বিপুল বিনিয়োগের পর রেলওয়ে এখন সেবা সংকোচনের পথে হাঁটছে

সুজিত সাহা I চট্টগ্রাম ব্যুরো

ফাইল ছবি

এক দশক ধরে বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিনিয়োগ হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। সারা দেশকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে নতুন নতুন রেলপথ নির্মাণ, ট্র্যাক সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু সেবা বৃদ্ধির পরিবর্তে এখন সংকোচনের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে একটি চলমান সেবা বন্ধের পাশাপাশি আরো বেশকিছু ট্রেন বন্ধের চিন্তাভাবনা করছে রেলওয়ে।

নতুন রেললাইন নির্মাণ, সংস্কার ও সেবা বাড়ানোর পরিকল্পনার পরও রেলের পিছিয়ে পড়ার চিত্র উঠে আসে বেশকিছু পদক্ষেপে। ২০১১ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও এক দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথের অন্যতম প্রতিবন্ধক ‘কালুরঘাট’ রেল সেতু পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ যথাসময়ে নেয়নি রেলওয়ে। পূর্বাঞ্চলের সাতটি সেতুতে ভারী ইঞ্জিন চলাচলের সুযোগ না থাকলেও সেতু সংস্কার বা নির্মাণ না করে আমদানি করায় ইঞ্জিনের ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প বিবেচনায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট তড়িঘড়ি করে ৫০ কোটি টাকায় সংস্কার করা হয়। তবে ভৈরব পুরাতন, কুশিয়ারা, ঘোড়াশাল (আপ), শম্ভুগঞ্জ, ঘুমঘাট ও ছাতক-সিলেট রুটের ২৮ নম্বর সেতু দিয়ে ভারী ইঞ্জিন চলাচল করতে পারে না। মেরামত সম্পন্ন করতে না পারায় প্রতি ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার গতি দিয়ে এসব ভারী ইঞ্জিন চালানো হয়।

প্রতি বছর নতুন রেলপথ নির্মাণের উদ্বোধন ও ট্রেন সেবা শুরু করলেও চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন আমদানি করেনি। সংকটের মধ্যেও যথাসময়ে জনবল নিয়োগ না দেয়া, সাধারণ ও অত্যাবশ্যকীয় কর্মীদের পদোন্নতি টানা কয়েক বছর ধরে বন্ধ রাখায় দফায় দফায় ট্রেন সেবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে রেলওয়ে। উদ্বোধনের পর দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে প্রতিদিন ২০-২২ জোড়া ট্রেনের পরিকল্পনা থাকলেও মাত্র দুটি ট্রেন চলছে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার। ২৯ মে পর্যন্ত চলাচল করা কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনকে শিডিউল বর্ধিত করে স্থায়ীকরণের প্রস্তাব দেয়া হলেও সেটি বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া চট্টলা ও হাওর এক্সপ্রেসের অবমুক্ত রেক দিয়ে (পিএইচটি টাইপ কোচ) ১৭/৩৪ কম্পোজিশনে ৮১০টি আসন সংবলিত একটি আন্তঃনগর ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করা হলেও সেটি বাস্তবায়ন করেনি রেলওয়ে।

রেলের পরিবহন বিভাগ ও ওয়ার্কিং টাইম টেবিলের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে কভিড-১৯ কালীন বন্ধের পর অন্তত ১০৫টি মেইল, এক্সপ্রেস, কমিউটার জাতীয় দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেন বন্ধ (উভয় অঞ্চল) করে দেয় রেলওয়ে। শুধু পূর্বাঞ্চলে ৫৬টি ট্রেন আজও চালু করেনি। এরপর সাময়িকভাবে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৩০টি ইঞ্জিন আমদানি হলেও কয়েক বছরের মধ্যে এসব ইঞ্জিনের অধিকাংশই এখন অকেজো হয়ে বসে আছে। এছাড়া আটটি নতুন আমদানি করা ৩০০০ সিরিজের আটটি ইঞ্জিন দীর্ঘদিন ধরে চারটির পরিবর্তে দুটি মোটরে চলাচল করছে। যার কারণে এসব ইঞ্জিনের গতি কমে নেমে এসেছে প্রতি ঘণ্টায় ২০-৩০ কিলোমিটারের মধ্যে। ফলে নতুন আমদানি ইঞ্জিনগুলো ব্যবহার না হওয়ায় যাত্রীবাহী ট্রেনের খর্বিত শিডিউল চালু রাখতে হিমশিম খাচ্ছে রেলের পরিবহন বিভাগ।

বিপুল বিনিয়োগের পরও রেল সেবা সংকোচনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রেলের ইঞ্জিনগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো। ৩০-৪০টি ছাড়া সব ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। সময়মতো ও যথাসময়ে নতুন করে ইঞ্জিন আমদানি হয়নি। সর্বশেষ আমদানি হওয়া ২০-৩০টি ইঞ্জিনসহ অধিকাংশ পুরনো ইঞ্জিনের ওপর নির্ভর করে সেবা পরিচালনা করতে হচ্ছে আমাদের।’

রেলের সেবা কমানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কভিড-১৯ সময়ে কিছু অপ্রচলিত ও অজনপ্রিয় ট্রেনের সেবা কমানো হলেও এখন কোনো ট্রেনের সেবা কমানোর পরিকল্পনা নেই। কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনটি রেলের রেগুলার শিডিউলে অন্তর্ভুক্ত নয়। ঈদের আগে যাত্রীচাপের সময় বাড়তি সুবিধা ও সেবা দিতে হলে পুরনো ইঞ্জিন ও কোচগুলো ওভারহোলিং, মেরামতসহ নানা কাজ সম্পন্ন করতে হয়। এজন্য কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনটি আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। আগামী ঈদুল ফিতরের সময়ে স্পেশাল ট্রেন হিসেবে এটি আবার যাত্রী পরিবহন করবে।’

রেলের তথ্যমতে, পূর্বাঞ্চল রেলে প্রতিদিন ইঞ্জিনের চাহিদা ১১৬টি। প্রকৌশল বিভাগ প্রতিদিন ১০০ (কম বেশি) ইঞ্জিন সরবরাহ করেছে বা করতে পারবে বলে জানালেও প্রকৃতপক্ষে ইঞ্জিন পাওয়া যায় ৮৫টি। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন রেলপথে বুড়িমারী এক্সপ্রেস, ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে দুটি নতুন ট্রেন সেবা চালুর পর অন্তত পাঁচটি ইঞ্জিন প্রতিদিন এ তিন ট্রেনের জন্য বরাদ্দ দিতে হয়। তাছাড়া কয়েক মাস আগের দুর্ঘটনায় চারটি ইঞ্জিন কার্যত অকেজো হয়ে গেছে। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ইঞ্জিনের মধ্যে ৩০০০ সিরিজের দুটি ইঞ্জিন আগামী এক বছরের মধ্যে মেরামতের আশা থাকলেও বাকি দুটি ইঞ্জিন (২৯০০ ও ২৬০০ সিরিজের ইঞ্জিন) মেরামতের অযোগ্য বলে জানিয়েছে যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগ। সব মিলিয়ে নতুন ট্রেনের জন্য পাঁচটি ইঞ্জিন ও দুর্ঘটনায় চারটি ইঞ্জিনের এ ঘাটতি রেলওয়ের স্বাভাবিক ট্রেন অপারেশন কার্যক্রম চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এজন্য আরো কয়েকটি ট্রেন বন্ধ করা যাবে কিনা সে বিষয়ে শিগগিরই বৈঠকে বসবে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওপিএস) মো. শহিদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা চরম ইঞ্জিন সংকটে ভুগছি। প্রায় এক দশক আগে ৭০টি ইঞ্জিন ক্রয়ের একটি প্রকল্প দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর বাতিল হয়ে যাওয়ায় রেলওয়ের স্বাভাবিক শিডিউল চালু রাখতে সমস্যা হচ্ছে।’

বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, নতুন ট্রেন চালানোর মতো কোনো অবস্থা রেলের নেই। এর পরও নতুন রেলপথ উদ্বোধনের পর প্রকল্প ব্যয়কে জাস্টিফাই করার জন্য অন্তত একটি বা দুটি ট্রেন সেবা চালানো হচ্ছে। মূলত পণ্যবাহী ট্রেনের জন্য বরাদ্দ ইঞ্জিন সরিয়ে (চাহিদা ১৬টি হলেও পণ্যবাহী ট্রেনে দেয়া হয় ১০-১২টি) নতুন ট্রেন চালানো হচ্ছে। যার কারণে বর্তমানে পণ্য পরিবহনে ইঞ্জিনের সংখ্যা নেমে এসেছে ছয়-সাতটিতে। আন্তঃনগর ট্রেনের মতো সেবাও মারাত্মক শিডিউল বিপর্যয়ের কবলে পড়ছে প্রতিদিন। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন