বাংলাদেশকে ঘিরেই পরিকল্পনা বড় করছে শেভরন

আবু তাহের

জাতীয় গ্রিডে স্থানীয়ভাবে সরবরাহকৃত গ্যাসের ৬০ শতাংশই আসছে শেভরন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে ছবি: সংগৃহীত

পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ থেকেও ব্যবসা বিক্রি করে চলে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল জ্বালানি খাতের বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। যদিও এখন গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় কোম্পানিটির কার্যক্রম রয়েছে শুধু বাংলাদেশেই। প্রতিবেশী মিয়ানমারের জ্বালানি খাতে দীর্ঘদিন কাজ করলেও সেখান থেকেও ব্যবসা প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে কোম্পানিটি। বর্তমান পরিস্থিতিতে অঞ্চলে শুধু বাংলাদেশকে ঘিরেই ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেভরন।

দেশের জ্বালানি খাতে শেভরন ব্যবসা করছে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে। বর্তমানে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহকৃত গ্যাসের ৬০ শতাংশই আসছে শেভরনের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। পেট্রোবাংলার সহযোগী হিসেবে বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার জালালাবাদ গ্যাসফিল্ডে গ্যাস উত্তোলন তা সরবরাহের কাজে নিয়োজিত রয়েছে কোম্পানিটি।

২০১৭ সালেই বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল শেভরন। তবে পরবর্তী সময়ে ওই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে কোম্পানিটি। মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও কোম্পানিটির ব্যবসায়িক কার্যক্রম নেই। কোম্পানিটি এখন দেশের লাখ ৮৬ হাজার একর এলাকাজুড়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে শেভরনের বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বর্তমানে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের ভূভাগে (অনশোর) গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম সম্প্রসারণে তত্পর হয়ে উঠেছে শেভরন। কোম্পানিটি এরই মধ্যে আরো কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলন কার্যক্রম চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শেভরন এখন দেশের ভূভাগের ১১টি ব্লকের হাই প্রেশার জোনে অনুসন্ধান চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে রশিদপুর ছাতকে নাইকোর ফেলে যাওয়া কূপে উত্তোলন কার্যক্রম চালাতে চাইছে কোম্পানিটি। কোনো অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) বা দরপত্র ছাড়াই গ্যাসক্ষেত্র দুটিতে কাজ পেতে চায় শেভরন। নিয়ে পেট্রোবাংলার কাছে সম্পর্কিত কিছু প্রস্তাবও দিয়েছে তারা। যদিও বিষয়ে এখনো কোনো সাড়া দেয়নি পেট্রোবাংলা।

বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, অনশোর এলাকায় জ্বালানি তেল গ্যাস অনুসন্ধানে শেভরন আগ্রহ দেখিয়েছে। তাদের প্রস্তাব বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এটি নিয়ে জ্বালানি বিভাগ আরো পর্যবেক্ষণ চালাবে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বাংলাদেশে ব্যবসার আওতা পরিধি বাড়াতে বহুজাতিক কোম্পানিটি এমন এক সময় তত্পর হয়ে উঠেছে, যখন দেশে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বড় একটি সক্ষমতা বন্ধ রাখতে হয়েছে গ্যাসের অভাবে। এমন সময়ে দেশের ভূভাগে শেভরনের কাজ করার আগ্রহকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, দেশে গ্যাস উৎপাদনের যে চিত্র তাতে মুহূর্তে উত্তোলন কার্যক্রমে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ দরকার, যাতে জাতীয় গ্রিডে আরো দ্রুত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হয়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের গ্যাস সংকটের ক্রান্তিলগ্নে অনুসন্ধান উত্তোলনে শেভরন আগ্রহ দেখালে সেটি খারাপ কিছু নয়। আমাদের গ্যাস প্রয়োজন এবং সেটি দ্রুত। সেক্ষেত্রে তাদের প্রযুক্তি অনেক উন্নত। বাপেক্সেরও সক্ষমতা রয়েছে। তবে শেভরনের চেয়ে বেশি নয়, সেক্ষেত্রে দুটি কোম্পানির সমন্বয়ে কাজ করা গেলে বাপেক্সেরও অভিজ্ঞতা বাড়বে।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়া মুহূর্তে শেভরনের কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম নেই। জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সমুদ্র ব্লকগুলোয় এখন বিদেশী বহুজাতিক কোনো বড় কোম্পানি নেই। অন্যদিকে গ্যাস উত্তোলনে অংশীদারিত্ব চুক্তি সংশোধনের কাজ করছে পেট্রোবাংলা। এমন সময়ে বাংলাদেশের ভূভাগে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনে শেভরনের আগ্রহ বিদেশী অন্যান্য কোম্পানিরও দৃষ্টি আকর্ষণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

বিষয়ে জানতে চাইলে শেভরন বাংলাদেশের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, দীর্ঘদিনের অনুসৃত করপোরেট নীতি অনুযায়ী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আমরা মন্তব্য করি না। ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সরবরাহ করে আসছি আমরা। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পেট্রোবাংলাকে সহায়তা করছে শেভরন বাংলাদেশ। আমরা সবসময় আজকের এবং আগামীর জ্বালানি সুরক্ষায় সহায়তা দিতে বাংলাদেশের জনসাধারণ এবং সরকারের সঙ্গে অংশীদারির সম্ভাবনা খুঁজছি।

দেশের অভ্যন্তরে শেভরনের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যাপ্তি বাড়ালেও বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোয় তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। শেভরন এতদিন ফরাসি কোম্পানি টোটাল এনার্জির সঙ্গে যৌথ কনসোর্টিয়ামের ভিত্তিতে মিয়ানমারের গ্যাস খাতে কার্যক্রম চালালেও বর্তমানে উভয় কোম্পানিই দেশটি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

দেশের অনশোর ব্লক ১২, ১৩ ১৪-এর অধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় অনুসন্ধান চালাতে আগ্রহী শেভরন। বিবিয়ানা, জালালাবাদ মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্র ব্লকগুলোর মধ্যেই পড়েছে। এছাড়া এসব গ্যাসক্ষেত্রে শেভরনের চুক্তিভিত্তিক উত্তোলন কার্যক্রমের মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। শেভরন পেট্রোবাংলার মধ্যে সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, জালালাবাদে ২০২৪ সাল, মৌলভীবাজারে ২০২৮ বিবিয়ানায় ২০৩৪ সাল পর্যন্ত উত্তোলন কার্যক্রম চালাবে শেভরন। এসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস ছাড়াও প্রতিদিন গড়ে লাখ ১৪ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল, ৬৫৮ মিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস হাজার ব্যারেল কনডেনসেট উত্তোলন হচ্ছে। পেট্রোবাংলা বলছে, এখন এসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে জ্বালানি তেলের উৎপাদন আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। এর বিপরীতে গ্যাস কনডেনসেট উত্তোলন বেড়েছে।

জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহে মুহূর্তে শেভরন প্রধান ভূমিকা নিয়েছে উল্লেখ করে জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় দৈনিক সরবরাহকৃত গ্যাসের প্রায় ৬০ শতাংশ আসছে শেভরনের পরিচালনাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। স্থানীয় পর্যায়ে মোট সরবরাহের অর্ধেকই আসছে শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে। কোম্পানিটির পরিচালনাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলোর কূপ সংস্কারের কারণে এগুলোর সরবরাহও বাড়ছে।

পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, দেশের জাতীয় গ্রিডে এলএনজিসহ দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি। এর মধ্যে এলএনজি বাদ দিলে স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যেখানে শেভরনের পরিচালনাধীন গ্যাসফিল্ড থেকে আসছে হাজার ৪২২ মিলিয়ন ঘনফুট, যা স্থানীয় সরবরাহের ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকেই সরবরাহ হচ্ছে দৈনিক হাজার ২২৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বাইরে কোম্পানিটি পরিচালিত জালালাবাদ গ্যাসফিল্ড থেকে সরবরাহ আসছে দৈনিক ১৭৭ মিলিয়ন ঘনফুট এবং মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ড থেকে সরবরাহ আসছে দৈনিক ১৮ মিলিয়ন ঘনফুট। শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে কূপ রয়েছে মোট ২৬টি, যার সবগুলোই সক্রিয়। জালালাবাদে ১৩টি কূপের মধ্যে সক্রিয় সাতটি এবং মৌলভীবাজারে সাতটির মধ্যে পাঁচটি কূপ সক্রিয় রয়েছে।

দেশের ভূভাগে বহুজাতিক কোম্পানিটির কাজের আগ্রহকে বেশ ইতিবাচকভাবে দেখছে না বাপেক্স। সংস্থাটির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনে বাপেক্স একাই সক্ষম। এরই মধ্যে তার প্রমাণও দিয়েছে সংস্থাটি। বরং বাপেক্সের যেসব জায়গায় সক্ষমতা কম, সেসব স্থানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে কাজ করাতে পারলে তা আরো বেশি সাফল্য আনবে।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, পিএসসি চুক্তির আওতায় শেভরন কাজ করতে চাইলে তারা সেটি করতে পারে। তবে সেটি ভূভাগে নাকি সমুদ্রে সে বিষয়ে জানা নেই। আমরা -সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাবও পাইনি। তাদের প্রস্তাব পেলে বোঝা যাবে, আসলে তারা কোথায় কী ধরনের কাজ করতে চায়। তারপর সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন