চিত্রকর্মে নারীর কর্তৃত্ব গ্রহণ পর্ব

মুহম্মদ আল মুখতাফি

অলিভেরা পার্লিকের ইনস্টলেশন ছবি: সুপারভিজুয়েলনা

ইতিহাসে কিছু সিদ্ধান্তমূলক সময় তৈরি হয়, যখন বাঁক নেয় পথ। গত শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল তেমন একটা মৌসুম—বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা। খোদ বাংলাদেশের পটভূমিও তখন ছিল উত্তাল। চারদিকে যেন পুরনো দুনিয়াকে ভাঙা ও নতুন ব্যবস্থা তৈরির তৃষ্ণায় পূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতেই ‘ফেমিনিস্ট আর্ট’ জায়গা করে নেয় চিত্রকলায়। আগে থেকে বিদ্যমান নারীবাদ আন্দোলনের সাংস্কৃতিক দিক হিসেবেই ফেমিনিস্ট আর্টের উত্থান। তবে সে যাত্রায় আনুষ্ঠানিকভাবে মৌলিক পরিবর্তন শুরু হয় ১৯৭১ সালে। এ সময় মার্কিন ঐতিহাসিক লিন্ডার নোচলিন লেখেন ‘হোয়াই হ্যাভ দেয়ার বিন নো গ্রেট উইমেন আর্টিস্ট?’ প্রবন্ধ। তাতে তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেন বিদ্যমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির। জোরের সঙ্গে দাবি করা হয়, শত বছর ধরে চলমান ব্যবস্থাই নারীদের পুরুষদের সমান মর্যাদা অর্জন করতে বাধা দেয়। নোচলিনের এ আহ্বান ব্যর্থ হয়নি। তার স্বর যেন পশ্চিমা দুনিয়ার শিল্প ধারণা ও শিল্পচর্চায় নতুন প্রবণতা তৈরি করল।

শুরুর দিনগুলো থেকেই ‘ফেমিনিস্ট আর্ট’ শিল্পের মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছে; চেয়েছে কুসংস্কার দূর করে নারীর অভিজ্ঞতাকে নতুন আলোয় দাঁড় করাতে। সে উদ্যোগ যে সফল হয়নি তা নয়। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সুযোগ তৈরি হলো বিশ্বব্যাপী নারী ও সংখ্যালঘু শিল্পীদের জন্য। অথচ এতদিন তাদের অগ্রাধিকার দেয়াকে সুদূরপরাহত বিবেচনা করা হচ্ছিল। নারীবাদী শিল্পের লক্ষ্যই হলো নারীর প্রতিনিধিত্ব নির্মাণ করা, শিল্প কিংবা শিল্পের বাইরেও তাদের কৃতিত্ব জাহির করা। স্বাভাবিকভাবেই তারা সব ধরনের লৈঙ্গিক বৈষম্য থেকে মুক্তি খুঁজেছে।

‘ফেমিনিস্ট আর্ট’ আন্দোলনটি যেহেতু প্রথাগত দেয়াল ভাঙার প্রচেষ্টা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, ফলে কোনো প্রকার সাধারণীকরণ বা একক শৈলীতে তাকে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব না। তবে পৃথক করার মতো কিছু বৈশিষ্ট্য যে তাদের নির্মাণে পরিদৃষ্ট হয়নি, তা কিন্তু না। পুরুষের পরিচয়জ্ঞাপক কিংবা সিদ্ধান্তের বাইরের বিশাল জগৎ থেকে তারা খোঁজার চেষ্টা করেছেন শিল্পের উপকরণ। উপজীব্য করে তুলতে চেয়েছেন বিকল্প কোনো মাধ্যমকে, যা আগে উপেক্ষিত ছিল। আর সে উপাদানগুলো প্রায়ই হতো নারীর অভিজ্ঞতা কিংবা নারীর দৃষ্টিকোণে নির্মিত চারপাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঐতিহাসিকভাবেই দেখা যায় পারফরম্যান্স আর্ট, ডিজিটাল মিডিয়া ও টেক্সটাইলে পুরুষের উপস্থিতি কম। অনেকটা সে কারণেই নারীবাদী শিল্পীদের কাছে এগুলো পেয়েছে অগ্রাধিকার। পিতৃতান্ত্রিকতার চিহ্ন বহন করে, এমন যেকোনো কিছুকে তারা বর্জন করতে প্রস্তুত ছিলেন। সেটা রঙের মাধ্যম হিসেবেই হোক কিংবা বিষয়বস্তুর প্রতিনিধিত্ব হিসেবে। নিজেকে প্রকাশের নতুন ও অস্বাভাবিক রূপগুলোকে নিয়েই নারীবাদী শিল্পীরা যেন শিল্পের ইতিহাসকে পুনর্লিখনের দায়িত্ব নিলেন। অস্বীকার করে বসলেন নারীর উপস্থিতি ও প্রতিনিধিত্বহীন বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে। এক্ষেত্রে যুগান্তকারী উদাহরণ হতে পারে জুডি শিকাগোর শিল্প ‘দ্য ডিনার পার্টি’ (১৯৭৪ সাল)। ইনস্টলেশনটি নানা দিক থেকে আইকনিক। বিশেষ করে সেখানে ইতিহাসের সেইসব নারীকে জায়গা দেয়া হয়েছে, যাদের কাছে ঋণী মানবসভ্যতা। জুডির কাজ থেকে এখন পর্যন্ত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ মুখ দেখা যায় চিত্রকলার জগতে। 

মিরিয়াম শাপিরো 

সত্তরের দশকে মিরিয়াম শাপিরো ‘ফেমেজ’ নামে নতুন শব্দবন্ধের প্রবর্তন করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ফ্যাব্রিক ও টেক্সটাইলের মতো দুটি আলাদা শৈল্পিক ঘরানাকে একত্র করার প্রয়াসকে বুঝিয়েছেন। সাধারণত সেলাই, কাটিং ও রান্নার মতো বিষয়গুলো ঘরোয়া ও নারী সম্পর্কিত উপাদান হিসেবে পরিচিত। চিত্রকলায় তারা সে অর্থে ঠাঁই পায়নি। ফলে শাপিরো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিলেন। নারীদের সঙ্গে সম্পর্কিত আপাত ক্ষুদ্র কাজগুলোকেই উচ্চতর শিল্প হিসেবে ভূষিত করেন মিরিয়াম। ভূষিত করেন শিল্পের ইতিহাসে কার্যকরী ও সমৃদ্ধ সংযোজন হিসেবে।

গেরিলা গার্লস 

১৯৮৪ সালে নিউইয়র্কের ‘মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টস’ সমকালীন চিত্রকলা নিয়ে একটি প্রদর্শনী করে। সেখানে ১৬৯ জন শিল্পীর চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হলেও নারী ছিলেন মাত্র ১৩ জন। এর প্রতিক্রিয়ায় ঠিক পরের বছরই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘গেরিলা গার্লস’ নামের একটি সংগঠন। শিল্পের দুনিয়ায় নারীবাদের পক্ষে ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করাকেই নেয়া হয় লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে। শিল্পীরা কাঁধে তুলে নেন নগ্নতা ও বৈষম্যকে সামনে আনার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ শিল্পী ও কর্মীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রচারাভিযানে গ্রাফিক পোস্টার, টাইপোগ্রাফি ও প্রিন্টমাধ্যমের সাহায্য নিতে থাকেন শিল্পীরা। প্রায়ই তারা নিউইয়র্ক সিটিতে বড় বিজ্ঞাপনের স্থানগুলো দখল করে রাখতেন।

বারবারা ক্রুগার 

মার্কিন কনসেপচুয়াল আর্টিস্ট বারবারা ক্রুগার বিশ্বজোড়া পরিচিতি অর্জন করেছেন ডিজিটাল ইনস্টলেশন ও ফটোগ্রাফির জন্য। কর্তৃত্ব, পরিচয় ও যৌনতার পাশাপাশি সৃজনশীল গ্রাফিকসের মাধ্যমে তার কাজ জীবনের ভিন্ন এক মাত্রাকে তুলে ধরে। সামনে আনে গণমাধ্যমের শক্তির কথা। নারী ও নারী সম্পর্কিত বিষয়ে তার কণ্ঠস্বর বরাবরই ছিল উচ্চ। কৌশল ও তির্যক স্লোগানের মধ্য দিয়ে বারবারা সমসাময়িক জীবনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতেন শিল্পকলায়। সামনে আনেন পরিচয়ের রাজনীতিকে, যা পরবর্তী প্রজন্মের নারীবাদীদের জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। 

সারাহ লুকাস 

নব্বইয়ের দশকজুড়ে নারীবাদী আন্দোলন আরো বেগবান হয়। শিল্পীরা আরো ব্যাপকভাবে নারীজীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে ব্যবহার করেছেন বিদ্যমান বৈষম্যকে উন্মোচন করতে। পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়মগুলোকে। সারাহ লুকাস নব্বইয়ের দশকের তরুণ ব্রিটিশ শিল্পীদের একজন। তিনি বিভিন্ন রূপক ও হাস্যরসের মধ্য দিয়ে জোগান দিয়েছেন চিন্তার রসদ। কোলাজ ও ইনস্টলেশনের মাধ্যমে করেছেন বিদ্যমান ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা। তার শিল্পকর্ম হয়ে উঠেছে নারী ও নারীর অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার সুষম মাধ্যম। 

আলেকজান্দ্রা গ্যালাগের

বহুমাত্রিক শিল্পী আলেকজান্দ্রা গ্যালাগের পশ্চিমা সমাজের নারী অভিজ্ঞতা থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। পরে সে অভিজ্ঞতা দৃশ্যমান রূপ দিয়েছেন পরাবাস্তববাদী প্রিন্ট ও চিত্রে। দৃশ্যমান করেছেন সূক্ষ্ম রাজনৈতিক জটিলতাকেও। তার শিল্পকর্মের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই টের পাওয়া যায় অন্তর্নিহিত বার্তা। যেন ঐশ্বর্যময় ও চটকদার শৈলী গভীর অনুরণন নিয়ে সামনে হাজির। আলেকজান্দ্রা গ্যালাগের প্রথাগত ধারাকে অতিক্রম করে বিমূর্ত শিল্পের নজির তৈরির জন্যই বেশি পরিচিত। তার নির্মাণগুলো অদ্ভুত ও অতিপ্রাকৃতের মাধ্যমে মোহিত করে রাখে। প্রতিকৃতিগুলো হাস্যরস ও ট্র্যাজেডির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সংযোগরেখা নির্মাণ করে দেয়।  

অলিভেরা পার্লিক

সার্বিয়ান ভাস্কর অলিভেরা পার্লিক। তিনি প্রচুর প্রতীকী কাজ তৈরি করেছেন, যা নারীর অধিকার নিয়ে নতুন বয়ান সৃষ্টি করে। উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে তার হাতে ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে গৃহস্থালির নিত্য দেখা জিনিসগুলো। সঙ্গে নিয়ে আসে নতুন ও বহুমাত্রিক অর্থ। একজন শিল্পী হিসেবে নারীজীবনের স্বাধীনতা ও সমসাময়িক সমস্যাগুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন তিনি।

মাইকেলা হেনরি-লোয়ি 

জ্যামাইকান শিল্পী মাইকেলা হেনরি-লোয়ি তুলির আঁচড়ে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের প্রতিনিধিত্ব করতে আগ্রহী। আকর্ষণীয় রঙ ও জ্যামিতিক আকারকে সঙ্গে নিয়ে মাইকেলার পেইন্টিংগুলো কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের নিয়ে প্রচলিত মিথ ও ফিকশনকে নাকচ করে; তৈরি করে নতুন পরিচিতি।

ফেমিনিস্ট আর্ট উত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত কম পথ অগ্রসর হয়নি। এখনো যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। তারা শিল্পের মধ্য দিয়ে কেবল নারীর অভিজ্ঞতাকেই সামনে আনছেন না, লিখতে বসছেন নারীর ভাগ্য। যেন শিল্পের দুনিয়ায় কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে চায় নারী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন