিদ, স্বাস্থ্য ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততায় দেশকে বাসযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন