নিট এফডিআইয়ের তথ্যে পার্থক্য

আন্তর্জাতিক মান অনুসারে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের প্রকৃত তথ্য নিশ্চিত করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির আকার বাড়াতে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে এফডিআই। তবে দেশে এ বিনিয়োগ আকর্ষণ করার মতো খাত থাকা জরুরি। এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে নিট এফডিআই জিডিপির ১ শতাংশেরও কম। উপরন্তু এফডিআই প্রবাহের তথ্যবিভ্রান্তি রয়েছে। বণিক বার্তার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ ও বিদেশী বিনিয়োগসংক্রান্ত অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সটার্নাল ডেবট’-এ (জানুয়ারি-জুন, ২০২৩) দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট এফডিআই প্রবাহ প্রায় ৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। আর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো নিয়ে গত মার্চে প্রকাশিত সর্বশেষ ‘মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস: মান্থলি আপডেট’ প্রতিবেদনে ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) অংশে নিট এফডিআই প্রায় ১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার। পদ্ধতিগত পার্থক্যের কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই প্রতিবেদনে নিট এফডিআইয়ের তথ্যে এ ব্যবধান দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

অর্থনীতিতে ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রকৃত তথ্য জানা অতি আবশ্যক। নয়তো সিদ্ধান্তে ফাঁকফোকর থেকে যায় এবং তা অনর্থ বয়ে আনে। ‌প্রকৃত বিনিয়োগের তথ্য না পেলে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ করা কঠিন। আবার তথ্যের বিভ্রান্তি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এফডিআই প্রবাহের তথ্যবিভ্রাট দূর করতে কার্যকর পন্থা অনুসরণ করা। আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকৃত তথ্য ‍নিরূপণে যে পদ্ধতিগত অসমন্বয় রয়েছে সেটি দূর করা প্রয়োজন। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের এফডিআই ও বিদেশী ঋণসংক্রান্ত অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনে নিট এফডিআই হিসাব করা হয় মোট এফডিআই (গ্রস) থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের পরিমাণকে বাদ দিয়ে। অন্যদিকে মার্চের মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস: মান্থলি আপডেট প্রতিবেদনের বিওপি অংশের নোটে নিট এফডিআই হিসাব করা হয় বিনিয়োগ প্রত্যাহারের (ডিজইনভেস্টমেন্ট) পাশাপাশি ঋণ পরিশোধ ও ক্ষতি বাদ দিয়ে। অর্থাৎ পদ্ধতিগত ভিন্নতার কারণেই দুই প্রতিবেদনে নিট এফডিআইয়ের তথ্যের পার্থক্য দেখা যায়। এখানে মূলত বিওপির নিট এফডিআই হিসাব করা হয় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে দেশের বিভিন্ন আর্থিক সূচকের যেসব তথ্য পাঠানো হয়ে থাকে, সেখানেও নিট এফডিআইয়ের এ তথ্যই ব্যবহার করা হয়। 

দেশে এফডিআই প্রবাহ ২০২২ সালের প্রথমার্ধে নিম্নমুখী হয় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে। এর পর থেকে এ প্রবাহ খুব একটা বাড়েনি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশের নিট এফডিআই দাঁড়িয়েছে ১১১ কোটি ৮০ লাখ ডলারে, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সে অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দেশে নিট এফডিআইয়ের প্রবাহ বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। একদিকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘটনা বাড়ছে, অন্যদিকে হ্রাস পাচ্ছে এফডিআই স্টক। আশির দশক-পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিকাশে এফডিআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। বাংলাদেশ কেন তুলনামূলকভাবে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারেনি তা খতিয়ে দেখা দরকার। সে মোতাবেক কাজ করা এখন সময়ের দাবি। নয়তো এফডিআই প্রবাহ আরো নিম্নমুখী হবে।

বর্তমানে দেশে যে এফডিআই আসছে, তার পরিমাণ যৎসামান্যই বলা যায়। যদিও এফডিআই আকৃষ্ট করতে অর্থনৈতিক অঞ্চল, ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার মতো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট অর্থনীতির দেশগুলো বরং বিনিয়োগ আকর্ষণে এগিয়ে। ইউনাইটেড নেশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসেবে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের দিক থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বার্ষিক গড় এফডিআই এসেছে ২৯২ কোটি ডলার। ২০২২ সালে মালদ্বীপ সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ পেয়েছে তাদের জিডিপির প্রায় ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। একই সময়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলংকা পেয়েছে তাদের জিডিপির ১ দশমিক ২০ শতাংশ। এদিকে বাংলাদেশের এফডিআই জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। অন্যান্য দেশ কীভাবে বিনিয়োগ আকর্ষণে সফল হচ্ছে আমাদের জন্য সে পন্থা অনুসরণীয় হতে পারে।

বাংলাদেশ প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের তুলনায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত বড় ধরনের নীতি সংস্কার করার পর ব্যাপকভাবে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের এখানেও কর কাঠামো, নীতির ধারাবাহিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার মতো বিষয়গুলোয় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। ‘ক্যাটালাইজিং গ্রেটার এফডিআই ফর ভিশন ২০৪১’ শীর্ষক প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়, এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে করনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ কর সংক্রান্ত বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আন্তর্জাতিক করনীতির তুলনায় বাংলাদেশের কর ব্যবস্থায় বড় ধরনের অসামঞ্জস্য আছে। কর ব্যবস্থাকে আরো অনুকূল করা হলে রাজস্ব আয় ও সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব। বলা বাহুল্য, যতদিন পর্যন্ত এসব ক্ষেত্রে সংস্কার না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এফডিআই আকর্ষণ করা সম্ভব হবে না।

আবার এফডিআই কম আসার অন্যতম কারণ ডলার সংকটও। বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মুনাফা বিদেশে নিতে পারছে না। যে দেশ থেকে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো উপার্জিত অর্থ নিজ দেশে নিতে পারে না, স্বাভাবিকভাবেই সে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কমে যায়। আশা করা যায়, এ সংকট কেটে গেলে এফডিআই প্রবাহে গতি ফিরবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন