মনপাখিকেই বেশি এঁকেছি

কাজী রকিব

নারী ও পাখিরা শিল্পী: কাজী রকিব

খুব ছোট বয়সে প্রথম আঁকতে শিখেছিলাম পাখিকে—‘দ’ অক্ষর লিখে তা পাখিতে রূপান্তর করা। জাদু মনে হতো। আমি পারি সেটাও। তখন ওই পাখি সবাই আঁকতে পারত, কিন্তু আমি মনে করতাম আমারটাই শ্রেষ্ঠ। চট্টগ্রামে আসকার খাঁ দীঘির পাড়ে ৮৮ হেমসেন লেনে থাকি। বেড়ার যমজ ঘর। দুটি নিয়ে আমরা, অন্য দুটি নিয়ে সালাম-মুকুলদের ঘর। একটু আলাদা রান্নাঘর। আমাদের পাশে রান্নাঘরের মধ্যে একচিলতে ফাঁকা জায়গা। মুকুলদের পাশে আরো ঘনিষ্ঠ রান্নাঘর। কিন্তু মিরর ইমেজ। ওই বাসায় আমার জন্ম, ক্লাস ফোর পর্যন্ত বসবাস। আমার ভাবনা শুরুও ওখানে।

নালার ওপারে কদম গাছ। অনেক পাখির কলোনি। কাকের সংখ্যাই বেশি। সকালে রান্নাঘরে মা রুটি বানাচ্ছেন। শেঁকা হলে কয়েকটি রুটি নিয়ে এসে আব্বার হাতে দিতাম। বড় ঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আব্বা রুটি ছিঁড়ে ছোট্ট উঠানমতো ফাঁকা জায়গায় ছুড়ে ফেলতেন। কাক সেই রুটি খেত। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম। এটা একটা খেলা। কাকেদের হুড়াহুড়ি ছিল, লোভী কাক ছিল, ছিল দুর্বল কাকও। দুর্বলেরা ভাগ পায় না। আমরা ভাই-বোনেরা দুর্বলের পক্ষে, পেটুক কাককে তাড়াতাম যাতে দুর্বলেরা ভাগ পায়। এরপর আব্বা ওদের তাড়িয়ে দিতেন, শালিক-চড়ুই আস। ওদের ছোট টুকরা করে আমরা খাওয়াতাম। চড়ুইকে চালের খুদ দিতাম। এ খেলা পাখির সঙ্গে ভালোবাসা তৈরি করে। 

গ্রামের বাড়ি গেলে পাখির রাজত্ব। আমরা যেমন অল্প কিছু মানুষ শহরে থাকি, পাখিরও অল্প কিছু জাত থাকে শহরে। কাক শহুরে পাখি। গ্রামে দেখাই যেত না। যদিও কিছু দেখা যেত সে দাঁড়কাক। বড় বেশি কালো, আকারেও বড়। কাকের সৌন্দর্য অপরূপ। অনেকেই কালো বলে সুন্দর মানেন না। আমার এর রঙ, এমনকি কণ্ঠস্বরও ভালো লাগে। জ্যাজ কণ্ঠস্বর। ছোটবেলায় গ্রামে যাওয়াটাই আনন্দের ছিল। মাঝরাতে স্টিমার থেকে নেমে নদীর পাড়ে অনেকগুলো নৌকা ভিড়ে থাকত, আকাশ লাল হতেই গ্রামের দিকে রওনা হতো। ঘুঘুর ডাকে গ্রাম বুঝতে পারতাম। আমার কাছে গ্রাম ও শহরের পার্থক্য হতো সাউন্ডস্ক্যাপে। ঘুঘুর ডাক শহরে শুনতে পেতাম না। 

কুটুম পাখি ছিল বিস্ময়। শালিকের মতো লেমন-ক্রোমে মেশানো রঙ। ছিল কোকিল, রাজ বুলবুলি, বাবুই, হরিকল আরো আরো। রাজ বুলবুলির মাথা কালো, পুরো শরীর সাদা, লেজে দুটি পালক লম্বা। এর জন্য একটানা উড়তে পারত না। একটু উড়ে আবার বসে, আবার উড়ে আবার বসে। একবার আমি ও দাদা একটা রাজ বুলবুলিকে অনুসরণ করতে করতে গভীর বাগানে ঢুকে পড়ছিলাম। পরে রূপকথার ডাইনির কথা মনে পড়ে পালিয়ে এসেছি। আরেকটা পাখির নাম জানি না, বটফল খায়, চড়ুই আকারের সবুজ-হলুদ মিশেল রঙ, মাথা লাল। ঠোঁটের দুপাশে গোঁফের মতো দুগাছি লোম। ভারি সুন্দর, রাগী কণ্ঠস্বর। ঝাঁকে ঝাঁকে থাকত বটগাছে ফল পাকলে। লাল গোল বটফলের সঙ্গে ওই পাখি অপূর্ব লাগত। সবুজ রঙের পাখি, নাম খয়েরি মাথা সুঁইচোরা, ধানখেতে উড়ত তীব্র বেগে ঢেউয়ের মতো। আর ছিল দল ঘুঘু, মোটেই ঘুঘু প্রজাতির না। আকৃতি বা গড়নে ভিন্ন, ডাকের স্টাইলে কিছুটা মিল, কিন্তু কণ্ঠস্বর একেবারেই আলাদা। একটু আলসে ভাবুক। গাছের খুব উঁচু ডালে বসে।

আমি আজীবন নানা পাখি এঁকেছি। বাস্তবে নেই এমন পাখিই বেশি। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’র লোকেশনে কাজ করতে ঢাকার অদূরে এক গ্রামে ঘুরেছি অনেক। সেখানে মাটির দেয়ালে পাখির রিলিফ কাজ দেখেছি। অনেক বাড়িতেই এ ধরনের কাজ ছিল, তবে এক বিশেষ ময়ূর দেখা যেত। হয়তো একই শিল্পীর করা হয়ে থাকবে। সে ময়ূর আমার মনে পাকা আসন নিয়ে বসে গেছে। আমি অনেকবার সে ময়ূর এঁকেছি। ঘুরেফিরে আসে, বারবার। অচেনা পাখি আঁকি, নাম জিজ্ঞেস করলে বলতে পারি না। কিন্তু আমার তো চেনা। 

এমন অনেক সময় আসে, আঁকতে ইচ্ছা করে, বিষয়-ভাবনা আসে না। কী হয়? আঁকতে বসলে পাখি হয়। আমার অনেক প্রিয় পাখি এভাবেই এসেছে। কিছু নীল বা গোলাপি ক্যানভাসে ঘুরতে ঘুরতে পাখি হয়ে আসে। কলমে ডট দিতে দিতে আকাশে জোড়া পাখি ওড়ে। অনেক অনেক একসঙ্গে পাখি, একা রাজকীয় পাখিরা। 

ঢাকায় আমরা যৌথ পরিবার গড়ে তুলি। মা, ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে। উত্তরায় খুব সুন্দর খোলা জায়গা নিয়ে ডুপ্লেক্স বাসা। একদিন মুনিয়া পাখি কেনা হয় দুই জোড়া। ছোট্ট খাঁচাসহ। আমরা চিন্তা করি বড় খাঁচা বানিয়ে দেব যেন ওড়াউড়ি করতে পারে। নেট দিয়ে বড় খাঁচা বানানো হলো, পাখি ওড়ে, কিচিরমিচির করে। ছোট ভাই টুলুর কারুশিল্পে হাত, ভাস্কর্য গুণের কয়েকটি বাসা বানিয়ে দিল। দেখলাম পাখি খুব ভালোভাবেই নিয়েছে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি। এরই মধ্যে মুনিয়ার সঙ্গে সাদা ফিঞ্চ যোগ দিয়েছে। আরো এল বাজরিকা। 

বাজরিকারের একটা কৈশোর স্মৃতি আছে। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। চট্টগ্রামে প্রবর্তক বিদ্যাপীঠে। পাহাড়ের ওপর স্কুল। লাইব্রেরির পেছন দিকে পাহাড় ঢালে কামরাঙা গাছ আছে কিছু। একদিন আমি, অশোক, সুজিত ও চিত্ত পাহাড়ে ঢালে নামি। সেদিকটা আশ্রম, লাইব্রেরির পেছন দিক। কেউ যায় না সেদিকটায়। বাগান নয়, জঙ্গল। গঠাৎ দেখি টিয়া, কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম এর আকার সাধারণ টিয়ার চেয়ে ছোট আর নানা রঙের। আমার আবার রূপকথায় পেয়ে বসে। আমি বাস্তব মনে করি না। ওরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায়। আর আসে না, একটা পরাবাস্তব অনুভূতি হতে শুরু করে। আমি ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসি। কাঁটাবন থেকে বাজরিকা কিনে আনার আগ পর্যন্ত এ ঘোর থাকে প্রায় ২০ বছর। 

নিউইয়র্কের বাসার জানালার পাশে ছোট্ট এক ছাদের মতো আছে। তার পাশে একটা বড় গাছ, ছোট জামের মতো ফল হয়। এ বছর ফল হয়নি সে রকম। পাখি আসে, পায় না ফল। জানালার পরের ছাদমতো জায়গায় মাসুদা পাউরুটি দেয়, পাখি খায়। ফাঁক পেলে কাঠবিড়ালী এসে পাউরুটি নিয়ে যায়। আমি গম ভাঙা এনে দিই, পাখি খায় আর আড়চোখে জানালায় তাকায়। ওদের সন্দেহ যায় না। খাঁচার পাখি সন্দেহ করে না, আপন মনে খায়, পানি খায়, গা ঝাড়া দিয়ে ওপরে উঠে যায়। ওই খাঁচায় ওদের বসার বড় ডাল থাকে। সেখানে গিয়ে বসে। মুনিয়ার সংখ্যা ছিল বেশি। ছিল ঘুঘু, ঘুঘুর ডাক আমার খুব প্রিয়। শহরের বাড়িতে ঘুঘু ডাকলেও আমি গ্রাম অনুভব করি। মুনিয়া বেশি থাকলেও আমি কেন জানি আঁকিনি কখনো। তবে ওই বাড়িতে আমাদের পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ কন্যার জন্ম হয়। মা এ কন্যার নাম রাখেন মুনিয়া।

জগতে পাখি সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী, আগেই বলেছি। মুক্ত পাখির ওড়া, গোসল করা, খাদ্য সংগ্রহে তটস্থ থাকা সবই সুন্দর। কিন্তু কিছু আঁকা পাখি ছাড়া আমার বেশির ভাগ পাখিই জগতে মেলে না। ওরা আমার মনপাখি। আমার ভালোবাসার পাখি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন