বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংক একীভূতকরণ একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এতে বড় ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটা কখনো সমাধান হতে পারে না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংক ব্যবস্থায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এমন মন্তব্য করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে দুর্বল ও সমস্যাযুক্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ।
গতকাল রাজধানীর গুলশানে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) আয়োজিত ‘সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও এর চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পিআরআই চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার, এমসিসিআইয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আনিস এ খান প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফারুক আহমেদ।
সাদিক আহমেদ বলেন, ‘সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার ঘোষণা এসেছে। ব্যাংক একীভূত করা ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত। সাধারণত কেউ দুর্বল প্রতিষ্ঠান একীভূত করতে চায় না। ফলে জোর করে ব্যাংক একীভূত করা কোনো সমাধান না। এছাড়া মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা চালু করেছে, সেটি পুরোপুরি তুলে দিয়ে তা বাজারভিত্তিক করা যেতে পারে।’ সরকার দীর্ঘদিন ধরে নয়-ছয় ভিত্তিতে সুদহার রেখেছিল। এটিকে ভুল সিদ্ধান্ত মনে করেন সাদিক আহমেদ। মোট জিডিপি ও বিনিয়োগে নয়-ছয় সুদহারের কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে এ মুহূর্তে রাজস্বনীতি সংস্কারে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি প্রণয়ন (মনিটারি পলিসি) কমিটিতে যুক্ত এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘রাজস্বনীতি হতে হবে মুদ্রানীতির সহায়ক। তা না হলে মুদ্রানীতি ঠিকভাবে কাজ করবে না। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। ফলে মুদ্রা বিনিময় হার আবার বেসামাল হয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরো সময় লাগবে। এজন্য ভবিষ্যতে সুদহার আরো বাড়ানো হতে পারে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে অবশ্যই বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে। রাজস্বনীতিতে পর্যাপ্ত সংস্কার না আনায় এখনো বাজেট ঘাটতি কমানো সম্ভব হয়নি। রফতানিতে প্রণোদনা নীতি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই, বিনিময় হার নীতি, ট্যাক্স নীতি আর মূলস্ফীতির ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। বাজেটের চাপ কমাতে কর ব্যয় নীতির ব্যবস্থা করতে হবে। খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে কমিয়ে আনার আগ পর্যন্ত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নতুন ঋণ দেয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। এটিই খেলাপি ঋণ কমানোর সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও টেকসই উপায়।’
বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় চার ধরনের উদ্বেগ রয়েছে বলে মনে করেন পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান। এগুলো হলো এক. চলতি হিসাবে বড় ঘাটতি। দুই. রিজার্ভ কমে যাওয়া ও টাকার অবমূল্যায়ন। তিন. দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। চার. রাজস্ব আহরণ কম হওয়া। তিনি বলেন, ‘এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সরকারের গৃহীত কিছু ভুল নীতি ও সঠিক পদক্ষেপের অভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে যে দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতি হচ্ছিল, তা গত চার বছরে একাধিক বাহ্যিক ধাক্কায় হুমকির মুখে পড়েছে। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এর ফলাফল এখন পর্যন্ত আশানুরূপ নয়। বর্তমানে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী রয়েছে। বিনিয়োগ ও রফতানি বৃদ্ধির হারও কম।’
বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে উদ্বেগগুলোর মধ্যে চলতি হিসাবে ঘাটতিকে প্রথম স্থানে রাখেন সাদিক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ায় বড় ধরনের বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সরকার আমদানি কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেও মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করেনি। ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রিজার্ভ কমেছে। মাত্র ১১ মাসে ৪৪ শতাংশ বা ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ কমেছে। এটা বড় ধরনের চাপ।’
সাদিক আহমেদের মতে, বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় দ্বিতীয় উদ্বেগ হচ্ছে রিজার্ভ কমে যাওয়া ও টাকার অবমূল্যায়ন। তিনি বলেন, ‘আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও শুল্কবৃদ্ধির পরও সরকার রিজার্ভের ক্ষতি রোধ করতে পারেনি। সরকার দীর্ঘদিন ধরে বিনিময় হার এক জায়গায় বেঁধে রেখেছিল। এখন টাকার অবমূল্যায়ন করে বিনিময় হার সমন্বয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে বর্তমান মূল্যস্ফীতির জন্য টাকার অবমূল্যায়নকে নয়, বরং বিনিময় হার ধরে রাখাকে দোষ দিতে হবে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের আগস্টে বেড়ে ৯ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছায়। এর পর থেকে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে থাকছে। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে কর-জিডিপি হার বাড়ছে না। এসব বিষয়ে সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে কোনো উদ্যোগই কাজ করেনি।’