১০০ বিলিয়ন ডলারের কোনো নীতিচাপ নেই, ৫ বিলিয়ন ডলার এখন খুবই প্রতাপশালী

৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম ঋণ পেয়ে আইএমএফের সব কথা শুনছে সরকার, অথচ গত পাঁচ অর্থবছরে শত বিলিয়ন ডলারের জোগানদাতা প্রবাসীদের কোনো মূল্য নেই

হাছান আদনান

ছবি : বণিক বার্তা

বৈদেশিক মুদ্রার চাপ সামলাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি বা ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া এ ঋণ প্রকল্পের শেষ কিস্তি ছাড় হবে ২০২৬ সালে। সাত কিস্তিতে ছাড় হওয়া এ ঋণ পেতে বহুজাতিক সংস্থাটির এক ডজনেরও বেশি শর্ত মেনে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করা, ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া, টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন, আর্থিক খাত সংস্কার, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি, বাজেটের কাঠামোগত পরিবর্তনের মতো কঠিন শর্তও রয়েছে। 

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা আইএমএফের ঋণ প্যাকেজের মোট অর্থের কয়েক গুণ। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের জুন থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ বছরেরও কম সময়ে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন প্রায় ১০৫ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স হিসাবে পাঠানো প্রবাসীদের এ অর্থে টিকে আছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু সরকারের নীতি প্রণয়নে এত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জোগানদাতা প্রবাসীদের কোনো ভূমিকা নেই। নিজেদের ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও প্রবাসীরা ভুক্তভোগী হচ্ছেন পদে পদে অব্যবস্থাপনা, ঘুস, অনিয়ম-দুর্নীতির। এবার আইএমএফের পরামর্শে রেমিট্যান্সের ওপর কর আরোপের চিন্তাও করছে সরকার।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে। এক বছর রেমিট্যান্স বন্ধ থাকলে মারাত্মক বিপদে পড়বে দেশের অর্থনীতি। এমন অবদান সত্ত্বেও প্রবাসীরা প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা পাচ্ছেন না। উল্টো রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রবাসীরা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দেশের বাইরে থাকার কারণে প্রবাসীরা ভোটাধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। 

এক বছর রেমিট্যান্স আসা বন্ধ থাকলে বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতিই ধসে যাবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অনেকেই প্রশ্ন করেন, এত পরিমাণ অনিয়ম, দুর্নীতি, অপচয় সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে কীভাবে? আমি বলি, কেবল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণেই এদেশের অর্থনীতি এখনো টিকে আছে। যেকোনো আয়ের জন্য বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু রেমিট্যান্সই হলো একমাত্র আয়, যার জন্য দেশের কোনো বিনিয়োগ নেই। বরং এ বাংলাদেশীরা যদি অভিবাসী না হতো, তাহলে বেকারত্বের চাপে অর্থনীতি ও শ্রমশক্তির অবস্থা ভয়াবহ হতো। ভারত ছাড়া বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে দেশের মানুষ পৃথিবীর সব প্রান্তে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে ব্যবসা করে সফল হচ্ছে। তার মানে, একটু সুশাসন আর সুযোগ পেলে বাংলাদেশীরা যেকোনো ক্ষেত্রেই সফল হওয়ার সামর্থ্য রাখে।’

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘দেশের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সংগঠন আছে। কেবল প্রবাসীদের অধিকার আদায়ে এ ধরনের কোনো সংগঠনের কথা শুনিনি। প্রবাসীরা যদি একত্রিত হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন হয়, তাহলেই দেশের সরকার আইএমএফ বা অন্য যেকোনো শক্তির চেয়ে প্রবাসীদের বেশি গুরুত্ব দেবে। এখন শুনছি, রেমিট্যান্সের ওপর সরকার কর আরোপ করবে। এটি কীভাবে সম্ভব আমার বুঝে আসছে না। প্রবাসীদের কর্মক্ষেত্র বাংলাদেশ সরকারের এখতিয়ারের বাইরে।’

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত দেড় কোটির বেশি বাংলাদেশী অভিবাসী হয়েছেন। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। এ মুহূর্তে ঠিক কত পরিমাণ শ্রমিক বিদেশে আছেন, সরকারের সংস্থাগুলোর কাছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ধারণা করা হয়, বর্তমানে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে শুধু ২০২৩ সালেই ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন বাংলাদেশী জীবিকার সন্ধানে অভিবাসী হয়েছেন। এর আগে ২০২২ সালে অভিবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন। অর্থাৎ গত দুই বছরে ২৪ লাখের বেশি বাংলাদেশী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গেছেন। চলতি বছরের হিসাব আমলে নিলে এ সংখ্যা ৩০ লাখে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১ হাজার ৯১৮ কোটি বা ১৯ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ছিল ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ও ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ শুধু ২০১৯ সালের জুন থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ বছরেরও কম সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১০৪ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) যুক্ত হয়। গত তিন বছর ধরেই বিওপি নিয়ে বিপদে আছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত বিওপির ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় পর্যন্ত এ ঘাটতি ৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। বিওপির এ ঘাটতির কারণেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে। ২০২১ সালের আগস্টে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারের গ্রস রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।

বৈদেশিক বাণিজ্যে সংকটের কারণেই আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছিল বাংলাদেশ। এ ঋণ নিয়ে দেনদরবার শুরু হয় ২০২২ সালে। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি সংস্থাটির নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার সংস্থাটির পর্ষদে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

আইএমএফের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম ঋণ পেতে ডজনের বেশি শর্ত মেনে নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার মতো কঠোর পদক্ষেপও রয়েছে। সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ থেকে ঋণের সুদহার এখন ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। আর ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার অংশ হিসেবে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতির বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে গত ৮ মে এক দিনের ব্যবধানে টাকার ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা থেকে বেড়ে ১১৭ টাকা ছাড়ায়। সরকারকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বন্ধের শর্তও জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ। এ শর্ত বাস্তবায়ন করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আইএমএফের পক্ষ থেকে রেমিট্যান্স, ইএমএফ সরকারি সিকিউরিটিজ, মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট, পাবলিকলি লিস্টেড সিকিউরিটিজ, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি, বাতিল বা কমিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানিয়েছে।

৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম ঋণ প্রাপ্তির বিপরীতে আইএমএফের সব শর্ত মেনে নিচ্ছে সরকার। অথচ প্রতি বছর প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার জোগান দিয়েও প্রবাসীরা সরকারের নীতি প্রণয়নে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। অভিবাসনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে পাঁচ-ছয় গুণ বেশি খরচ হচ্ছে। এত অর্থ ব্যয় করেও সেখানে অনেক বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে দেশের খাতসংশ্লিষ্টদের তেমন একটা উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। আবার অনেকেই অবৈধ অভিবাসনের মাধ্যমে মানব পাচারের শিকার হয়ে যাচ্ছেন মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। মালয়েশিয়া সরকার সে দেশে মানব পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে কিছু হলেও ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা সেভাবে দৃশ্যমান নয়। আবার মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানোর সঙ্গে প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেট জড়িত বলেও বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অননুমোদিত-অবৈধ পন্থায় অন্যান্য দেশেও অভিবাসন নিচ্ছেন অনেকে। বিপৎসংকুল পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অবৈধভাবে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের উৎস দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন শীর্ষে। এ পথে ইউরোপে অভিবাসন নিতে গিয়ে প্রতি বছর অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। 

অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার মনে করেন, প্রবাসীদের কণ্ঠ খুবই দুর্বল। তাদের পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলার মতো শক্তিশালী কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এ কারণে সব ক্ষেত্রেই প্রবাসীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

সি আর আবরার বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো রেমিট্যান্স। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের সময় রেমিট্যান্সের গুরুত্ব আরো বেশি করে ফুটে উঠেছে। সরকারের দায়িত্ব হবে রেমিট্যান্সকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনায় নেয়া। একই সঙ্গে প্রবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করা। পাসপোর্ট ইস্যু, ভিসা প্রক্রিয়া, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে বিরাজমান অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রবাসীরা সরকারের আন্তরিকতা ও সেবায় সন্তুষ্ট হলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহ বোধ করবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন