পর্যালোচনা

অর্থ পাচার, সিন্ডিকেট ও সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্নহীন আইএমএফ!

ড. আর এম দেবনাথ

ছবি : বণিক বার্তা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি মিশন এখন ঢাকায়। মাত্র ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ। এর তৃতীয় কিস্তি দেয়ার আগে তারা আমাদের অফিসে অফিসে যাচ্ছে। কর্মকর্তাদের জেরা করছে। করণীয় কী তার কথা বলছে। অকরণীয় কী তাও বলছে। যথারীতি করণীয়ের মধ্যে আছে: সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াও। আবার এর বিপরীতে বলছে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। এমন সব স্ববিরোধী কথা। তাদের আবদারের মধ্যে আছে: ব্যাংকিংয়ের সংস্কার, বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের মূল্য বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া, খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো। মজার বিষয় তাদের আলোচনায় কতগুলো জরুরি বিষয় পাই না। তারা অর্থ পাচার সম্পর্কে কিছুই বলছে না, একে শর্ত করছে না। তারা দুর্নীতি বন্ধে জোরালো কোনো সুপারিশ করছে না। অতিধনীদের কর বৃদ্ধির কোনো কথা নেই। তারা সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান নিয়ে কোনো কথা বলছে না। আমাদের মিডিয়ার একাংশও এসব কথা ফলাও করে প্রকাশ করছে। বেশি করে বলছে ব্যাংক ব্যবস্থার কথা, খেলাপি ঋণের কথা, ব্যাংক লুটের কথা। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো খবরের কাগজে ব্যাংকের দুর্দশার কথা থাকছেই এবং তা যথাযথভাবেই। ব্যাংকে ব্যাংকে সমস্যা আছে, খেলাপি ঋণের সমস্যা তীব্র, ব্যাংকের টাকা লুট হচ্ছে—এসবই সত্যি কথা। এসবের ওপর আলোচনা হওয়া জরুরি এবং অবশ্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে আমার কোনো ভিন্ন বক্তব্য নেই। কিন্তু কথা আছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। মনে হয় না কী যে ব্যাংকের আলোচনায়, মার্জারের আলোচনায় এবং খেলাপি ঋণের আলোচনায় তলে পড়ে যাচ্ছে, কার্পেটের নিচে পড়ে যাচ্ছে বিশাল এক সমস্যা। কী এ সমস্যা? সমস্যাটি সরকারি ব্যয়ের গুণগত মানের সমস্যা। এ আইনগত মান নিশ্চিত করতে না পেরে সরকার বাজেটের কলেবর বছরের পর বছর বৃদ্ধিই করে যাচ্ছে। করারোপ হচ্ছে। অথচ রাজস্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে না। রাজস্ব বাজেট বাড়ে অথচ উন্নয়ন বাজেটের টাকা থাকে না। বাজেট ঘাটতি টাকার অংকে বাড়ছেই। দেশী-বিদেশী ঋণ বাড়ছেই। বাড়ছে সুদ পরিশোধের টাকা। ভালো কথা, এসব সমস্যা আলোচনার মধ্যে আছে। কিন্তু মূল অপরাধী (কালপ্রিট) বাজেটের গুণগত দিকের অভাব নিয়ে কোনো আলোচনা সেভাবে নেই। এবং বিস্ময়ের বিষয় আইএমএফও জোর দিয়ে এ কথা বলছে না। বলতে পারত তোমরা গুণগত দিকের উন্নতি করে বাজেটের আকার বাস্তবায়নযোগ্য করো। তোমরা অর্থ পাচার বিরোধী জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে বলো কী সাহায্য এক্ষেত্রে তোমরা চাও। আমরা তোমাদের পাচারকৃত টাকা উদ্ধারে সাহায্য করব। এসব না বলে বারবার এসে একই কথা বলার অর্থ কী? সারের দাম বাড়াও, বিদ্যুতের দাম বাড়াও, তেলের দাম বাড়াও, গ্যাসের দাম বাড়াও, বাড়াও ডলারের দাম। ঠিক আছে, কিন্তু পরমুহূর্তে তারা কী করে বলে যে মূল্যস্ফীতির হার কমাতে হবে। তারা কি জানে না আমরা আমদানিনির্ভর দেশ? তাদের সুপারিশ কার্যকর করলে যে মূল্যস্ফীতি বাড়বে—এটা কি তারা জানে না? জানার পরও এসব সুপারিশ করার উদ্দেশ্য কী? আর আমাদের এক শ্রেণীর অর্থনীতিবিদরাই-বা এসব সুপারিশ মানেন কী করে? তারা বলেন রাজস্ব বাড়াও। এসব বলে তো লাভ নেই। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাদের সুনির্দিষ্টভাবে বলা উচিত কোথায় কোথায় ট্যাক্স বসাতে হবে। জনগণের ভোগান্তি না বাড়িয়ে কী কী খাতে কর বসানো যায়। না, এসব আলোচনায় নেই। নেই রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটের অপচয়ের ওপর আলোচনা। যাকে আমরা বাংলা ভাষায় বলি ‘দুর্নীতি’, ‘ঘুস’, যা আমাদের সব খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে সে সম্পর্কে জোরালো বিতর্ক নেই কেন? কেন শুধু ব্যাংক ব্যাংক বলে অন্যান্য বড় বড় সমস্যা কার্পেটের তলে ফেলা হচ্ছে? মেগা প্রকল্পের অপচয় যে আমাদের ঋণ বাড়াচ্ছে, সুদের পরিমাণ বাড়াচ্ছে, বাজেটের ওপর চাপ তৈরি করছে সে সম্পর্কে কেন তারা কিছু বলছে না? যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলছেন প্রকল্প নিতে সাবধানী হতে। তাকে এক্ষেত্রে জোরালো সমর্থন কেন করা হচ্ছে না? ধরা যাক সঞ্চয়পত্রের কথা। আইএমএফের চাপে এ সঞ্চয়পত্র আজ বিলীন হতে চলেছে। বলা হয়েছিল সুদ ব্যয় বেশি, ব্যাংকের আমানতের ওপর সুদ কম। সরকার কেন বেশি সুদ দিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করবে? এখন কী অবস্থা? এখন সরকার কত শতাংশ সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়? এখন ব্যাংক কত শতাংশ সুদে আমানত নেয়? এখন যে সঞ্চয়পত্র গ্রাহকদের ঠকানো হচ্ছে তা বলা হচ্ছে না কেন? কেন মিডিয়ার একাংশ, আইএমএফ এসব কথা বলছে না? আইএমএফ কেন প্রশ্ন করবে না যে তোমরা কেন ১০০ টাকার পর্দা ১০০০ টাকায় কিনছো? কেন তারা এটাও জিজ্ঞেস করেনা, ১ টাকার কাজে ৩ টাকা লাগছে কেন? এসব তোমাদের বন্ধ করতে হবে। এসব বন্ধ হলেই তো সারের ওপর থেকে, গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি কমাতে হয় না। দুর্নীতি, অপচয়, ঘুস, অনিয়ম রোধ করতে পারলে বাজেটের ঘাটতি অনেক কমে আসে। কেন আইএমএফ এসব কথা জিজ্ঞেস করছে না? দেখা যাচ্ছে, তারা বাজার অর্থনীতির কথা বলে বাজারকে উসকে দিতেই উদ্যত। সিন্ডিকেটের অত্যাচার থেকে বাঁচানোর কথা আইএমএফ কেন বলছে না এসবের কোনো কারণ আমার জানা নেই। সেজন্যই শুধু প্রশ্ন করে যাচ্ছি।

এবার আইএমএফ এবং এ দেশীয় তাদের বন্ধুদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি তথ্য নিচে পেশ করছি। তথ্যগুলো ব্যাংক ও সরকারি খরচ সম্পর্কিত। আমরা জানি, এ মুহূর্তে (ফেব্রুয়ারি ২০২৪) আমাদের ব্যাংকগুলোয় মোট আমানত ১৬ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। নিশ্চিতভাবেই ঋণের পরিমাণ এর চেয়ে কিছু কম হবে। যদি ১৬ লাখ কোটি  টাকার ঋণের পরিমাণ ধরে নিই, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত? ১০ শতাংশ ধরে হিসাব করলে হবে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। লোকে তা বিশ্বাস করে না। অতএব, ধরে নিই ২০ শতাংশ। তাহলে হবে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। বিশাল অংকের টাকা। জনগণের টাকা। মনে রাখতে হবে এ খেলাপি ঋণ হয়েছে ৫০-৫২ বছর ব্যাংকিং করার পর। আরো মনে রাখতে হবে প্রতিটি খেলাপি ঋণের বিপরীতে একটি করে মামলা আছে। কিছু না কিছু টাকা মামলায় আদায় হবে। এসব খেলাপি ঋণজনিত কারণে বহু ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিনিয়র ব্যাংকার, ব্যাংক কর্মকর্তার সাজা-বিচার হয়েছে। অনেকের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, পাওনা টাকা আটকা আছে। এছাড়া এটাও সত্যি কথা মোটামুটিভাবে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো তাদের প্রফিট থেকে প্রভিশন (সংরক্ষণ) রেখেছে। হয়তো কোথাও বেশি, কোথাও কম। বেশকিছু পরিমাণ প্রভিশন ঘাটতিও আছে। তবু বেশকিছু টাকা প্রভিশন হিসেবে রক্ষিত আছে, যা দিয়ে ব্যাংক তার লোকসান পুষিয়ে নেবে। তবে কথা একটা—এসব খেলাপি ঋণের সুবিধাভোগী এক শ্রেণীর দুষ্টু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা, প্রভাবশালী লোকজন। ছোট ছোট, মাঝারি ঋণখেলাপিও আছে। বড়রাও আছে। এটা হচ্ছে বাস্তব অবস্থা। এর বিপরীতে যদি আমরা রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটের টাকা চুরির হিসাব করি, অপচয়ের হিসাব করি, গুণগত মানের বিচার করি তাহলে ৫০-৫২ বছরে এ খাতে কত টাকা হতে পারে বলে অনুমান। অনুমান করাও কঠিন। তবু একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। 

ধরা যাক, উন্নয়ন বাজেটের কথা। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৭ বছরে সংশোধিত উন্নয়ন বাজেটের খাতে মোট ব্যয় হয়েছে কম করে হলেও ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। বিশাল টাকা। এ টাকার মধ্যে কত টাকা সত্যি সত্যি খরচ হয়েছে? নানাজনের নানা মত এখানে। তবে পুরো উন্নয়ন প্রকল্প এবং তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যে দুর্নীতিগ্রস্ত, এতে যে ‘গুচ্ছ দুর্নীতি’ হয় তা সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী অনেকবার বলেছেন। প্রকল্প শেষ না করে যে টাকা তুলে নেয়া হয় এ কথা বলেছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীও। সাবেক শিল্পপ্রতিমন্ত্রীও তার ইন্টারভিউতে একই বলেছেন। দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছিলেন (৩০.১.১৯) ‘দুর্নীতির এ মহাসমুদ্রে কাকে ধরব’। এমনকি দুর্নীতির চিত্র দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন (৩.৭.২০১৭), সম্পদের সচিবদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন: ‘বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে, এবার দুর্নীতি অপচয় বন্ধ করতে হবে’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর ওয়াশিংটনের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘প্রকল্প প্রস্তুতি থেকে শুরু করে প্রকল্পের কাজ পাওয়ার জন্য অর্থ বিতরণের সুযোগ নিয়ে কিছু লোক বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছেন’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যর পর আর কিছু থাকে না। বাকি থাকে শুধু চুরির অংকটি। যদি ধরে নিই উন্নয়ন বাজেটের ২০ শতাংশ লুট হয়েছে, তাহলে তা কত টাকা হয়? ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর সঙ্গে রাজস্ব বাজেটের অপচয় চুরি-দুর্নীতি হিসাব করি তাতে কত হয়? উন্নয়ন ও রাজস্ব বাজেটের ৫০ বছরের হিসাব জোগাড় করতে পারিনি। তবে ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২৪ পর্যন্ত মোট বাজেট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩২ লাখ ২১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ শতাংশ টাকাও যদি হিসাবে ধরি তাহলে কত টাকা হয়? বিশাল টাকা নয় কি? আমার প্রশ্ন এখানেই। ব্যাংকের দুর্নীতির টাকা নিয়ে যদি আমরা বিশদ আলোচনা করতে পারি, আতঙ্কগ্রস্ত হতে পারি। তাহলে বাজেটের অপচয়, চুরি, দুর্নীতি নিয়ে কথা বলব না কেন? কেন আমরা বাজেটের গুণগত দিক নিয়ে সোচ্চার হব না? বলাই বাহুল্য, বাজেট চুরির টাকা খেলাপি ঋণের চেয়ে অনেক বেশি।

ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন