সময়ের ভাবনা

ডলার-টাকা বিনিময় হার পুরো বাজারভিত্তিক হোক

মাসরুর আরেফিন

ছবি : বণিক বার্তা

দৈনিক বণিক বার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ যৌথভাবে আয়োজন করেছে প্রথম ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স (ডিএসআইসি ২০২৪)। চমৎকার এ উদ্যোগে আমাদের রাখার জন্য ধন্যবাদ। সিটি ব্যাংক সব সময়ই এমন ভালো উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে চায়। আপনারা জানেন সিটি ব্যাংক বড় একটি ব্যাংক এবং দীর্ঘদিন ধরেই আমরা সব সূচকেই ভালো করছি। আমাদের শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে আছে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। এছাড়া আমেরিকান এক্সপ্রেসও রয়েছে আমাদের সঙ্গে। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সিটি ব্যাংকের সিইও হিসেবে আমি কাজ করছি। যদিও অর্থনীতির ছাত্র নই, তবুও এ ধরনের অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিষয়ক সেমিনার আমাকে খুব উদ্বুদ্ধ করে। আমি মনে করি, এ-সংক্রান্ত আলোচনাগুলো শোনা উচিত ও বোঝা উচিত। সামষ্টিক অর্থনীতিতে ক্রিয়াশীল অংশগ্রহণকারী হিসেবে সবসময় চলমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর আমাদের ব্যাংকারদের দৃষ্টি রাখতে হয়। আবার আর্থিক স্থিতিশীলতার দিকে আমাদের ব্যাংকারদের খেয়াল রাখতে হয়। কারণ এ অর্থনীতিতেই আমাদের ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করতে হচ্ছে। 

বর্তমানে মার্জার বা অ্যাকুইজিশন ইস্যুতে সিটি ব্যাংক নিয়ে অনেক কথা চলছে। স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, এ মুহূর্তে ব্যাংকের ব্যয় কমাই; অর্থাৎ এসব অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাও না করি। আবার তখনই মনে হয়, এটাই এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের সঠিক সময়। আলোচনা হোক এবং কী করতে হবে সেই বিষয়ক আলোচনার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসুক সমাধান। এ সময়ে এই সেমিনার স্পন্সর করার এটিই প্রেক্ষাপট। এছাড়া এর আগেও বণিক বার্তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা স্পন্সর করেছিলাম।

ব্যাংকার হিসেবে আমরা দেখছি, মার্চ পর্যন্ত জিডিপির টার্গেট ৭ দশমিক ৫ শতাংশের বিপরীতে ৬ শতাংশ অর্জন হয়েছে। তবে আমাদের ব্যাংকারদের বেশি উদ্বেগের কারণ মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অফিশিয়াল তথ্যানুসারে, মার্চ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। কিন্তু বাস্তবে তো মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮১ শতাংশের বেশিই অনুভূত হয়। কারণ বাজারে গেলে টের পাই—মাছ-মাংসের দাম বেশি, শাকসবজির দাম বেশি; এদিকে বাসা ভাড়া, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিবেশের মধ্যেই আমাদের ব্যাংক ব্যবসা চালাতে হয়। এ পরিবেশের মধ্যেই ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে হয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলতে থাকলে তার প্রভাব অর্থনীতির সবদিকেই পড়ে। আমাদের কনজিউমার বিজনেসেও পড়ে। মিল-কলকারখানায় মানুষ তখন পণ্য কম আনে, আমদানি কম হয়, মূলধনি যন্ত্রপাতি কম আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

এসব বিষয় নিয়ে এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আশা করি বিস্তৃত আলোচনা হবে। তবুও আমি ব্যাংকার বলেই বলছি, ক্রেডিট গ্রোথ কমে যাচ্ছে। আমরা ব্যাংকাররা দেখতাম, একসময় ক্রেডিট গ্রোথ ১৩ বা ১৪ শতাংশ থাকত। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। তাও ক্রেডিট গ্রোথ কেন হচ্ছে না—সেগুলো নিয়েই প্রশ্ন। 

তবে ভালো দিক হলো, রফতানি সঠিক পথেই যাচ্ছে। রফতানির নয় মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। আমরা করেছি ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন। অর্থাৎ রান রেট বেসিসে আমরা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৯৩ শতাংশে আছি। এটা ভালো বিষয়। আরেকটা ভালো বিষয় হলো রেমিট্যান্স প্রবাহ, যা আমাদের ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করছে। ব্যাংক খাতের মাধ্যমে আমরা রেমিট্যান্স আনছি। আমাদের বার্ষিক রেমিট্যান্স লক্ষ্যমাত্রা ২২ বিলিয়ন ডলার ছিল। নয় মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার। নয় মাসে এসেছে ১৭ বিলিয়ন ডলার। এ দুটো বিষয় কিন্তু বেশ ইতিবাচক।

এবার আমদানির বিষয়ে বলা যাক। এখানে অনেক দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে উপস্থিত আছেন। আমরা জানি, চলতি অর্থবছরে আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ বিলিয়ন ডলার। আট মাসে হওয়ার কথা ৫৩ বিলিয়ন ডলার। বাস্তবে ৫৩ ডলারের বিপরীতে আমদানি হয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও চলতি বছরে কম আমদানি হতে যাচ্ছে। এটা আদৌ কি আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো খবর? সার্বিক অর্থনীতিতে এই কম আমদানির চাপ পড়ছে। অর্থনৈতিক গতিশীলতা কম মানে সব কিছুর ওপরেই নেগেটিভ চাপ থাকবে। আমরা রেমিট্যান্স আনছি ঠিকই, কিন্তু আমদানিকে নিয়ন্ত্রণ করছি। ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর ডলার চলে যাওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সেটা ভালো কথা। তবে এত বৃহৎ আকারের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য আমদানি লক্ষ্যমাত্রা হওয়া এ মুহূর্তে ডলার সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সাপেক্ষে হওয়া উচিত প্রতি মাসে ১০ বিলিয়ন ডলার। মাসে কিন্তু আমরা ৯ বিলিয়ন আগেই ছুঁয়েছিলাম। এতে আমাদের বার্ষিক আমদানি ১২০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। মনে রাখতে হবে, আমদানি থেকেই পণ্য তৈরি হয়, পণ্য দেশীয় বাজারে বিক্রি হয় এবং পণ্য রফতানি হয়।

ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কিছু করতে হবে, যার প্রথমটা হলো এমন একটা ডলার-টাকা হার যাতে করে রেমিট্যান্স বৈধ পথে আসে। 

ব্যাংকারদের কাছে প্রথম প্রশ্ন করা হয়ে থাকে, তারল্যের অবস্থা কী? উদ্বৃত্ত তারল্য এ মুহূর্তে আছে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৫ হাজার কোটি টাকা কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া। আমরা রেপো রেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ নিচ্ছি। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু ব্যাংককে ১৫ হাজার কোটি টাকা তারল্য সরবরাহ দিয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃত তারল্য ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা বাদ দিলে থাকেই মাত্র ৬০-৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা কিনা এত বড় মার্কেট বিবেচনায় অতি নগণ্য। আপনারা যদি এর আগের বছরগুলোর তুলনায় দেখেন, মার্কেটে তারল্যের এ চাপটা আছে। এর মধ্যে আবার মুদ্রা সরবরাহের সমস্যাটাও রয়েছে। মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এটা গত বছর থেকে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ বাড়বে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে, সেটা অসংগতি। এসব অসংগতি দূর করার জন্যই কাজ করা উচিত। ঠিক তেমনই আমরা ব্যাংকাররা মনে করি, সুদহার বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত। ভালো খবর হচ্ছে, সম্প্রতি এ বিষয়ে মাননীয় গভর্নর আমাদের জানিয়েছেন, সুদহার বাজারভিত্তিক করা হবে। আমরা একইভাবে চাই, ডলার-টাকা বিনিময় হার পুরো বাজারভিত্তিক হোক।

আমাদের অর্থনীতি ব্যাপক সম্ভাবনাময়। নানা সংকটের মধ্যেও আমাদের রেমিট্যান্স এসেছে। আমাদের আমদানিকারকরা ১২০ টাকায়ও ডলার বিনিময় করতে রাজি। আমি মনে করি, অর্থনীতিকে অর্থনীতির মতো চাহিদা-জোগানের ভিত্তিতেই ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করা উচিত। এতেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আসল হিসাবটি নিহিত। এরই মধ্যে আমাদের ক্রলিং পেগ পদ্ধতি আসছে। আমরা আশা করি, ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে ডলার-টাকার হার আরো বাস্তবসম্মত হবে। এখন ১১০ টাকা এ হার। আমরা ১০৯-এ কিনছি, আর ১১০-এ বিক্রি করছি। কিন্তু আজকে দুই বছর ধরে আন্তঃব্যাংক ডলার বাজার বন্ধ। আমাদের ব্যাংকারদের ডলারের যেটা প্রধান উৎস ছিল, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা আমদানি করতাম, সেই আন্তঃব্যাংক আবার চালু করতেই হবে। আমরা দেশকে ভালোবাসি এবং আমরা আমদানিকে সমর্থন করতে চাই। অনেক মানুষ আছেন যারা মূলধন যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে চীন থেকে সামান্য খেলনা এনে সংসারটা চালান। এই সেক্টরগুলোর জন্য, অর্থাৎ এসএমই সেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলছি, এমন একটা রেট বা হার আসুক, যে রেটে ডলারের বিনিময় হার আমদানিকে সমর্থন দেয়ার জন্য যথেষ্ট ডলার সরবরাহ আনবে। তখন একটা স্থিতিশীলতা আসবে। স্থিতিশীলতার জন্য আমাদেরকে সমস্যা সমাধানের পথেই হাঁটতে হবে, চিন্তাগুলো সেদিকেই করতে হবে।

এ সমাধানের লক্ষ্যেই অফশোর ব্যাংকিংয়ে ফিক্সড ডিপোজিট প্রডাক্টে এসেছে, যা বাংলাদেশের জন্য যুগান্তকারী বিষয়। আজকে মরিশাসের অর্থনীতি ১৩ বিলিয়ন ডলার আর অফশোর ব্যাংকিংয়ে তাদের ডিপোজিট ৮০০ বিলিয়ন ডলার। তারা সারা পৃথিবী থেকে এই ডিপোজিট পাচ্ছে। আজকে অফশোর ব্যাংকিংয়ে বিদেশীদের কাছ থেকে বড় অংকের লোন নিয়ে আমরা আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্য চালাই। এক সিটি ব্যাংকের লোন সেখানে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এই অফশোর ব্যাংকে আমাদের ডিপোজিট পোর্টফোলিও কিছুই নেই। এখন দুর্দান্ত একটা আইন এসেছে, অফশোর ব্যাংকিং ট্যাক্স মুক্ত। আমি মনে করি, এটা ডলার সরবরাহের তৃতীয় বড় উৎস হবে, আর রফতানির পর এটাই হবে দ্বিতীয় বড় উৎস। কারণ একসময় বাংলাদেশ উন্নত হবে। মানুষ বিদেশে ওইসব কাজ করতে যাবে না। বিদেশে গিয়ে বাঙালি রাস্তাঘাটে শ্রম দেবে না। তারা বাংলাদেশেই ভালো থাকবে—সেই দিনের প্রত্যাশা করি।

গত বছরের ভয়াবহ সময়ের কথাও আমাদের মনে আছে। গত বছর নেট ওপেন পজিশনে (এনওপি) ৬০০ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে ছিল আমাদের ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি। আজকে সবগুলো ব্যাংক মিলে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, আমরা পজিটিভ। অর্থাৎ আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের আছে, যা খুবই ভালো। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার অনেক ভালো কিছু করতে চান। তিনি চেঞ্জমেকার ঘরানার মানুষ। এখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান বিজ্ঞ প্রতিমন্ত্রীও আছেন আমার সামনে। তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, আসুন বিরাজমান অসংগতিগুলো আমরা দূর করি। আমরা যদি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করি, তো সেটা যেন প্রকৃত অর্থেই সংকোচনমূলক রাখি। আর সম্প্রসারণমূলক নীতি গ্রহণ করলে তা যেন সম্প্রসারণমূলকই হয়।

এসব বিষয়ে কথা বলার এখনই সঠিক সময়। আমি প্রত্যাশা করি, এখানে ভালো বিতর্ক হবে যা থেকে বেশকিছু সমস্যার সমাধান উঠে আসবে। বণিক বার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সঙ্গে এ ধরনের অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে পেরে সিটি ব্যাংক আনন্দিত ও গর্বিত।

মাসরুর আরেফিন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিটি ব্যাংক পিএলসি 

[দৈনিক বণিক বার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের যৌথ আয়োজনে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম দিনে (৫ মে, ২০২৪) রাখা আলোচনায়।]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন