বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের মাইলফলক হবে ২০২২: প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বর্তমান সরকারের মেয়াদ তিন বছরপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ছবি: পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০২২ সাল হবে বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক বছর। আর কয়েক মাস পর জুন মাসেই আমরা উদ্বোধন করতে যাচ্ছি বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু। অনেক ষড়যন্ত্রের জাল আর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে যাচ্ছি। এই সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সরাসরি রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করবে। আশা করা হচ্ছে, এই সেতু জিডিপিতে দশমিক শতাংশ হারে অবদান রাখবে। গতকাল সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বছরের শেষ নাগাদ আমরা উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে মেট্রোরেল চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। অংশে এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। আশা করা যায়, মেট্রোরেল রাজধানী ঢাকার পরিবহন খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আগামী অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হবে দেশের প্রথম টানেল। অন্য বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কাজও পুরোদমে এগিয়ে যাচ্ছে। লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিট আগামী বছরের এপ্রিল নাগাদ চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

মহামারী করোনাভাইরাসের সংকট এখনো কাটেনি উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে আমাদের বিগত ২০২০ ২০২১ সাল অতিক্রম করতে হয়েছে। সেই সংকট এখনো কাটেনি। এর মধ্যেই আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের এখনই সাবধান হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। যারা টিকা নেননি, তাদের দ্রুত টিকা নেয়ার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি।

এখন পূর্ণোদ্যমে কভিড-১৯ টিকাদানের কাজ চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চলতি মাস থেকে গণটিকা প্রদানের মাধ্যমে প্রতি মাসে কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১২ কোটি ৯৫ লাখ ৮০ হাজার ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ পেয়েছেন প্রায় কোটি ৫৮ লাখ মানুষ আর দুই ডোজ পেয়েছেন কোটি ৩৫ লাখ ৮২ হাজার। গত মাস থেকে বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে আমাদের হাতে সাড়ে কোটিরও বেশি ডোজ টিকা মজুদ আছে।

করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, অনেক দেশের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। আমাদের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়েছে। নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তবে আপনাদের সহায়তায় আমরা তা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি বলেন, বিভিন্ন নীতি-সহায়তা এবং বিভিন্ন উদারনৈতিক আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদানের মাধ্যমে আমরা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত আমরা ২৮টি প্যাকেজের মাধ্যমে লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। এর মধ্যে অক্টোবর পর্যন্ত লাখ হাজার ৫২২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৫৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এতে প্রায় কোটি ৭৪ লাখ মানুষ উপকৃত হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়েছে প্রায় লাখ ১৮ হাজার।

সরকারপ্রধান বলেন, করোনার অভিঘাত মোকাবেলা করে গত অর্থবছরে আমাদের জিডিপি দশমিক ৪৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২১- মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে হাজার ৫৫৪ ডলারে।

দ্য ইকোনমিস্ট-এর ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।

জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বিগত ১৩ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ নানা আর্থসামাজিক সূচকে বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে।

তিনি বলেন, এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের ওপর জনগণ আস্থা রাখার ফলে। পরপর তিনবার রাষ্ট্রপরিচালনার সুযোগ দিয়ে আপনারা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়তা করেছেন। ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে আমরা একটি কল্যাণকামী, উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি, যাতে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর কাতারে শামিল হতে পারে। এজন্য অতীতে যেমন আপনারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, ভবিষ্যতে আমাদের সঙ্গে থাকবেন, আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

শতভাগ বিদ্যুতায়নের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির কথা আপনাদের মনে আছে। তখন সাকল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল ৪২০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াটে। মুজিব বর্ষ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমরা সে প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করেছি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পায়রায় এরই মধ্যে হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেশখালী মাতারবাড়ীতে আরো মোট হাজার ৮০০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালে জাতীয় গ্রিডে হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো, বর্তমানে যা হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। গ্যাসের অব্যাহত চাহিদা মেটাতে ২০১৮ থেকে তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। নববর্ষের শুরুতে আমাদের জন্য সুখবর হচ্ছে: বঙ্গোপসাগরে যে গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পাওয়া গেছে তার পরিমাণ ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।

ভাষণে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, আজ খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে কোটি ৫৫ লাখ টন। অব্যাহত নীতিসহায়তা প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।

সরকারপ্রধান বলেন, ২০১৮ সালে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে আমার গ্রাম, আমার শহর’— প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আমরা প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের অঙ্গীকার করি। আজ দেশের প্রায় সব গ্রামে পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পল্লী এলাকায় ৬৬ হাজার ৭৫৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, লাখ ৯৪ হাজার ব্রিজ-কালভার্ট, হাজার ৭৬৭টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, হাজার ২৫টি সাইক্লোন শেল্টার এবং ৩২৬টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৪৫৮ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। আরো ৮৮৭ কিলোমিটার মহাসড়ক চার বা এর বেশি লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। ঢাকায় বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়েকে যুগোপযোগী এবং আধুনিক গণপরিবহন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমানে ১৩ হাজার ৩৭১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৭টি প্রকল্পের কাজ চলছে। ঢাকার চারদিকে সার্কুলার রেল লাইন স্থাপনের লক্ষ্যে সমীক্ষার কাজ চলছে। ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৪৫১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং হাজার ১৮১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৪২৮টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যমুনা নদীর ওপর দশমিক কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনসের বিমানবহরে ১২টি নতুন অত্যাধুনিক বোয়িং এবং ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। সংযোজিত হয়েছে তিনটি ড্যাশ--৪০০ উড়োজাহাজ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন