খুব ছোট বয়সে প্রথম আঁকতে শিখেছিলাম পাখিকে—‘দ’ অক্ষর লিখে তা পাখিতে রূপান্তর করা। জাদু মনে হতো। আমি পারি সেটাও। তখন ওই পাখি সবাই আঁকতে পারত, কিন্তু আমি মনে করতাম আমারটাই শ্রেষ্ঠ। চট্টগ্রামে আসকার খাঁ দীঘির পাড়ে ৮৮ হেমসেন লেনে থাকি। বেড়ার যমজ ঘর। দুটি নিয়ে আমরা, অন্য দুটি নিয়ে সালাম-মুকুলদের ঘর। একটু আলাদা রান্নাঘর। আমাদের পাশে রান্নাঘরের মধ্যে একচিলতে ফাঁকা জায়গা। মুকুলদের পাশে আরো ঘনিষ্ঠ রান্নাঘর। কিন্তু মিরর ইমেজ। ওই বাসায় আমার জন্ম, ক্লাস ফোর পর্যন্ত বসবাস। আমার ভাবনা শুরুও ওখানে।
নালার ওপারে কদম গাছ। অনেক পাখির কলোনি। কাকের সংখ্যাই বেশি। সকালে রান্নাঘরে মা রুটি বানাচ্ছেন। শেঁকা হলে কয়েকটি রুটি নিয়ে এসে আব্বার হাতে দিতাম। বড় ঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আব্বা রুটি ছিঁড়ে ছোট্ট উঠানমতো ফাঁকা জায়গায় ছুড়ে ফেলতেন। কাক সেই রুটি খেত। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম। এটা একটা খেলা। কাকেদের হুড়াহুড়ি ছিল, লোভী কাক ছিল, ছিল দুর্বল কাকও। দুর্বলেরা ভাগ পায় না। আমরা ভাই-বোনেরা দুর্বলের পক্ষে, পেটুক কাককে তাড়াতাম যাতে দুর্বলেরা ভাগ পায়। এরপর আব্বা ওদের তাড়িয়ে দিতেন, শালিক-চড়ুই আস। ওদের ছোট টুকরা করে আমরা খাওয়াতাম। চড়ুইকে চালের খুদ দিতাম। এ খেলা পাখির সঙ্গে ভালোবাসা তৈরি করে।
গ্রামের বাড়ি গেলে পাখির রাজত্ব। আমরা যেমন অল্প কিছু মানুষ শহরে থাকি, পাখিরও অল্প কিছু জাত থাকে শহরে। কাক শহুরে পাখি। গ্রামে দেখাই যেত না। যদিও কিছু দেখা যেত সে দাঁড়কাক। বড় বেশি কালো, আকারেও বড়। কাকের সৌন্দর্য অপরূপ। অনেকেই কালো বলে সুন্দর মানেন না। আমার এর রঙ, এমনকি কণ্ঠস্বরও ভালো লাগে। জ্যাজ কণ্ঠস্বর। ছোটবেলায় গ্রামে যাওয়াটাই আনন্দের ছিল। মাঝরাতে স্টিমার থেকে নেমে নদীর পাড়ে অনেকগুলো নৌকা ভিড়ে থাকত, আকাশ লাল হতেই গ্রামের দিকে রওনা হতো। ঘুঘুর ডাকে গ্রাম বুঝতে পারতাম। আমার কাছে গ্রাম ও শহরের পার্থক্য হতো সাউন্ডস্ক্যাপে। ঘুঘুর ডাক শহরে শুনতে পেতাম না।
কুটুম পাখি ছিল বিস্ময়। শালিকের মতো লেমন-ক্রোমে মেশানো রঙ। ছিল কোকিল, রাজ বুলবুলি, বাবুই, হরিকল আরো আরো। রাজ বুলবুলির মাথা কালো, পুরো শরীর সাদা, লেজে দুটি পালক লম্বা। এর জন্য একটানা উড়তে পারত না। একটু উড়ে আবার বসে, আবার উড়ে আবার বসে। একবার আমি ও দাদা একটা রাজ বুলবুলিকে অনুসরণ করতে করতে গভীর বাগানে ঢুকে পড়ছিলাম। পরে রূপকথার ডাইনির কথা মনে পড়ে পালিয়ে এসেছি। আরেকটা পাখির নাম জানি না, বটফল খায়, চড়ুই আকারের সবুজ-হলুদ মিশেল রঙ, মাথা লাল। ঠোঁটের দুপাশে গোঁফের মতো দুগাছি লোম। ভারি সুন্দর, রাগী কণ্ঠস্বর। ঝাঁকে ঝাঁকে থাকত বটগাছে ফল পাকলে। লাল গোল বটফলের সঙ্গে ওই পাখি অপূর্ব লাগত। সবুজ রঙের পাখি, নাম খয়েরি মাথা সুঁইচোরা, ধানখেতে উড়ত তীব্র বেগে ঢেউয়ের মতো। আর ছিল দল ঘুঘু, মোটেই ঘুঘু প্রজাতির না। আকৃতি বা গড়নে ভিন্ন, ডাকের স্টাইলে কিছুটা মিল, কিন্তু কণ্ঠস্বর একেবারেই আলাদা। একটু আলসে ভাবুক। গাছের খুব উঁচু ডালে বসে।