কভিডের কারণে কয়েক সেমিস্টার ধরে আসনের বিপরীতে সিকিভাগ শিক্ষার্থীও পাচ্ছে না দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীর অভাবে শ্রেণী কার্যক্রমও শুরু করতে পারছে না। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া হয়ে পড়েছে দুই থেকে ছয় মাস পর্যন্ত। ভাড়া পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ভবনও ছেড়েছে অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ব্যয়ভার চালিয়ে নিতে না পেরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিক্রি করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যদিও মহামারী-সৃষ্ট এ বিপর্যয়ের মধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে আরো তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি হলো ঢাকার উত্তরায় ‘মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, সিলেটে ‘আরটিএম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি’ ও কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় ‘শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’। এর মধ্যে সর্বশেষ অনুমোদন পেয়েছে শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়টি অস্থায়ীভাবে স্থাপন ও পরিচালনার সাময়িক অনুমোদন দিয়ে একটি আদেশ জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
উচ্চশিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে থেকেই দেশে এত বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। করোনাকালে শিক্ষার্থী ও আর্থিক সংকটে বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে অন্তত ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়। সংকট মোকাবেলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) কাছে ঋণসহ নানা ধরনের প্রণোদনার আবেদন করেও কোনো সহায়তা পায়নি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
এ অবস্থায় পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংকট সমাধানে নজর দেয়াটাই বেশি যৌক্তিক ছিল বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, করোনাকালে দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন দিতে পারছে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষক-কর্মকর্তা ছাঁটাই করেছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হলেও এগুলো দেশের শিক্ষার্থীদেরই গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ করে দিচ্ছে। অথচ আমার জানামতে, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি এসব প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের অভাবে ঢাকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নতুন সেমিস্টার শুরু করতে পারছে না। তাই আমাদের নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়ার আগে আরো চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা বা প্রতিষ্ঠার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নেই—এমন অনেককেই দেখছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। তাদের উদ্দেশ্য উচ্চশিক্ষা নয়, বাণিজ্য। এদের কারণেই দেশের সম্ভাবনাময় একটি খাত দিন দিন খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যায় যে বিকাশ হয়েছে, তা যথেষ্ট। এখন বিশেষভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন।
দেশে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশই ঢাকায়। এজন্য কয়েক বছর ধরে ঢাকায় নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করতে অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন শিক্ষাবিদরা। যদিও এ নীতির প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। গত বছরের জুনে রাজধানীর উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের গাউসুল আজম অ্যাভিনিউতে ‘মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ নামে নতুন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ওই সময়ে দেশের শিক্ষা খাত থমকে ছিল।
এদিকে করোনায় সৃষ্ট আর্থিক সংকটের সঙ্গে দেশের বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষায় সুশাসনের সংকটও প্রকট হয়ে উঠেছে। যে আইনের ভিত্তিতে অনুমোদন, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সেটির কোনো তোয়াক্কাই করছে না দেশের সিংহভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অননুমোদিত প্রোগ্রাম পরিচালনা, অযোগ্য শিক্ষক দিয়ে পাঠদান, ট্রাস্টি বোর্ডের স্বেচ্ছাচারিতা ও আয়-ব্যয়ের নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠছে বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে সনদও বিক্রি করছে সরকার অনুমোদিত কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। তবে এসব অনিয়ম বন্ধে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি। উল্টো কয়েক মাস পরপর নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
বতর্মানে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১০৮টি। এর মধ্যে গত এক যুগেই অনুমোদন পেয়েছে ৫৭টি। করোনাকালে অনুমোদন পেয়েছে আরো তিনটি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির পর্যবেক্ষণ মতেই, দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো না কোনোভাবে আইন অমান্য করছে। এর মধ্যে ৩০টির বেশিতে বৈধ কোনো উপাচার্যই নেই। অননুমোদিত ক্যাম্পাস ও ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। অননুমোদিত প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে ১০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলমান রয়েছে বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে। বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ১০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। ১০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ইউজিসির তদন্ত চলমান।
যদিও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না থাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়মের বড় অংশই ইউজিসির অগোচরেই থেকে যায় বলেও সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ রয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম বন্ধে ব্যর্থতার দায় নিয়ন্ত্রণ-সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো বরাবরই একে অন্যের ওপর চাপিয়ে এসেছে। ইউজিসির কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, আইনি ও লোকবলের সীমাবদ্ধতার কারণে এসব অনিয়ম বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাদের দাবি, অনিয়ম বন্ধের ক্ষেত্রে ইউজিসির শুধু মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করার সুযোগ রয়েছে। আইনে এর বেশি ক্ষমতা ইউজিসিকে দেয়া হয়নি। এজন্য সুপারিশ ও লাল তারকায় চিহ্নিত করা ছাড়া ইউজিসির তেমন কিছু করার থাকে না।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইউজিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের কর্মকর্তাদের একেকজনকে ১০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ডিল করতে হয়। অথচ একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য একজন করে কর্মকর্তা দরকার। এছাড়া দূরত্বের কারণেও ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় আনাও সম্ভব হয় না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইউজিসির কিছু আইনি সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এটা সত্য। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংস্কারের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে, যা বর্তমানে চলমান। জনবল সংকটের বিষয়টিও সঠিক। এছাড়া করোনার কারণে মনিটরিংও একটু দুর্বল হয়েছে। তবে আমরা সবসময়ই উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছি।
নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এ অধ্যাপক বলেন, এটা মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া হয়। এ বিষয়ে তারা ভালো বলতে পারবেন।