এসি এখন ‘মেড ইন বাংলাদেশ’

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি: ওয়ালটন

তীব্র তাপপ্রবাহে তটস্থ দেশ। চলছে হিট অ্যালার্ট। গরম কেবল জনজীবনেই অস্বস্তি তৈরি করছে না, প্রাণঘাতীও হয়ে উঠেছে। ফলে এখন অফিস বা মার্কেট ছাড়াও এয়ার কন্ডিশনারের গুরুত্ব বাড়ছে ঘরোয়া পর্যায়ে। অথচ বছর দশেক আগেও কেবল বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানেই এসির দেখা মিলত। এসিকে গণ্য করা হতো বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, বর্তমানে দেশে এসির বাজারের আকার ৭ হাজার কোটি টাকার। দেশী এসির বাজারে ওয়ালটন, যমুনা, মিনিস্টার-মাইওয়ান, ভিশন, ট্রান্সটেক উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে হাইসেন্স, জেনারেল, গ্রী, সিঙ্গার, প্যানাসনিক, দাইকিন, এলজি, স্যামসাং, শার্প, তোশিবা ও ওয়ার্লপুল। গ্রীসহ এসব বিদেশী ব্র‍্যান্ডের অনেকগুলো এখন বাংলাদেশের কারখানাতে তৈরি হচ্ছে।

গত কয়েক বছরে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে এসি বিক্রি। বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দেশের এসির চাহিদার ৮৫ শতাংশেরও বেশি পূরণ করছে। ২০২৩ সালে ৫ লাখ ৩০ হাজার এসি বিক্রি হয়েছিল। ২০২২ সালে বিক্রির আকার ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সার্বিকভাবে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে এসি বিক্রি। বিক্রয় সূচকে এ উল্লম্ফনের পেছনে দায়ী বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, এসির কম দাম, দক্ষ শ্রম-প্রযুক্তি ও নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫২৮ ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২৮ সালে এটি ৪ হাজার ১১১ ডলারে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। মাথাপিছু আয় বাড়লে সেটি কনজিউমার ইলেকট্রনিকসের ভোগ বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া বাংলাদেশের বড় জনসংখ্যার কারণেও এখানে বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। এদিকে দেশের প্রায় শতভাগ এলাকা বিদ্যুতায়নের আওতায় আসার ফলে গ্রামীণ অঞ্চলেও ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসির ব্যবহার। সরকারের দিক থেকে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনের বিষয়ে জোর দেয়ার কারণে স্থানীয় উদ্যোক্তারা দেশীয়ভাবে এসি উৎপাদনে এগিয়ে এসেছেন, যার কারণে কমছে আমদানিনির্ভরতা। এসির দাম এখন তুলনামূলক কম হওয়ার মূল কারণ বেশির ভাগ যন্ত্রাংশ স্থানীয়ভাবে তৈরি হওয়া। প্রধান সার্কিট ও কমপ্রেসর বাদ দিলে প্লাস্টিকের ফ্রেম ও কপার কেবলের মতো উপাদান দেশে তৈরি হয়। এসির ভেতরের তার স্থানীয় নির্মাতারাই সরবরাহ করেন। তবে কাঁচামাল ও সংশ্লিষ্ট কিছু পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। 

এসির বাজার একটা সময় পুরোপুরি ছিল আমদানিনির্ভর। জাপান, কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে বিদেশী ব্র্যান্ডের এসি আমদানি করা হতো। প্রথমে চীন থেকে এসি আমদানি শুরু হয়। ২০০৪ সালে প্রথম দেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইলেক্ট্রো মার্ট লিমিটেড চীনের হোম অ্যাপ্লায়েন্স প্রস্তুতকারক গ্রীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আমদানি করা প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ দিয়ে এসি সংযোজন শুরু করে। সে সময় এসির সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ৩০ হাজার। ক্রমে দেশের অনেক আমদানিকারক চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ এনে দেশে সংযোজন করে এসি বাজারজাত করতে থাকে। এরই মধ্যে দেশীয় কয়েকটি কোম্পানি দেশে ইলেকট্রনিক পণ্যের কারখানা করে। কেউ কেউ শুরুটা করেছিল রেফ্রিজারেটর দিয়ে। একসময় ওইসব কারখানায় এসি উৎপাদন ও সংযোজনের ব্যবস্থাও চালু হয়। ২০১৫ সালের আগে বাংলাদেশে এসিকে বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তার পর থেকে এসির ব্যবহার বেড়েছে দ্রুতগতিতে, বিলাসপণ্য থেকে চলে এসেছে প্রয়োজনীয় পণ্যের কাতারে। ২০২০ সালের পর ওয়ালটন, মিনিস্টার-মাইওয়ান, যমুনা ও ভিশনের মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এসি সংযোজন ও উৎপাদনে ব্যাপক বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। সরকার দেশীয় এসি প্রস্তুতকারকদের কর সুবিধা দেয়ায় তারা বড় পরিসরে তাদের কর্মপরিকল্পনাকে ঢেলে সাজাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এসি তৈরির লক্ষ্যে ২০২০ সালে পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন কারখানা স্থাপন করে ইলেক্ট্রো মার্ট। বর্তমানে এটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য ৮০টি মডেল তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা প্রতি বছর তিন লাখ ইউনিটে দাঁড়িয়েছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ এসি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের বার্ষিক উৎপাদন দুই লাখ ইউনিট। ভিশন ইলেকট্রনিকসের বার্ষিক প্রায় ৫০ হাজার ইউনিট এসি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এদিকে সম্প্রতি পৃথিবীজুড়ে জনপ্রিয় কনজিউমার ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ড হাইসেন্সের এসিও বাংলাদেশে উৎপাদন করছে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। 

নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা ও উন্নয়নে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ করছে। এ ধরনের উদ্যোগের ফলে এমন এসি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে, যা বিদ্যুৎ খরচ ও দূষণ কমায়। প্রণোদনা ও ভর্তুকির পাশাপাশি উৎপাদন ও প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে এ খাত বিকাশে সরকারেরও ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক মান মেনে চলছে, যা ক্রেতাদের আস্থা বাড়াচ্ছে। তার চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে বিক্রয় সূচকে। দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইলেকট্রনিকস খাতের কোম্পানি ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির প্রকাশিত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে ২০২২-২৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ব্যবসা থেকে আয় হয়েছে ৬ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল এয়ার কন্ডিশনার থেকে আয় হয়েছে ৬১৮ কোটি টাকা। ওয়াল্টনের সমীক্ষা বলছে, ২০২২ সালে এসির বাজার ৩০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছিল। ২০২৩ সালে এসেও প্রতিষ্ঠানটি বড় প্রবৃদ্ধি দেখেছে। 

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের কনজিউমার ইলেকট্রনিকসের বাজারে গত ১০ বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৫ সালে এর আকার ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান, মাথাপিছু আয় ও শহরে মানুষের বসবাসের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে কনজিউমার ইলেকট্রনিকসের বাজারের প্রবৃদ্ধি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের (বিসিজি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ, যা ২০২৫ সালে ৩ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়াবে। প্রতি বছর এ শ্রেণীতে গড়ে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ যোগ হচ্ছে সক্ষমতার তালিকায়। মূলত এ সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনা করেই স্থানীয় বড় ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো ইলেকট্রনিকস খাতে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছে। পাশাপাশি বাজার ধরে রাখতে বেশকিছু বিদেশী ব্র্যান্ডও বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে। কভিডের অভিঘাতের কারণে দুই বছর কনজিউমার ডিউরেবলসের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত, ডলার সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন ও ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার প্রভাব পড়েছে এ খাতের ব্যবসায়। এতে খাতটির প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ কিছুটা পিছিয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে কনজিউমার ইলেকট্রনিকসের বাজারেও প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাড়বে এসির বাজারও। ২০২৩-২৭ সালের মধ্যে এসির বাজার ২৫ শতাংশ কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট (সিএজিআর) বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

দেশে এখন প্রতি বছর ঘরে বা অফিসে ব্যবহার হয় এমন এসির চাহিদা পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ ইউনিট। প্রতি বছর শতকরা ১৫-২০ ভাগ হারে বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। অর্থাৎ গড়ে শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি ধরলেও প্রতি বছর নতুন চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে ৭৫-৮০ হাজার ইউনিট। বিক্রি বৃদ্ধির এ সম্ভাবনা বিনিয়োগকারীদের জন্য আশার সঞ্চার করেছে। তবে কেবল দেশের চাহিদাতেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশে তৈরি এসি রফতানিরও ভালো সম্ভাবনা দেখছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কেউ কেউ পরীক্ষামূলকভাবে কিছু কিছু দেশে পাঠাচ্ছে। তবে তার জন্য সরকারি কিছু নীতিগত সুবিধার প্রয়োজন। যে ধরনের সুবিধা তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন বন্ডেড ওয়্যারহাউজের সুবিধা, ব্যাক টু ব্যাক এলসির সুবিধা, কাঁচামালের জন্য শুল্ক সুবিধা—এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। এসব নিয়ে আলোচনাও চলছে। এ সুবিধাগুলো পাওয়া গেলে বড় আকারের রফতানি শুরু হতে পারে। রফতানির উপযোগী এসির পাশাপাশি উৎপাদকেরা দেশের চাহিদা অনুসারে আরো উন্নত মানের এসি তৈরির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিশেষ করে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ইনভার্টার প্রযুক্তির এসির উৎপাদন বাড়ছে এখন। এ ধরনের এসির দাম এখন তুলনামূলক একটু বেশি। তবে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের দিক বিবেচনা করলে সার্বিক খরচ এতে কম। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা জানান, পাঁচ বছরের মধ্যে প্রায় শতভাগ এসি ইনভার্টার প্রযুক্তির আওতায় চলে আসবে। তারা চেষ্টা করছেন দামটা কমিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে আরো সহজলভ্য করে তোলার জন্য। তার ফলাফল দেখা যাচ্ছে বাজারে।

গরম আবহাওয়ায় বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসও গরম লাগে। তাই ঘরের জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে এসি কেনার কথা চিন্তা করছে মধ্যবিত্তরাও। যারা বহুতল ভবনের ওপরের তলায় থাকেন কিংবা যাদের বাড়িতে ছোট শিশু রয়েছে, তারাও এসি কিনতে এগিয়ে আসছেন। এভাবে একসময় ‘বিলাসপণ্য’ হিসেবে এসি সম্পর্কে যে ধারণা, তা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। এসি এখন ঘরের আট-দশটা প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক পণ্যের মতো-শহর, এমনকি মফস্বলেও।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন