যুক্তরাষ্ট্র থেকে লোহিত সাগর দিয়ে তুলা আমদানি ব্যাহত

বদরুল আলম

ছবি : বণিক বার্তা

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে তুলা আমদানির প্রধান রুটটি গড়ে উঠেছিল ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে জিব্রাল্টার প্রণালি-সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগরের বাব-এল-মানদেব প্রণালি হয়ে আরব সাগর তথা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করত তুলাবাহী জাহাজ। কিন্তু কয়েক মাস ধরে এ পথে পণ্য পরিবহন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাবাহী বা দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যে ব্যবহৃত জাহাজে আক্রমণ চালাচ্ছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। 

লোহিত সাগর দিয়ে বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ায় দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল থেকে তুলাবাহী জাহাজগুলোকে বাংলাদেশে আসতে হচ্ছে আফ্রিকার দক্ষিণ আটলান্টিক উপকূল দিয়ে উত্তমাশা অন্তরীপ (কেপ অব গুড হোপ) হয়ে দক্ষিণ ভারত মহাসাগর ঘুরে। বিকল্প আরেকটি রুট হলো পানামা খাল হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে মালাক্কা প্রণালি হয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করা। কিন্তু এ দুই পথেই যাত্রার দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের সময় ও ব্যয় প্রয়োজন হয় তুলনামূলক বেশি। আবার ব্যাংকের লেনদেন সীমাসহ নানাবিধ কারণে দেশটি থেকে প্রতি চালানে তুলা আমদানির পরিমাণও কমিয়ে দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের, যার প্রভাব পড়ছে বস্ত্র ও পোশাক খাতের সার্বিক সরবরাহ চেইনে। ব্যবসায়ীদের দাবি, উৎপাদন থেকে শুরু করে পণ্য জাহাজীকরণ পর্যন্ত সময় সমন্বয় করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। 

বস্ত্র খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাইলেই যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প উৎস বেছে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না তাদের। কারণ বাংলাদেশী পোশাকের ক্রেতাদের মধ্যে পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত তুলাজাত সুতা-কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তুলা গোটা বিশ্বেই সর্বোৎকৃষ্ট, পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত হিসেবে স্বীকৃত। এজন্য পরিমাণে কমিয়ে এবং বাড়তি ব্যয় করে হলেও দেশটি থেকে তুলা আনতে হচ্ছে তাদের। 

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। অনেক পথ বেশি ঘুরে আসতে হচ্ছে বলে সময় বেশি লাগছে। এতে ব্যাংকে আমাদের লেনদেনের সীমাও আটকে থাকছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ব্যবহার করি তা কন্টামিনেশন ফ্রি বা দূষণমুক্ত ও উজ্জ্বল হওয়ার কারণে। ক্রেতারাই এমন তুলার চাহিদা দেন। এ ধরনের তুলা ব্যবহার করতে হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই দেশটির লিড সার্টিফায়েড সরবরাহকারীদের কাছ থেকে আনতে হবে। আবার আমেরিকান ট্রাস্ট প্রটোকলের সদস্য ৩০০ কারখানা আছে বাংলাদেশে। এ কারখানাগুলোকেও ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে সেখান থেকেই তুলা আমদানি করতে হয়। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে দূরত্ব। সুয়েজ খাল অতিক্রম করে লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজগুলো যায়। হুথি বিদ্রোহের কারণে এখন অনেক পথ ঘুরে পণ্যবাহী জাহাজ আনতে হয় বলে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। অন্তত ১৫ দিন সময় বেশি লাগায় ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। আগে যদি ৩০ শতাংশ তুলা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এনে থাকি এখন ১০ শতাংশ আনতে হচ্ছে, কারণ ব্যাংকে লেনদেনের সীমা আটকে থাকছে।’

বাংলাদেশের মোট রফতানি পণ্যের ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। এর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে গড়ে ওঠা বস্ত্র শিল্প এরই মধ্যে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প খাতে রূপ নিয়েছে। এ শিল্পের মিল বা কারখানাগুলোয় উৎপাদিত কাঁচামাল সুতা ও কাপড়ের সিংহভাগই তুলাজাত। ফলে তুলাই এখন প্রধানতম শিল্প কর্মযজ্ঞের মূল কাঁচামাল হয়ে উঠেছে। যদিও দেশে তা উৎপাদন হচ্ছে চাহিদার তুলনায় একেবারে নগণ্য। তাই এর প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। বর্তমানে দেশে তুলার বার্ষিক চাহিদা কম-বেশি ৮৫ লাখ বেল। 

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি পরিমাণে তুলা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম নিউ এশিয়া গ্রুপ। এ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ মতিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌পূর্ব উপকূল থেকে তুলা আমদানিতে এখন সময় বেশি লাগছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দাম এখনো বাড়েনি। কিন্তু আফ্রিকা ঘুরে আমদানি করতে হচ্ছে বলে আগে যেখানে সময় লাগত দুই-আড়াই সপ্তাহ, এখন আরো দুই সপ্তাহ সময় বেশি লাগছে। এর প্রভাবে পণ্য জাহাজীকরণের সময় সমন্বয় করতে হচ্ছে।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দেয়া মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ বিপণনবর্ষে (আগস্ট-জুলাই) বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি তুলা আমদানি হয়েছে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে, যা মোট চাহিদার ৩৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে আফ্রিকার দেশগুলো থেকে তুলা আসছে মোট আমদানির ৫১ শতাংশ। এছাড়া ব্রাজিল থেকে ১৬, ভারত থেকে ১২ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০ শতাংশ তুলা আমদানি হয়েছে। 

বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএ) সাবেক সভাপতি মেহ্দী আলী বলেন, ‘‌যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির বিদ্যমান জটিলতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামীতে সমস্যা আরো ঘনীভূত হবে। আরো একটা বিষয় হলো লোহিত সাগর ইস্যুতে এখন ব্রাজিল থেকে তুলা আমদানি নিয়েও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলার মান এখন অনেক খারাপ। দেশটির তুলার দামও তুলনামূলক বেশি। সার্বিক পরিস্থিতিতে তুলা আমদানি নিয়ে বিড়ম্বনা বেড়েই চলেছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন