স্মার্ট কিচেনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যই আমরা তৈরি করি

ছবি : বণিক বার্তা

স্মার্ট কিচেন তৈরির অন্যতম সামগ্রী বিভিন্ন ধরনের বোর্ড। এক্ষেত্রে আপনারা বাংলাদেশের অন্যতম উৎপাদক। আকিজ বশির গ্রুপের বিভিন্ন ধরনের বোর্ড রান্নাঘরকে কতটা স্মার্ট করে তুলবে?

আমাদের আকিজ পার্টিক্যাল বোর্ড কারখানাটা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড়। আমরা এখানে প্রতিদিন ১০০০ মিটার কিউব পার্টিকেল বোর্ড, ৫০০ মিটার কিউব এমডিএফ বোর্ড উৎপাদন করি। এর পাশাপাশি আমাদের প্লাইউড আছে। আমাদের বোর্ডগুলোর মধ্যেও বৈচিত্র্য আছে। বেয়ার বোর্ডও আমরা বিক্রি করি। এটাকে মূলত বলা হয় প্লেইন পার্টিকেল বোর্ড। এছাড়া আমরা মেলামাইন ফেস বোর্ড বিক্রি করছি। এমডিএফকে আমরা মেলামাইন বোর্ড বা ইউভি বা হাইগ্লাস বোর্ড হিসেবেও তৈরি করি। ইউভি বোর্ডটাকে আমরা মূলত রান্নাঘরে ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করছি। আমাদের দেশীয় ডিজাইনাররা রান্নাঘরে অনেক ধরনের বোর্ড ব্যবহার করেন। তবে এইচপিএল বা অ্যাক্রেলিক বোর্ডের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে এইচপিএল বা অ্যাক্রেলিকের শিটটা উঠে যায় বা সাইডের দিকে একটু হলদে ভাব চলে আসে। ইউভি বা হাই গ্লাস বোর্ডে এ সমস্যা থাকে না। যদিও আমাদের কাছে অ্যাক্রেলিক, হাইগ্লাস ও এইচপিএল—এই তিন ধরনের বোর্ডই আছে এবং গ্রাহক তার প্রয়োজনমতো যেকোনো ধরনের বোর্ডই ব্যবহার করতে পারেন। তবে আমরা গ্রাহককে হাইগ্লাস বোর্ড ব্যবহারের পরামর্শ দিই। কারণ এর স্থায়িত্ব অন্যান্য বোর্ডের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে রান্নাঘরে বোধ হয় প্লাই বোর্ডটাই ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু রান্নাঘরের ক্ষেত্রে এমডিএফ বোর্ডের মধ্যে যদি অ্যাক্রেলিক, এইচপিএল অথবা ইউভি ব্যবহার করা যায় তাহলে মসৃণ সারফেস পাওয়া যায়। আমি বলব, আকিজ বশির গ্রুপের হাই ময়েশ্চার এমডিএফের হাইগ্লাস বোর্ড ব্যবহার করলে একটি রান্নাঘর অবশ্যই স্মার্ট কিচেনের অংশ হয়ে উঠবে।

স্মার্ট কিচেনের আরেক প্রাথমিক সামগ্রী টাইলস। কিচেনের জন্য আপনাদের বিশেষায়িত টাইলস নিয়ে জানতে চাই।

রান্নাঘরের মেঝে প্রায়ই পানি পড়ে ভিজে যায়। বিষয়টি মাথায় রেখে রান্নাঘরে পিচ্ছিল টাইলস ব্যবহার করা উচিত না। যেমন পলিশড টাইলস অল্প পানি পড়লেই পিচ্ছিল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে যিনি রান্নাঘরে কাজ করছেন, পিচ্ছিল টাইলসে পড়ে যেতে পারেন। তাই রান্নাঘরের মেঝের জন্য আমরা ম্যাট সারফেসের টাইলসেরই পরামর্শ দিই। সাইজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ৪০*৪০ বা ৩০*৩০ সাইজের টাইলস বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে রান্নাঘর বড় হলে ৩০*৬০ বা ৬০*৬০ বড় সাইজের টাইলসও ব্যবহার করা যেতে পারে। 

রান্নাঘরের দেয়ালের ক্ষেত্রে একেকজনের পছন্দ একেক রকম। আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত গ্রাহকদের পছন্দ ৩০*৫০ বা ৩০*৬০ সাইজের গ্লসি টাইলস। এখন অবশ্য বড় সাইজের টাইলসও আসছে। আর্কিটেক্ট বা ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা গ্লসি টাইলস থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে ম্যাট টাইলসের দিকে যাচ্ছেন। যত দিন যাচ্ছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে। 

কিচেনের টাইলসের ডিজাইন, ধরনের এখনকার ট্রেন্ড কেমন? 

আজকাল মানুষ ম্যাট টাইলসের দিকে ঝুঁকছে। ম্যাট টাইলসের সারফেসে অনেক ধরনের নকশা থাকে। লাপাতু টাইলস থাকে, কিছু খাঁজ থাকে, কিছু উডেন টেক্সচার থাকে, এমনকি ব্যাম্বো টেক্সচার থাকে। এ ধরনের ডিজাইনই এখন বেশি চলছে রান্নাঘরের জন্য। 

স্মার্ট কিচেনে গুরুত্বপূর্ণ ইউটিলিটি ফসেট। স্মার্ট ফসেটে কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত? রোসা এসব চাহিদা কতটা পূরণ করছে?

ফসেটের ক্ষেত্রে মানুষ শুরুতেই দুটো জিনিস দেখে। একটা হচ্ছে এর কার্যকারিতা ঠিকঠাক আছে কিনা, আরেকটি হলো নান্দনিকতা বা দেখতে জিনিসটা ঠিক কতটুকু সুন্দর তা। এতেও আবার দুটো বিষয় রয়েছে—প্রথমত, ফসেটের ডিজাইন কতটুকু সুন্দর এবং দ্বিতীয়ত, এর ফিনিশিং কতটা মসৃণ। আপনারা জানেন যে আকিজ বশির গ্রুপ প্রায় দুই বছর হলো রোসা ব্র্যান্ডের মাধ্যমে বাজারে ফসেট নিয়ে এসেছে। এ মুহূর্তে আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে পারি, বাংলাদেশে যত ফসেট প্রডাক্ট পাওয়া যায় তাতে গুণগত মান ও নান্দনিকতায় আমরাই সেরা। আমরা মনে করি যে রোসার ফসেট বিশ্বমানের যেকোনো ফসেটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। ফসেট উৎপাদনের লক্ষ্যে আমরা প্রায় দেড় শ কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানা তৈরি করেছি। ফসেটের উৎপাদনের জন্য ইলেকট্রোপ্লেটিং থেকে শুরু করে সব রকম আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে এ কারখানায়। ইলেকট্রোপ্লেটিং নিয়ে যদি বলি, বাংলাদেশে অটোমেটিক ইলেকট্রোপ্লেটিং আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। আমাদের টিবিডি মেশিন রয়েছে, যাতে আমরা কালারফুল প্রডাক্ট তৈরি করছি। কারণ এ ধরনের স্মার্ট প্রডাক্টগুলো গ্রাহকরা বেশি পছন্দ করেন। তাদের পছন্দ মাথায় রেখে আমরা বাটন, পুশ ফসেটের মতো স্মার্ট ফসেট উৎপাদন করে যাচ্ছি। 

সিরামিক শিল্প একটা সময় আমদানিনির্ভর ছিল। এখন ৯০ শতাংশই দেশে উৎপাদন হচ্ছে। এ খাতে আপনাদের যাত্রা সম্পর্কে জানতে চাই। 

আপনারা জানেন, বর্তমানে ৯০ শতাংশ সিরামিকসের উৎপাদন আমাদের দেশেই হচ্ছে। সিরামিক শিল্পে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালে। টানা পাঁচ বছর ধরে আকিজ সিরামিকস বাংলাদেশের সেরা ব্র্যান্ডের অ্যাওয়ার্ড পেয়ে যাচ্ছে। গত বছর আকিজ সিরামিকস সুপার ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। সিরামিক শিল্পে আমরা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উৎপাদক ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান। সিরামিক শিল্পে আমাদের প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশে যেন আর টাইলস আমদানি করতে না হয় এ লক্ষ্যে আমরা আমাদের পরিষেবাকেও সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এর অংশ হিসেবে বড় সাইজের যে টাইলসগুলো বাংলাদেশে আসে কিংবা মিনি স্ল্যাব বা স্ল্যাব সেগুলোও ২০২৫ সাল থেকে আমরা উৎপাদন শুরু করব বলে আশা করছি। আমরা মনে করি, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ টাইলসে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সামান্য হলেও টাইলস রফতানির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। কারণ চীন ও আমেরিকার ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে আমাদের হাতে টাইলস রফতানির একটা সুযোগ আসতে পারে। 

দেশের সিরামিক শিল্পে বর্তমানে চ্যালেঞ্জগুলো কী?

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন অক্সিজেন প্রয়োজন, তেমনি সিরামিক শিল্প টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রাকৃতিক গ্যাস। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুই-তিন বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ কারণে আমাদের অনেক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। সিরামিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে ১ মিনিটের জন্য গ্যাস চলে যাওয়াও অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সঠিক গুণমান ও পরিমাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তাই সিরামিক শিল্পের বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের অপ্রতুলতা। এটা শুধু আমাদের জন্য নয়, সবার জন্যই প্রযোজ্য। এ সমস্যা দূর করা গেলে আমাদের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে। আমরা যে ক্লে ম্যাটেরিয়ালগুলো নিয়ে আসি দেশের বাইরে থেকে সেখানে ৩২-৩৪ শতাংশ ময়েশ্চার থাকে। অর্থাৎ আমি যদি এক কেজি ক্লে ম্যাটেরিয়াল নিয়ে আসি তা থেকে আমি মূলত ৭০০ গ্রামের মতো ক্লে পাই। মানে আমি ১০০ শতাংশ ম্যাটেরিয়ালের ওপরে দিচ্ছি ডিউটি, অথচ যেখানে পাচ্ছি মূলত ৭০ শতাংশ ম্যাটেরিয়াল। এটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য। এ জিনিসটাকে সমন্বয় করা যায় কিনা সেজন্য আমরা প্রায়ই সরকারের কাছে আবেদন করে থাকি। 

সিরামিক শিল্পের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিকল্প কিছু আছে কি?

বিকল্পের চিন্তা আসলে করতেই হয়। কারণ যে একটা শিল্পে অর্থ বিনিয়োগ করে ফেলে তার তো আর বের হয়ে আসার উপায় থাকে না। আমরা চেষ্টা করছি বিকল্প জ্বালানি নিশ্চিত করার। যেমন এলপিজি করা যেতে পারে। সরকার এ মুহূর্তে ভোলা থেকে এলএনজি বা প্রাকৃতিক গ্যাসকে সিএনজিতে রূপান্তর করে আনার সুযোগ দিচ্ছে, আমরা সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা সোলার এনার্জি বসানোর চেষ্টা করছি, যাতে ৩৫-৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ সোলার থেকে ব্যবহার করতে পারি। আমরা আশা করছি, সিরামিক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারও ন্যূনতম গ্যাস সরবরাহ বজায় রাখবে। মূলত সবকিছুর সমন্বয় ঘটিয়েই সিরামিক শিল্পকে এখন টিকে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর শতভাগ নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। 

আপনারা আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তৈরি করছেন, রফতানি করছেন কি? বা এ নিয়ে পরিকল্পনা আছে কিনা।

সিরামিক শিল্পের তিনটি পণ্য আকিজ বশির গ্রুপ তৈরি করে—টাইলস, টেবিলওয়্যার ও স্যানিটারিওয়্যার। টেবিলওয়্যার উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই বেশ উন্নত। আমাদের দেশ অনেক আগে থেকেই ইউরোপের বাজারে টেবিলওয়্যার পাঠাচ্ছে। আকিজ বশির গ্রুপ থেকে আমরাও আমাদের মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ বিদেশে রফতানি করছি। আমরা আশা করছি এ হার দিন দিন আরো বাড়বে। স্যানিটারিওয়্যারের রফতানি আমাদের দেশে কখনই অতটা ভালো ছিল না। আমরাই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত আমরাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্যানিটারি পণ্য ইউরোপের বাজারে পাঠাচ্ছি। টাইলসের ক্ষেত্রে কার্যত তেমন কোনো রফতানি আমরা করতে পারিনি। তবে আগামীতে টাইলস রফতানির একটা সম্ভাবনা সম্প্রতি দেখা দিয়েছে। 

স্মার্ট কিচেনের জন্য ব্যবহৃত প্রায় সব পাওয়া যাচ্ছে আপনাদের কাছে। ইলেকট্রনিক খাতে প্রবেশ করার পরিকল্পনা আছে কি? 

ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে আকিজ বশির গ্রুপের নেই। তবে স্মার্ট কিচেনের জন্য প্রয়োজনীয় অধিকাংশ সামগ্রীই আমাদের আছে। কেবিনেটের জন্য সব ধরনের বোর্ড আমাদের আছে। আমাদের কিচেনহুড আছে, সিংক আছে, ফসেট আছে, টাইলস আছে। মোটামুটি সবই আছে। তবে ইলেকট্রনিক পণ্য নিয়ে আপাতত আমরা কোনো পরিকল্পনা করছি না। ভবিষ্যতে যে ভাবব না এমনটাও নয়। তবে এ মুহূর্তে তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। 

আকিজ বশির গ্রুপের নতুন কোনো পণ্য বাজারে আসছে কি?

শিগগিরই বাজারে আমরা গ্লাস নিয়ে আসছি। 

গ্রাহকের উদ্দেশে কিছু বলতে চাইলে...

গ্রাহককে বলব, স্মার্ট কিচেনের জন্য যেসব পণ্য প্রয়োজন হয় তার সবই আমাদের কাছে আছে। আমাদের পার্টিকেল বোর্ড, মেলামাইন বোর্ড, অ্যাক্রেলিক বোর্ড, ইওভি বোর্ড, এইচপিএল বোর্ড আছে। এ সারফেসগুলো আপনি আমাদের পার্টিকেল বোর্ড, এমডিএফ বোর্ড ও প্লাই বোর্ডের ওপর পাবেন। অর্থাৎ বোর্ডের ক্ষেত্রে সব অপশনই আমাদের রয়েছে। এছাড়া আমাদের ফসেট আছে, সিংক আছে। আমাদের কিচেনহুড আসছে বাজারে। আপনার রান্নাঘরকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য আমাদের টাইলস আছে। এমনকি রান্নাঘরে নান্দনিক ডিজাইনের দরজাও আছে আমাদের কাছে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাকেরা তাসনীম ইরা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন