ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির তথ্য

দুবাইয়ের আবাসন খাতে প্রপার্টি কিনেছেন ৫৩২ বাংলাদেশী

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) শহর দুবাইয়ের আবাসন খাতসহ প্রপার্টির বাজার। অনুকূল করনীতি ও উদারীকৃত বাজারনীতিসহ বিভিন্ন সুবিধা কাজে লাগিয়ে এ বাজারের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। দুবাইয়ের প্রপার্টি বাজারে বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশীদেরও। ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির (ইইউট্যাক্স) গতকাল প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দুবাইয়ের আবাসন খাতে ৫৩২ বাংলাদেশীর প্রপার্টি মালিকানার (অফ-প্ল্যান অর্থাৎ উন্নয়ন বা নির্মাণ শেষের আগেই কিনে নেয়া প্রপার্টির মালিকানাসহ) হিসাব পাওয়া গেছে। এর আগে ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫৬২। 

দুবাইয়ের স্থানীয় ভূমি কর্তৃপক্ষের তথ্য সংগ্রহের ভিত্তিতে নিয়মিতভাবে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (সি৪এডিএস)। আবার সেখানে অর্থ পাচারের মাধ্যমে গড়ে তোলা গোপন সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন উৎসে পাওয়া তথ্য ফাঁস হচ্ছে নিয়মিতভাবেই। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সহায়তায় এসব তথ্য যাচাই-বাছাই, সি৪এডিএস, অন্যান্য গবেষণা সংস্থাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ‘ফরেন ইনভেস্টমেন্টস ইন দুবাই হাউজিং মার্কেট ২০২০-২৪’ শীর্ষক এক গবেষণা নোট প্রকাশ করেছে ইইউট্যাক্স। চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এ নোটে দ্বৈত গণনা এড়াতে বিদেশী মালিকানাধীন প্রপার্টির তালিকায় জমির তথ্য বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ইইউট্যাক্সের পরিসংখ্যানে দুবাইয়ে ২০২০ সালে ৪৬০ বাংলাদেশী প্রপার্টি মালিকের তথ্য পাওয়া যায়। অফ-প্ল্যান প্রপার্টিকে বিবেচনায় নিলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬২-তে। শহরটিতে ২০২২ সালে বাংলাদেশী প্রপার্টি মালিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২৮-এ। অফ-প্ল্যান প্রপার্টিকে হিসাবে নিলে সংখ্যা ৫৩২। 

সংস্থাটিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যমতে, দুবাইয়ে বিদেশী প্রপার্টি মালিকের সংখ্যা ইইউট্যাক্সের তথ্যে উঠে আসার সংখ্যার চেয়ে আরো অনেক বেশি হতে পারে। নানা পন্থায় গোপনীয়তা অবলম্বন ও স্থানীয় পর্যায়ের নীতি সুবিধা কাজে লাগিয়ে আরো অনেকেই তথ্য গোপন করে থাকতে পারেন। 

এর আগে ২০২২ সালে ‘হু ওউনস অফশোর রিয়েল এস্টেট? এভিডেন্স ফ্রম দুবাই’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ইইউট্যাক্স। সেখানেও ২০২০ সালের পরিসংখ্যান সংযুক্ত করা হয়। সর্বশেষ প্রকাশিত নোটের সঙ্গে ওই প্রতিবেদনের পরিসংখ্যানের ভিন্নতার কথা উল্লেখ করে ইইউট্যাক্স জানিয়েছে, নতুন প্রতিবেদনটিতে নতুন উৎসের তথ্য ব্যবহারের পাশাপাশি পরিসংখ্যান পদ্ধতিরও উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। এছাড়া নতুন গবেষণা নোটটি শুধু আবাসন খাতের ওপরেই কেন্দ্রীভূত। 

উল্লেখ্য, ইইউট্যাক্সের ২০২২ সালের ওই প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে বণিক বার্তায় ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি ‘দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশীর হাজার প্রপার্টি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ৪৫৯ বাংলাদেশী। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। তবে প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পত্তি কিনতে ক্রেতাদের ব্যয়ের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতে পারে।’

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দুবাইয়ের আবাসন খাতে বাংলাদেশী মালিকানাধীন প্রপার্টির মূল্য ২৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অফ-প্ল্যান প্রপার্টিসহ এ সম্পদমূল্য দাঁড়ায় ৩৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলারে। 

বিদেশী নাগরিকদের বসবাস ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই ‘খোলা দুয়ার’ নীতি অবলম্বন করছে দুবাই। অনকূল করনীতি, ফ্রি ট্রেড জোনগুলোর নামমাত্র নিয়ন্ত্রণ, উদারীকৃত প্রপার্টি বাজার, স্বল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতির সুবিধাসহ নানা সুযোগ-সুবিধার বদৌলতে দেশটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ক্রমেই বাড়ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ বিদেশী শ্রমিকের চাহিদা দুবাইকে করে তুলেছে অভিবাসীদের স্বর্গরাজ্য। বর্তমানে দুবাইয়ের মোট ৩০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে স্থানীয় আছে মাত্র ৮ শতাংশ। 

এর সঙ্গে সঙ্গে দুবাই তথা সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এখন আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানেরও বড় হাব হয়ে উঠেছে। দুবাইকেন্দ্রিক আর্থিক ও বাণিজ্যিক অপরাধও এখন বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক ও আর্থিক অপরাধ দমন কর্তৃপক্ষগুলোর বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ, আর্থিকসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের দুবাইয়ে নানা পন্থায় অর্থ পাচার ও সেখানকার বহুমূল্য প্রপার্টির বাজারে বিনিয়োগের তথ্যও উঠে এসেছে বারবার। বিভিন্ন দেশের আর্থিক খাতের অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচারবিরোধী মান নির্ণয় সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স এরই মধ্যে ইউএইকে উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং ব্ল্যাকলিস্টেও নাম রয়েছে দেশটির। ইইউট্যাক্সের ভাষ্যমতে, দুবাইয়ের আবাসন বাজার এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাচারকৃত মুদ্রার গন্তব্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা খাতগুলোর অন্যতম।

দুবাইয়ের আবাসন খাতে বাংলাদেশী মালিকানাধীন সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগেও দুবাইয়ে বাংলাদেশী নাগরিকদের সম্পদ কেনার তথ্য প্রকাশ হয়েছে। এবার আরেকটু নির্দিষ্ট করে এসেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অন্য সব দেশ থেকেও অর্থ পাচারের একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য দুবাই। এ সুযোগ দুবাই সরকার খোলা রেখেছে। নামমাত্রা কিছু তথ্য ছাড়া সেখানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই বললেই চলে। আমাদের দেশের নাগরিকরাও সে সুযোগটা নিচ্ছে। আমাদের দেশের যেকোনো ব্যক্তি বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশে নিতে পারেন না। এখন যাদের সম্পত্তির তথ্য আছে, সরকার সদিচ্ছা নিয়ে তৎপর হলে অবশ্যই তাদের চিহ্নিত করে তালিকা করা সম্ভব। শুধু চিহ্নিত করা নয়, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনাও সম্ভব। সেটা জটিল প্রক্রিয়া হলেও সম্ভব। কিন্তু যারাই এ অর্থ পাচার করেছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে প্রভাবশালী। তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার একটা প্রবণতা রয়েছে। এ কারণেও সংকট আরো বেড়েছে।’ 

দুবাইয়ে প্রকাশ্যে বা গোপনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তর হচ্ছে কয়েক দশক ধরে। এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগে ফুলেফেঁপে উঠছে সেখানকার আর্থিক, ভূসম্পত্তি, আবাসনসহ বিভিন্ন খাত। বিত্তবান বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে গোল্ডেন ভিসা চালু করে ইউএই। এ সুযোগ লুফে নিয়ে দেশের ব্যাংক পরিচালক, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসা নিয়েছেন। দুবাইয়ের এ গোল্ড কার্ডধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সেখানে বিপুল অংকের পুঁজি পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ সংশ্লিষ্টদের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন