গভর্নরের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের বৈঠক

সুদহার ১৪ শতাংশের আশপাশে থাকার প্রত্যাশা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

গত সপ্তাহে ব্যাংক ঋণের সুদহার শতভাগ বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের অনেক ব্যাংকেই ঋণের সুদ উঠেছে ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও বর্তমান কস্ট অব ফান্ড বিবেচনায় ঋণের সুদহার ১৪ শতাংশ ছাড়াবে না বলে প্রত্যাশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

ঋণের সুদহার, ডলারের বিনিময় হারসহ দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখানেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়। এতে ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব দেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম। বৈঠকে গভর্নর ছাড়াও চার ডেপুটি গভর্নর ও বিভিন্ন বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

বৈঠকে বিনিময় হার নিয়ে আলোচনার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ডলারের বিনিময় হার ১১৭ টাকার আশপাশে থাকবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চলমান সংকট কেটে যাবে। 

এ সময় কোনো ব্যাংক ঘোষিত বিনিময় হারের চেয়ে বেশি দরে ডলার বিক্রি করলে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানোর পরামর্শও দেয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।

বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক কভিডের সময় নানা নীতিমালা গ্রহণ করে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এখন বিপরীতমুখী আচরণ করছে। ডলারের বিনিময় হার ও ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী লোকসানের মুখে পড়েছেন। এরই মধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরো অনেক কারখানা বন্ধের অপেক্ষায় আছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসবে। এতে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণও অস্বাভাবিক হরে বেড়ে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়ছে। 

এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন না করে আলোচনার ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়নের পরামর্শ দেন। আর ডলারের বিনিময় হারজনিত লোকসানকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তরেরও দাবি জানান তারা।

সভা শেষে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘ঋণের সুদহার, ডলারের দরসহ দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডলারের দাম ১১৭ টাকার মধ্যে থাকবে। ব্যাংকভেদে এক টাকা কম-বেশি হতে পারে। সব ব্যবসায়ী যেন একই দরে ডলার পান, আমরা সেটি নিশ্চিত করতে বলেছি। এখনো ডলারের কিছু সমস্যা আছে, তবে আগের চেয়ে সমস্যা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সংকট কেটে যাবে।’

মাহবুবুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে সুদহার নির্ধারণের দায়িত্ব বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে সুদহার ১৪ শতাংশের ওপরে উঠবে না বলে তারা আশাবাদী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ১ শতাংশ কমবেশি হতে পারে। এসএমই খাতের ওপর অতিরিক্ত ১ শতাংশ মাশুল প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। আমরা বলেছি, বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার নীতি পরিবর্তন করায় ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছে। সামনে এভাবে বারবার নীতি পরিবর্তন হবে না বলে আমাদের জানানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে নীতি নিলে ভালো হয়, এটা আমরা গভর্নরকে জানিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে অনেক ব্যবসায়ী ১০০ কোটি টাকা, কেউ আবার ৪০০-৫০০ কোটি টাকার লোকসানে পড়েছেন। এসব হিসাব ব্যাংকগুলোর কাছে আছে। আমরা এ লোকসানের অর্থ দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তর করে পুনঃতফসিল করে দেয়ার জন্য বলেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক এতে রাজি হয়েছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘কোনো সৎ ব্যবসায়ী অর্থ পাচার করতে পারেন না। আমরা অসৎ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নেই।’

নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ডলারের অভাবে আমরা এলসি খুলতে পারছি না। রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) কমিয়ে তিন বিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়েছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিকল্প একটি তহবিল ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।’

ব্যবসায়ীরা এখন ১১৭ টাকায় এলসি খুলতে পারছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বেশি টাকা নেয়া হলে তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে বলে আশ্বস্ত করেছে।’

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ডলারের ঘোষিত দর এতদিন ১১০ টাকা থাকলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে তা অনেক বেশি ছিল। এখন তা ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডলারের বিনিময় হার যেন হঠাৎ করে না বাড়ে, তা নিশ্চিত করা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘সুদহার ও ডলারের দামের কারণে খেলাপি ঋণ বাড়বে। ডলারের দামের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তরের জন্য রোডম্যাপ প্রণয়ন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে ব্যবসা থেকে প্রস্থান করার কোনো নীতি নেই, এমন নীতিমালা করা দরকার।’

বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি আমীন হেলালী, বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সিইও আহসান খান চৌধুরী, সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. হাসানসহ ব্যবসায়ী নেতা ও কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণপ্রাপ্তির শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে ৮ মে ব্যাংক ঋণের সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। যদিও এর আগেই চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ঋণের সুদহার বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ওই সময় ঋণের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে নেয়া হয়। ঋণের সুদহার নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। কিছুটা নিয়ন্ত্রিত এ পদ্ধতি চালুর পরও মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ৯ থেকে বেড়ে ঋণের সুদহার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পর গত এক সপ্তাহে অনেক ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৫ শতাংশেও তুলে নিয়েছে। 

ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পাশাপাশি একই দিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে একদিনের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে মার্কিন ডলারের মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয় ১১৭ টাকা। যদিও ওইদিনের শুরুতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার সর্বোচ্চ ১১০ টাকা নির্ধারিত ছিল। সে হিসাবে একদিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের বিনিময় হার ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলো চাইলে এর চেয়ে বেশি কিংবা কম দামেও ডলার বেচাকেনা করতে পারবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়। ডলারের বর্তমান ঘোষিত দর আমলে নিলে দুই বছরের ব্যবধানে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন