শিক্ষায় প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের প্রভাব নিয়ে আগেই সতর্ক করেছিল ইউনিসেফ

প্রস্তুতির অভাবে তাপপ্রবাহে স্কুল খোলা রাখা নিয়ে দোটানায় সরকার

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

তীব্র গরম উপেক্ষা করে স্কুলে শিক্ষার্থীরা। গতকাল মতিঝিলে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশে ১৯ এপ্রিল প্রথমবারের মতো তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা দেয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। সর্বশেষ তিনদিনের সতর্কবার্তা আসে গত রোববার। প্রথমবার সতর্কবার্তা দেয়ার পরই পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাপপ্রবাহ কেটে যাওয়ার আগেই রোববার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। প্রথম দিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার একদিনের ব্যবধানে সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে। আবারো বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিদ্যালয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রস্তুতির অভাবের কারণই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার বিষয়ে দোটানায় সরকার। অথচ শিক্ষায় প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের প্রভাব নিয়ে বছর দুয়েক আগেই সতর্ক করেছিল জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২৭ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তিতে রোববার থেকে প্রাথমিক স্কুল খোলার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তার একদিন পরই গতকাল আরেক বিজ্ঞপ্তিতে পুনরায় স্কুল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। একই ঘটনা ঘটে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। তার আগে তীব্র গরম ও চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে সারা দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার পাঠদান আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন। 

বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রভাব নিয়ে ২০২২ সালে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইউনিসেফ। ওই প্রতিবেদনে শিক্ষা খাতে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপপ্রবাহসহ বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রভাব তুলে ধরা হয়। সতর্কবার্তা দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে পরিবেশগত বিপর্যয়। তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়ার মতো রোগ বেড়ে যায়। ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকা তাপমাত্রা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ফ্যানের ব্যবস্থা থাকলেও অনেক শ্রেণীতে অধিক শিক্ষার্থী থাকায় বৈদ্যুতিক পাখা তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে না। ফলে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী তাদের মনোযোগ হারাচ্ছে।

এ প্রতিবেদনে পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রভাব কমাতে কিছু পরামর্শও ছিল। এর মধ্যে অন্যতম শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পরিবেশগত বিপর্যয় মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ, কোনো কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হলে বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ রাখা, কারিকুলামে পরিবর্তন, করোনাকালের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অনলাইন শিক্ষাকে আরো জোরদার রাখা ইত্যাদি। যদিও চলমান তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় ইউনিসেফের এসব পরামর্শের তেমন বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।

এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি ফুটে উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যেও। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ জাফর আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের তাপমাত্রা এর আগে আমাদের মোকাবেলা করতে হয়নি। ফলে এমনটি হতে পারে তেমনটি ভাবনায় ছিল না। কিন্তু যেসব সিদ্ধান্ত বর্তমানে নেয়া হচ্ছে, সেগুলো শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করেই। করোনাকালে শিক্ষার্থীদের একটি শিখন ঘাটতি ছিল। এখন তাপপ্রবাহের কারণে আমরা যদি দিনের পর দিন স্কুল বন্ধ রাখি, তাহলে আবার ঘাটতি তৈরি হবে। আর বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা মুখস্থনির্ভর নয়, শিখননির্ভর। ফলে ক্লাস করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।’

আপৎকালীন অনলাইন ক্লাস নিয়ে ইউনিসেফের পরামর্শের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‌আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অনলাইন ক্লাস উপযোগী নয়। তবে আমরা তাদের পরামর্শ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করি। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের শিক্ষার্থীদের তো এ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। তাদের অভিযোজন ক্ষমতাটাও তৈরি হতে হবে। তাছাড়া সে যখন বাসায় থাকছে তখনো কিন্তু একই তাপমাত্রায়ই থাকছে।’

স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টদের মতে, তাপপ্রবাহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য গরম উপযোগী পোশাক, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং প্রয়োজন সাপেক্ষে শিক্ষার্থীকে অ্যাম্বুলেন্সে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেয়ার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

তাপপ্রবাহের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাকে সমাধান মনে করেন না ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হকও। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাপপ্রবাহের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখার বিষয়ে দুটি প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমটি শিক্ষার্থীসংশ্লিষ্ট, তাদের ঢিলেঢালা হাফ হাতা পোশাক পরাতে হবে, মোজা ব্যবহার করবে না। বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে ছাতা ব্যবহার করবে, আউটডোর গেম পুরোপুরি পরিহার করবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পানি পান করবে। দ্বিতীয় প্রস্তুতি বিদ্যালয় সম্পর্কিত, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। একই সঙ্গে কোনো শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে তাৎক্ষণিক যেন অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নেয়া যায়, সে সুযোগও রাখতে হবে।’

তাপমাত্রা এতটা বেড়ে যাতে পারে এমনটি চিন্তায় ছিল না বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের অনেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের, তাদের অনলাইন অ্যাকসেস নেই। তাই শিখন ঘাটতি এড়াতে স্কুল খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে তারা জানান। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ায় সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

চলতি বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী বছরগুলোয় এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আবহাওয়া বিবেচনায় অন্তত ২ মে পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার প্রয়োজন ছিল। তবে আমরা যেহেতু এবার প্রথমবারের মতো এতটা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করছি তাই কিছু ভুলত্রুটি হতে পারে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যেন এমনটি না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। এ অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তী সময়ে কীভাবে আমরা তাপপ্রবাহ কিংবা শৈত্যপ্রবাহের মতো পরিস্থিতিগুলো মোকাবেলা করব, সে বিষয়ে যথাযথ প্রস্তুতি রাখতে হবে। সেই সঙ্গে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন সংস্থা কিংবা নাগরিক সমাজ যে পরামর্শগুলো দিচ্ছে সেগুলোও সরকারের বিবেচনায় নেয়া উচিত।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন