আলোকপাত

নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ঋণের বোঝা আমরা কতটা দেখতে পাচ্ছি

ড. আর এম দেবনাথ

ছবি : বণিক বার্তা

এ কথা এখন সবারই জানা যে গ্রামের দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষেরা এক ঋণ করে আরেক ঋণ পরিশোধ করে। তারা ঋণ নেয় এক এনজিও থেকে এবং অপারগ হয়ে তা পরিশোধ করে আরেক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে। এভাবেই চলছে গ্রামের মানুষের জীবন এক ঋণ-চক্রে। তারা এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এ তো গেল একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের গরিবি। একই ঘটনা কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বেলায়ও ঘটছে? প্রশ্নটি উঠেছে দৈনিক বণিক বার্তার একটি প্রতিবেদন পাঠ করে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম: ‘বিদেশী সহায়তার প্রায় অর্ধেকই যাচ্ছে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে।’ খবরটি পাঠ করতে করতে আমার মনে পড়ছে ঋণের নানা ঘটনার কথা। দেখাই যাচ্ছে গরিবরা ঋণ করছে, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা ঋণ করছে। ঋণ করছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। তারা দেশ থেকেও ঋণ করছেন, বিদেশ থেকেও ঋণ করছেন ডলারে। এখন কথা হচ্ছে বেশি বেশি সরকারি ঋণ নিয়ে। চারদিকে শুধু ঋণের কথা, কাগজে ঋণের কথা, মিডিয়ায় ঋণের কথা। মুখে মুখে ঋণের কথা। বিশেষ করে বিদেশী ডলার ঋণের কথা। বলাই হচ্ছে ঋণ বেশি হয়ে যাচ্ছে, মাত্রার বাইরে। বিশেষ করে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের বিপরীতে। এসবের পরিণতি নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলোও এসব গুঞ্জনে বাতাস দিচ্ছে। যেমন মে মাসের ১৩ তারিখের খবর।

এটিও দৈনিক বণিক বার্তায়। এ খবরের শিরোনাম হচ্ছে: যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সম্ভাব্য অনেক বড় প্রকল্প থেকে সরে আসছে সরকার। প্রকল্পের যে তালিকা প্রকল্পটিতে দেয়া হয়েছে, তাতে আছে চারটি বড় প্রকল্প। যথা ঢাকা সার্কুলার রেল, ঢাকা সাবওয়ে, ঢাকা-লাকসাম কর্ড লাইন রেলপথ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথ। কারণ হিসেবে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বলা হচ্ছে। এসব খবরে মনে হচ্ছে, নীতিনির্ধারকদের ‘হুঁশ’ একটু সামান্য হলেও ফিরে এসেছে। ঋণ ভালো, উন্নয়নের কাজে লাগলে ভালো। কিন্তু অতিরিক্ত ঋণ কি ভালো? অতিরিক্ত ঋণ ভালো কি মন্দ, তা বোঝার জন্য প্রতিবেশী চারটি দেশের উদাহরণই যথেষ্ট। এর মধ্যে আছে পুরনো ‘‌পাপী’ পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা ও নেপাল। এসবই সাম্প্রতিক, সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ। বলাই বাহুল্য, এসব রাষ্ট্রের ঘটনা। 

ব্যক্তিগত পর্যায়েও আমাদের দেশের মানুষ ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বছর বছর এ সমস্যা প্রকট হচ্ছে। এ মুহূর্তেই ঢাকায় প্রচুর রিকশাওয়ালা পাওয়া যাবে, যারা উত্তরবঙ্গের ঋণী—গ্রামবাসী শ্রমজীবী। তাদের একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রিকশাওয়ালা ঢাকায় আসে রোজগারের জন্য। উদ্দেশ্য ঋণের কিস্তি দেয়া। ‘‌এনজিও’ থেকে ঋণ নিয়েছে। পরিশোধের অর্থ নেই। ঢাকায় এসেছে ঋণের কিস্তির টাকা জোগাড়ের জন্য। অবশিষ্ট যা থাকবে, তা যাবে দৈনন্দিন সংসার খরচের জন্য। তারা প্রায় সবাই একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দিনে দিনে অধিকতর ঋণে জর্জরিত। ঋণভারে দিশেহারা। 

বর্তমানের মূল্যস্ফীতি তাদের পাগল করে তুলেছে। তারা দেশে একটু মাছও খেতে পারে না। এত দাম। বিআইডিএসের হিসাবে গ্রামে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশ, যা হয়েছে মাছের দামের জন্য। শুধু মাছ নয়, গ্রামের লোকের বেলায় সবজিও দুর্মূল্য। সবই চলে আসে ‘সর্বভুক’ ঢাকায়, অতিবৃদ্ধ ঢাকায়। গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে কিছু থাকে না। তাই সমানে তারা ঋণ করে। ঋণ করে করে একপর্যায়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। ভাগ্যিস, ‘মহাজনী প্রথা’ এখন নেই। থাকলে জমি-জমা বন্ধক দিয়ে, জমিহারা হয়ে অর্থনৈতিকভাবে দিগম্বর হতে হতো। কিন্তু মহাজনী প্রথা না থাকুক, জন্ম নিয়েছে ‘বন্ডেড লেবার’ প্রথা। আমরা অনেকেই তা জানি না। জানলেও তা আমলে নিই না। 

কিছুদিন আগেরই ঘটনা। ঘটনাটি সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের যেখান থেকে তিনি বাদে আরো দুজন রাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) পেয়েছে দেশ, পেয়েছে সরকারি দলের মহাসচিবসহ বড় বড় নেতা, সেখানকার বেশ কতগুলো গ্রামের লোক দুর্দিনে মহাজনদের কাছ থেকে, দাদনদারদের কাছ থেকে ঋণ নেয়। ওইসব অঞ্চলে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে দেশের অনেক জেলার মতোই মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে। ফসল মার খেলে তো কথাই নেই। ওইসব অঞ্চলের কয়েকশ পরিবারের লোকজন রমজানের ঈদ করতে পারেনি। তারা বন্দি ছিল ইটভাটায়। দাদনদারদের কাছ থেকে তারা ঋণ নিয়েছে এই শর্তে যে তারা শ্রম দিয়ে ওই ঋণ শোধ করবে। এবং তাই হয়েছে। এসব ঘটনা নিত্যদিনের। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুরের অসংখ্য লোক এ সমস্যায় আক্রান্ত। ঢাকা শহরের বহু বাড়িতে ফ্ল্যাটে বেশ কিছুসংখ্যক ‘‌বুয়া’ (কাজের মেয়ে) পাওয়া যায়। তারা বাসা-বাড়িতে কাজ করতে আসে। পৈতৃক ঋণ পরিশোধের জন্য। বাবা-মা ঋণ করেছে, অথচ ঋণের টাকা পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই। মেয়েরা এসেছে লেখাপড়া ছেড়ে, গ্রামের জীবন ছেড়ে, ভগ্ন হৃদয়ে শহরে। বাবাকে ঋণমুক্ত করবে বলে। আবার এমনও আছে বাবা-মা মেয়ের বিয়ে দিতে না পেরে মেয়েকে পাঠিয়েছে ঢাকায় বাসা-বাড়িতে কাজ করে নিজের বিয়ের খরচ জোগাড় করতে। এসব ব্যক্তিগত পর্যায়ের খবর। বহু গবেষণায়ও আজকাল বেরিয়ে আসছে যে গ্রামের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক ঋণগ্রস্ত। তাদের ঋণ দিন দিন বাড়ছে। 

খুবই উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে গ্রামের লোক, শ্রমজীবী মানুষ ঋণ পরিশোধের জন্য প্রাণাতিপাত করছে। তারা ঋণগ্রস্ত থাকতে চায় না। এ দেশেই অথচ এক শ্রেণীর ‘‌ঋণগ্রহীতা হাঙরের’ জন্ম হয়েছে, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেরে দিচ্ছে। টাকা তো ফেরত দেয়ই না বরং আস্ফালন দেখায়। ভাবটা এমন, যেন ব্যাংকের টাকা তাদের পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত টাকা। মধ্যবিত্তও বিপদে। দেশে ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা বাড়ছে। ক্যাশলেস ইকোনমি হবে। ক্যাশ নয়, হবে কি তাহলে ক্রেডিট লেনদেন? এ ক্রেডিটের টাকা শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্ত কীভাবে শোধ করবে? গাড়ির ঋণ, ফ্ল্যাটের ঋণ, ভোগ্যপণ্য কেনার জন্য ঋণ, বেড়ানোর জন্য ঋণ—ঋণে ঋণে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্তও জর্জরিত হয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি ঋণে জর্জরিত হয়ে তা পরিশোধের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে। মধ্যবিত্ত ঋণগ্রস্ত হতে হতে ভোগ কমাচ্ছে, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ কমাচ্ছে। ফ্ল্যাটের স্বপ্ন ছাড়ছে, বিনোদনের আশা পরিত্যাগ করছে। তবু সে এখনো ঋণের টাকা দিচ্ছে, দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের একটি প্রভাবশালী অংশ ঋণের টাকা দিতে অস্বীকৃত হচ্ছে। তাদের কারণে ব্যাংক খাত আজ ধসের কিনারায়। ব্যাংক মার্জারের কথা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিশেহারা। আইএমএফ এসে খবরদারি করছে। অযৌক্তিক সব শর্ত দিয়ে ঋণ দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়াচ্ছে তাদের দেয়া সুপারিশ বাস্তবায়নের কারণে। তেলের দাম, গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, বাড়বে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। এর পরিণতি কী? গরিব মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষের আরো ধনী হওয়া ছাড়া গতি নেই। ভোগ ত্যাগ করা ছাড়া গতি নেই। আরাম আয়েশ নির্বাসনে পাঠানো ছাড়া গতি নেই। কিন্তু রাষ্ট্রের বেলায় কী হবে? রাষ্ট্র, ঋণ, আরো ঋণ, অধিকতর ঋণ, অতিরিক্ত ঋণ করলে এর পরিণতি কী? এমনিতেই দেখা যাচ্ছে আমাদের উন্নয়নের (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) জন্য টাকা নেই, যা রাজস্ব আয় তার প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যায় রাজস্ব ব্যয় হিসেবে। রাজস্ব ব্যয় নির্বাহের পর আর বেশি টাকা থাকে না উন্নয়নের জন্য। হিসাবেই দেখা যাবে আমাদের উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য যে টাকা বরাদ্দ থাকে, তার প্রায় সমান হচ্ছে আমাদের বাজেট ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) এটা প্রতি বছরের ঘটনা। ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত একই অভিজ্ঞতা। ১ টাকার কাজ ২ টাকা, ৩ টাকায় করতে করতে, ১ টাকার বাল্ব ৫ টাকায় কিনতে কিনতে বিশাল হয়েছে বাজেট। করভার বেড়েছে, দেশী-বিদেশী ঋণ বেড়েছে, বাড়ছে। সরকারের সুদব্যয় মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে ও বাড়ছে, তা টাকায় এবং ডলারে। দেশের ভেতরে বুঝলাম। বন্ড জোর করে ব্যাংকে ব্যাংকে বিক্রি করে চলতে পারে কিছুদিন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চলতে পারে কিছুদিন। কিন্তু ডলার ঋণের কী হবে? এতে আছে দেশের সার্বভৌম ডলার ঋণ, রাষ্ট্রের ঋণ, আবার আছে বেসরকারি খাতের ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ীদের ঋণ। এতদিন শুনেছি আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিদেশী ঋণ বেশি করিনি। অনেক দেশ আমাদের চেয়ে বেশি বিদেশী ঋণ নিয়েছে। অতএব দুশ্চিন্তা নেই। কিছু সংখ্যক ‘আইএমএফের বন্ধু্’ অর্থনীতিবিদও একই কথা বলেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারই বড় বড় ঋণ থেকে বিরত থাকছে। সরকার একটি উৎস থেকে ‘সফট লোন’ ডলারে খুঁজছে। সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাজেট সহায়তা চাইছে। চাইছে রফতানি। রেমিট্যান্স আগের মতো বাড়ছে না। আমদানির ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর হচ্ছে না। ডলারের দাম ১২০ টাকায় উঠেছে। ঈশ্বর জানেন, এর দাম কততে ওঠে। ইত্যবসরে দৈনিক বণিক বার্তার খবর: বিদেশী সহায়তার প্রায় অর্ধেকই যাচ্ছে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে। ২০২২-২৩-এ এর পরিমাণ ছিল মোট বিদেশী সহায়তা ছাড়ের ৩২ শতাংশ। ২০২৩-২৪-এ তা দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশ। খবরটি কোনোভাবেই ভালো নয়। এ তো গ্রামের শ্রমজীবী ঋণগ্রস্ত মানুষের অবস্থার মতো। বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা দরকার সরকারের, যাতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়।

ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন