সাক্ষাৎকার

যারা রূপ নিয়ে খেলা করেন তাদের মূল্যায়ন হয়নি শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়

ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ

শিল্পী মোস্তফা জামান ১৯৬৮ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন শিল্প সমালোচক। নব্বইয়ের দশক থেকে প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোর জন্য ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় অসংখ্য শিল্প সমালোচনা, শিল্পকলাবিষয়ক প্রবন্ধ লিখছেন। ২০১০ থেকে ২০১৭ সালে তিনি দৃশ্যশিল্পবিষয়ক ম্যাগাজিন ডেপার্ট-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিজস্ব শিল্পচর্চা ছাড়াও তিনি দেশে অনেক উল্লেখযোগ্য শিল্প প্রদর্শনীর কিউরেটর হিসেবে কাজ করেছেন। দেশে ও বিদেশে অনেকগুলো একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। আন্তর্জাতিক শিল্পবিষয়ক ম্যাগাজিনেও প্রকাশ হয়েছে তার লেখা। জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ও দেশের শিল্পচর্চার রাজনীতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন মো. বজলুর রশিদ শাওন

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রদর্শনীগুলোয় শিল্পকর্ম আহ্বান এবং পুরস্কার দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে মাধ্যমভিত্তিক শিল্পকর্ম আহ্বান করা হয় এবং সেভাবেই পুরস্কৃত করা হয়। এর কারণ কী বলে মনে করেন আপনি?

এ প্রদর্শনীগুলো যখন শুরু হয় তখন কিন্তু এ রকম ছিল না। এটা ফিরে এল বলা যায়। সত্তর-আশির দশকে আমরা শহীদ কবির, রতন মজুমদারের মতো শিল্পীদের যে ধরনের শিল্পকর্মের জন্য পুরস্কৃত হতে দেখেছি সেখানে শিল্পকর্ম মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ছিল না। বরং যতগুলো কাজ (শিল্পকর্ম) জমা পড়ত সেখান থেকে সবচেয়ে ভালো কাজগুলোই বেছে নেয়া হতো। কে কোন মাধ্যমে কাজ করেছেন সেটা দেখা হয়নি। যে কারণে শিল্পী শহীদ কবিরকে পুরস্কৃত হতে দেখেছি এগ টেম্পেরা মাধ্যমের কাজের জন্য, যেটা তখনো খুব পরিচিত বা বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম ছিল না। এমনকি রতন মজুমদারের পুরস্কার পাওয়া উডকাটের কাজও ট্র্যাডিশনাল উডকাট ছিল না। 

এটা মূলত পেডাগোজিক্যাল (শিক্ষা ব্যবস্থার) প্রবলেম। যেই শিক্ষাটা চারুকলায় দেয়া হচ্ছে এখানে এসেও সেটারই প্রতিফলন ঘটছে। আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন করে রেখেছি যেখানে মনে করা হয়ে থাকে ন্যাচারালিজমই হচ্ছে বাংলাদেশী শিল্প। অথচ ন্যাচারালিজম তো এ অঞ্চলের না। যেই ন্যাচারালিজম আমরা মুঘল মিনিয়েচারে দেখি সেটা এক ধরনের ন্যাচারালিজম কিন্তু এর আরেকটা দিক তো আমরা আরো ভালোভাবে ইউরোপিয়ানদের কাছ থেকে শিখেছি। যেটাকে সাধারণত পেইন্টিং বলা হয়। ভারতীয় শিল্পভাষা তৈরির নামে যখন বেঙ্গল স্কুল প্রভাবশালী হয়ে উঠছে তখন হেমেন মজুমদারের মতো অনেক শিল্পীই সেটার বিরোধিতা করলেন। ‘ছবির চশমা’ নামে তিনি (হেমেন মজুমদার) বইও লিখেছেন ন্যাচারালিজমের পক্ষে। কোনটা আমাদের আর কোনটা আমাদের শিল্প না, এ দ্বন্দ্ব থেকে তো আমরা কিছু শিখলাম না। বরং এই দুইটা ভিন্ন ধারাকে পাশাপাশি রেখেও যে এগোনো যায় সেটা শান্তিনিকেতনে প্রথম দেখা গেল। অর্থাৎ আমরা ইউরোপীয় স্কুলিংয়ের ন্যাচারালিজম থেকেও যেমন শিখতে পারি, তেমনি এটা ভেঙেচুরে ইউরোপে কিউবিজমের মতো যা কিছুর উৎপত্তি হয়েছে সেখান থেকেও শিখতে পারি। শিক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাছবিচার করার দরকার নেই। খেয়াল রাখতে হবে বিভিন্ন জায়গা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা স্থানিক সত্যের বা বাস্তবতার জায়গাটা বুঝে বা না বুঝে কিংবা কম বুঝে নতুন কিছু করতে পারছি কিনা। কারণ শিল্পীরা তো সবাই একই পদ্ধতিতে কাজ করেন না। অনেকেই অনেক ভেবেচিন্তে কাজ করেন, আবার অনেকেই আছেন স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে কাজ করেন। ফলে স্থানিকতা নির্মাণের কোনো নির্দিষ্ট ফর্মুলা হয় না। শিল্পের ভাষা কীভাবে নবায়ন হয় এরও কোনো সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। পাশ্চাত্যে নানা প্রকার শিল্প আন্দোলন হয়েছে এবং তাদের শিল্পকলার বিকাশও এসব আন্দোলনের মাধ্যমে এগিয়েছে কিন্তু আমাদের এখানে সে রকম কোনো আন্দোলন হয়নি। বরং ব্যক্তি শিল্পীরা এ ধরনের চর্চা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যেমন কামরুল হাসান একই সঙ্গে দুটি ধরনকে নিয়ে এগিয়েছেন। একদিকে পিকাসোর কিউবিজমের ভাঙাচোরা, অন্যদিকে আমাদের সরাচিত্রের সুন্দর রেখা, যেগুলো ডিজাইন হিসেবেও ব্যবহার করা যায় সেটাও নিয়েছেন। কিন্তু যেভাবে সেটার ব্যবহার করেছেন তা শুধু ঐতিহ্য সন্ধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। একধরনের নিজস্বতা তৈরি করেছেন। কিন্তু এ ধরনের যেসব প্রতিভাবান শিল্পী আমাদের শিল্পভাষার ক্ষেত্রে নবায়ন ঘটাতে পেরেছেন তাদের এ পদ্ধতি বা প্রক্রিয়াকে আমাদের শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিশ্লেষণ করা হয়নি। এমনকি এগুলো বুঝে এখানকার কারিকুলামও সাজানো হয়নি।

আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার মূল সংকট হলো আমরা পাশ্চাত্য থেকেও পুরোপুরি শিখলাম না। বরং কলোনিয়াল পিরিয়ডে যা শিখলাম সেখানেই রয়ে গেলাম। রবীন্দ্রনাথ যখন একটা নতুন শিল্পভাষার জন্ম দিলেন যেখানে বীভৎস, হাস্য থেকে শুরু করে অনেক ধরনের রস ছিল। অথচ তখন অনেকেই বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথ ন্যাচারালিজম পারতেন না। অর্থাৎ ন্যাচারালিজম না জানলে ছবি হয় না। এটাই মূল সমস্যা। একটা নির্দিষ্ট লেন্স থেকে শিল্পকর্ম মূল্যায়ন করা। কলোনিয়াল শিক্ষার যে ধারা সেটার মধ্যেই রয়ে গেলাম আমরা। সত্তরের দশকে নতুন দেশে আমরা চাইলেই মাধ্যমভিত্তিক শিল্পের এ ধারা থেকে বের হতে পারতাম। যদিও সেই সময় আমরা পার করে এসেছি। কিন্তু এখনো সেই সুযোগ রয়েছে।

আপনি বললেন যে পাশ্চাত্যের শিল্পচর্চা বিভিন্ন রকমের শিল্প আন্দোলনের মাধ্যমে এগিয়েছে, কিন্তু আমাদের এখানে তা হয়নি। এর কারণ কী বলে মনে হয় আপনার? সত্তরের দশকে ঢাকা পেইন্টার্স ও আশির দশকে সময় গ্রুপের আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।  

আমাদের দেশের শিল্পচর্চা যতটুকু এগিয়েছে সেখানে ব্যক্তি শিল্পীর প্রভাবই বেশি। সুনির্দিষ্ট সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, সংকট কিংবা সম্ভাবনা চিহ্নিত করে এখানে সে রকম কোনো শিল্প আন্দোলন হয়নি। সময় গ্রুপ একটা রাজনৈতিক বাস্তবতা দেখাতে পেরেছেন—এরশাদের সামরিক সরকারের শাসন। কিন্তু ঢাকা পেইন্টার্সের ক্ষেত্রে এ রকম কিছু ছিল না। বরং ঢাকা পেইন্টার্সের মধ্য থেকে তরুণ ঘোষ ব্যক্তি শিল্পী হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেন। তিনি যে বিমূর্ততার দিকে গেলেন তা পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকে আমাদের দেশে চর্চিত বিমূর্ততার যে ধরন ছিল সেগুলো থেকে অনেক ভিন্নতর। কিন্তু তার এ ধরনকে গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃতি দেয়া হলো না। এমনকি কালিদাস কর্মকার এচিং মাধ্যমের মধ্যে যে ধরনের নতুনত্ব আনলেন সেটাকে স্বীকৃতি দেয়া হলেও শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেটাকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হলো না। অর্থাৎ কালিদাস কর্মকার যেভাবেই হোক মেইনস্ট্রিমে ঢুকতে পারলেন। (তার কাজ কোথায় কোনদিকে যেতে পারত সেটা নিয়ে সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু উনি তো কতগুলো নতুনত্ব দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন) উনি একই সঙ্গে মাধ্যমভিত্তিক শিল্পচর্চা এবং রূপ নির্মাণের ক্ষেত্রে মূর্ত-বিমূর্ততার যে দ্বিত্বতা সেখান থেকে বের হয়ে গেলেন। একজন শিল্পীকে কোন বাস্তবতায়, কেন এটা করতে হয় তা নিয়ে আমাদের শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কোনো আলাপ-আলোচনা হলো না, তার কাজের ধরন মূল্যায়ন করে থিয়োরাইজ করা কিংবা এটার পক্ষে একটা বয়ান তৈরি করে সেটাকে বিদ্যায়তনে নিয়ে আসার যে প্রয়োজন ছিল সেটাও প্রতিষ্ঠানগুলো উপলব্ধি করতে পারেনি অথবা ওই দেশজ ধারার নামে বিশুদ্ধতাবাদী চর্চাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এ ধরনের শিল্পীদের অবদানকে এড়িয়ে যাওয়া হলো। এক্ষেত্রে আমি বলব আমাদের শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের বিদ্যায়তনিক জায়গায় নতুন বিদ্যার উৎপাদন একেবারেই হয়নি। সেটা মাধ্যমভিত্তিক শিল্পচর্চার ধারা না ভেঙেও করা যেতে পারত। কিন্তু নতুন বিদ্যার দরকার ছিল। পেইন্টিং শুধু অয়েল পেইন্টিং না হয়ে হাইব্রিড পেইন্টিংও হতে পারত। আমরা জিএস কবিরকে দেখেছি কীভাবে থ্রি ডাইমেনশনাল অবজেক্টকে টু ডাইমেনশনাল পেইন্টিংয়ের মধ্যে সেঁটে দিয়ে কাজ করেছেন। এমনকি চারুকলায় এ রকম কিছু কাজ শুরুও হয়েছিল। যেমন শিল্পী মাহমুদুল হক যখন জাপান থেকে ফিরে এলেন তখন আমাদের কম্পোজিশনের ক্লাসে থ্রি ডাইমেনশনাল কাজ করতে বলেছিলেন। কাগজ, বোর্ড ইত্যাদি ম্যাটেরিয়ালস দিয়ে কিন্তু সেটা যেন আর্কিটেকচারাল ফর্ম না হয়ে যায়। এ ধরনের চর্চাকে কখনই উৎসাহিত করা হয়নি। 

আমাদের শিল্প শিক্ষাপ্রতিঠানগুলো যে এ ধরনের চর্চাকে নিরুৎসাহিত করল এর কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?

মূল কারণ হলো পরবর্তী সময়ে যারা চারুকলার কর্ণধার হয়ে উঠলেন তারা এ পরিবর্তনগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। একই সঙ্গে তারা এখানে দেশজ বলে এক ধরনের ধারা তৈরিতে বিশেষ মনোযোগ দিলেন, যেটা আসলে কোনো কাজে এল না। আমি এমন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের কাজ দেখছিলাম। তার ল্যান্ডস্কেপ টাইপের খুব চমৎকার কিছু কাজের মধ্যে কয়েকটা দুর্বল কাজ দেখতে পেলাম। সেই দুর্বল কাজ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন যে তার শিক্ষকরা দেশজ এলিমেন্টস নিয়ে কাজ করতে বলেছেন। আমি তাকে বললাম, ‘আপনি তো দেশজ করতে গিয়ে নিজের সম্ভাবনাকে মেরে ফেলছেন।’ অর্থাৎ এই যে জোর করে দেশজ বলে কিছু একটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা সেটা আমাদের শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরেকটা বড় সমস্যা। দেশজ তো এমনিতেই হবে। আমি যদি কিউবিস্ট স্টাইলে কাজ করি এবং সেটা যদি ইউরোপীয় কিউবিজমের চেয়ে খুব দুর্বল কিছু হয় তাহলে তো সেটা টিকবে না, আর যদি ভালো কিছু হয় তো সেটা এখানকার বা এদেশীয় কিউবিজমই হবে। এক্ষেত্রে আমরা আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরীর কাজের উদাহরণ সামনে আনতে পারি। অর্থাৎ যারা রূপ নিয়ে খেলা করেন বা রূপের লীলার মধ্যে থাকেন তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি আমাদের শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। ভাস্কর রাশা এ রকম আরেকজন। যার কাজ চারুকলার ভাস্কর্য চর্চার যে ধারাবাহিকতা সেখান থেকে আলাদা। রাশার ভাস্কর্যের ভাষা তার নিজস্ব। বরং দেশজ আর বিদেশী এবং মূর্ত আর বিমূর্ততার দ্বিত্বতার মধ্যে থাকতে গিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আর এগোয়নি। 

আপনি কি তাহলে বলতে চাইছেন জাতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনীতে শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চর্চিত ধারার প্রতিফলন ঘটল?  

আগেও বলেছি যে এটা আশির দশক পর্যন্ত ছিল না। ৯০ দশকের শেষ থেকে শুরু হলো এবং নতুন মিলেনিয়ামে এসে এটা বেশি দেখা গেল। শুরুর দিকে এটা থাকলেও নতুন ভাষা বা শিল্পরূপ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অতটা বৈষম্য দেখা যেত না। দুটো উদাহরণ দিই, অনেক আগে শিল্পী কালিদাস কর্মকারের একটা কাজ শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারির দেয়াল থেকে নামিয়ে নিচে রাখা হয়েছিল। খুব সম্ভবত চিন্তামনি কর সেটা দেখে বলেন যে"‘এটা তো ভালো কাজ’," তখন আবার সেটা টানানো হয়েছিল। অথচ সাত-আট বছর আগের কথা শিল্পকলা একাডেমিতে একটা হ্যাংগিং স্কাল্পচার দেখেছিলাম পেপার দিয়ে পরতে পরতে কাজ করা আবার সেই পেপারে ড্রয়িংও ছিল। আমি বললাম"এটা তো সেরা পুরস্কার পাওয়ার মতো কাজ। কিন্তু আমার সঙ্গে যারা ছিলেন তারা কেউই রাজি হলেন না। তাদের প্রশ্ন ছিল এ রকম—কী এমন কারিগরি আছে এখানে যে এটাকে সেরা পুরস্কার দিতে হবে? অর্থাৎ কারিগরি দক্ষতার জায়গাটা তাদের বিচারের মানদণ্ড ছিল। কারিগরি দক্ষতার ছাপ না থাকলে সেটাকে ভালো শিল্পকর্ম কিংবা পুরস্কার দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের আপত্তি ছিল। এমনকি এখনো অনেকেই এ পদ্ধতিতে শিল্পকর্ম বাছাই করে থাকেন। 

আপনি বলেছেন যে ৯০ দশকের শুরুর সময় পর্যন্তও শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রমের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তাহলে কীভাবে বা ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় এখনকার অবস্থায় উপনীত হলো?   

অবশ্যই শিল্পকলা একাডেমির শুরুর দিককার কর্মকাণ্ড যথেষ্ট ভালো ছিল বলতে হবে। বিশেষ করে শুরুর দিকে যে ধরনের প্রকাশনা হতো সেখানে অনেক কিছু ছিল মানসম্মত। তারপর এশিয়ান আর্ট বিয়েনালের মতো প্রদর্শনীরও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে আমাদের দেশের শিল্পকলায়। এশিয়ান বিয়েনালের মাধ্যমে আশির দশকে আমরা প্রথমবারের মতো ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমের কাজ দেখলাম। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের ইন্সটলেশন এবং ভিডিও আর্ট। মনে আছে অতুল দোদীয়ার কাজও আমরা প্রথম ওখানেই দেখলাম। তখন এত ভালো বুঝতাম না কিন্তু মুগ্ধ হয়ে সেসব কাজ দেখতাম। এখনো মনে আছে বাঁশের কাঠামো দিয়ে একটা ইন্সটলেশন দেখেছিলাম যেটা দেখতে ভালো লাগছিল না কিন্তু কাছে যাওয়ার পর যখন সাউন্ড কানে এল তখন বেশ অবাক হলাম। এই যে সাউন্ড ইন্সটলেশন এ সম্পর্কে কোনো ধারণাও ছিল না এর আগে। এটা শুধু আমি না ওই সময়ে আমাদের মতো অসংখ্য তরুণ শিল্পীর ওপর অনেক প্রভাব ফেলেছিল। জাপান তখন খুব গুরুত্বের সঙ্গে এখানে অংশগ্রহণ করত, তাদের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের শিল্পকর্ম এখানে পাঠাত।  কিন্তু আস্তে আস্তে জাপান সেটা বন্ধ করে দিল। শুনেছি এখানকার অব্যবস্থাপনার কারণে যে প্রক্রিয়ায় জাপানের শিল্পীদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছিল সে কারণেই তারা নিজেদের সরিয়ে নেয়। 

এমন এমন এজেন্ডা বাস্তবায়ন হতে দেখেছি যেটা শিল্পকলা একাডেমির কাজের সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ না। যেমন আমরা যদি চিন্তা করি বায়ান্ন, একাত্তর নিয়ে বড় বড় ইন্সটলেশন, ভাস্কর্য তৈরি করব সেটা কিন্তু করতে পারতাম। অথচ যেটা হলো সেই ‘ভাবমূর্তিবাদিতা’। যেমন রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ওয়ার্কশপের মাধ্যমে পোর্ট্রেট করা । এর শুরুটা হলো রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট ওয়ার্কশপের নামে। অথচ রবীন্দ্রনাথের ইথোস নিয়ে কোনো চর্চা হয়নি। তারপর শেখ মুজিবের পোর্ট্রেট, এমনকি সেখানেও থেমে থাকেনি, শেষমেশ এল শেখ হাসিনার পোর্ট্রেট। এই যে ভাবমূর্তিবাদিতা এটা তো শিল্পকলা একাডেমির কাজ না। এটা আওয়ামী লীগ দল হিসেবে করলে ঠিক আছে। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব এটা না। এমনকি গত সাত-আট বছরে যেসব প্রকাশনা হলো সেগুলোর বেশির ভাগই কিন্তু শেখ মুজিবকেন্দ্রিক। আমাকে কিছুদিন আগে একটা পেপার রিভিউ করতে দিয়েছে শিল্পকলা একাডেমির জার্নালে প্রকাশের জন্য—বাংলাদেশে শিল্পকলার বিকাশে শেখ মুজিবের কী ভূমিকা সেটা নিয়ে লেখা। জোর করে তার অবদান দেখানোর চেষ্টা। এটা যিনি লিখেছেন তিনি ওখানকার কর্মকর্তা, তার প্রমোশনের জন্য হয়তো এটা সাহায্য করত কিংবা তিনি হয়তো নেক নজরে থাকবেন সেই বিবেচনা থেকেই লিখেছেন। আমাকে কয়েকবার ফোন করা হয়েছিল এটার অ্যাপ্রুভল দেয়ার জন্য। আমি দিইনি। কারণ ওই পেপারে কী কী সমস্যা আছে তা আমি আগেই লিখে জানিয়েছিলাম। এদের গবেষক বানিয়ে রাখা হয়েছে। ইডিওলজিক্যাল কিছু কিন্তু করা হয়নি, যা রাষ্ট্রীয় চিন্তার স্তরে কাজে লাগতে পারে। আসলে ভাবমূর্তিবাদিতার মধ্যে ইডিওলজি থাকে না।

নেপোটিজম (স্বজনপ্রীতি) আরেকটা সমস্যা। এ নেপোটিজমের কয়েকটা উদাহরণ দিই। আমি যখন ডেপার্টে কাজ করতাম তখন একজন শিল্পী আমাকে এসে বললেন যে ‘অমুক জায়গায় একটা মিটিং হচ্ছে যেখানে ঠিক করা হচ্ছে এবারের এক্সিবিশনে কে পুরস্কার পাচ্ছে’৷ অর্থাৎ শিল্পকর্ম দেখে বা না দেখে ক্লোজড মিটিংয়ে কে বা কারা পুরস্কার পাবেন সেটা ঠিক করা শুরু হলো। এমনকি এ রকমও ঘটেছে যে চট্টগ্রামের একজন শিল্পীকে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে শুনে ঢাকার শিল্পীরা তাদের কাজ উঠিয়ে নিচ্ছেন। তারপর অমুকের কাজ প্রদর্শনীতে রাখতেই হবে কারণ তিনি চারুকলার অমুক ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। অর্থাৎ আঞ্চলিক ও অবস্থানগত নেপোটিজমের চর্চাও হয়েছে লম্বা সময় ধরে। ফলে জুরি বোর্ড বা বিচারকরা আর নিরপেক্ষ থাকতে পারলেন না।

দলীয়করণ আরেকটা সমস্যা। আমি নিজেও শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে একটা বিয়েনালে কাজ করেছি কিন্তু স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব হয়নি। আমি তিন মাসের মতো কাজ করতে পেরেছিলাম। সেটা মুজিব শতবর্ষে। সেখানে শিল্পী মনজুরের কিউরেশনে যে অংশটা হয়েছিল সেটা যথেষ্ট ভালো হলেও ব্যুরোক্র্যাটরা সেটা দেখে খুশি নন। কারণ তারা শুধু ফোকাসড ছিলেন মুজিব শতবর্ষে ১০০টা দেশের অংশগ্রহণ করানো নিয়ে। কাজের মান কী হবে সেটা নিয়ে তারা চিন্তিত নন। আমি আন্তর্জাতিক অনেক ভালো ভালো বিয়েনালেও দেখেছি যেখানে ৩০-৪০টার বেশি দেশের অংশগ্রহণ থাকে না। অর্থাৎ এই দলীয় ব্যুরোক্র্যাটরা কোয়ালিটির (গুণগত মানের) চেয়ে কোয়ান্টিটি (সংখ্যা) নিয়ে বেশি আগ্রহী। এমনকি এদের উক্তিও বড় বড় করে টানানো হলো সেখানে যেগুলো প্রদর্শনীর সঙ্গে সম্পর্কিত না এবং যেভাবে উপস্থাপন করা হলো সেটাও দৃষ্টিকটু। এটা বিগত সরকারের সময় থেকে বেশি করে হতে থাকল। এদের আর্টের বোঝাপড়া নেই অথচ গুরুত্বপূর্ণ সব পদে বসে থাকলেন লম্বা সময় ধরে। যেমন সর্বশেষ যিনি ডিজি ছিলেন উনি  নাটকের মানুষ এবং নাটকেও তিনি ঐতিহ্যের খোঁজ করেন। নাটকের মধ্যে ঐতিহ্য সন্ধানে কতটা এগোনো যাবে সে বিষয়ক ব্যাখ্যা হয়তো দিতে পারবেন কিন্তু ভিজ্যুয়াল আর্টের ক্ষেত্রে কী দিতে পেরেছেন বা পারবেন? শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজই হলো আপনি পুরাতন চর্চার ধরন থেকে নবায়ন ঘটাতে পারেন কিনা। সেই নবায়নের প্রসঙ্গে ব্লাইন্ড হলে তো মুশকিল। আর এটা ঘটে আপনি যখন পুরনো জ্ঞান দিয়ে নতুন কোনো কিছুকে বিচার বা মূল্যায়ন করতে যান।

গণ-অভ্যুত্থানের পর এখন তো সবখানে সংস্কারের কথা আলোচনায় আসছে। আমাদের শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিল্পকলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে আপনি কী কী সংস্কারের প্রস্তাব করতে চান? 

যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিল্পকলা একাডেমি যাচ্ছিল সেটাই ফিরে আসুক। দলীয়করণ, নেপোটিজম এগুলো বন্ধ করা হোক। চারুকলার পড়ন-পঠন পদ্ধতি হয়তোবা রাতারাতি বদলানো যাবে না, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরোক্রেটিক প্রসেস অনেকগুলো ধাপ মেনে সম্পন্ন হয় কিন্তু শিল্পকলা একাডেমির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব। শিল্পকলা একাডেমির দেশব্যাপী যে কর্মকাণ্ড ছিল সেটা ফিরিয়ে আনতে হবে। ভাবমূর্তিবাদিতা থেকে বের হয়ে নতুন করে সব কর্মকাণ্ডের বিন্যাস করতে হবে। যাতে রাষ্ট্রীয় চিন্তার স্তরে সেগুলো কাজে লাগানো যায়। ঐতিহ্য এবং নতুন ধারণার ক্ষেত্রে পুনরায় ভাবতে হবে। যেমন ভারতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরের গ্যালারিগুলোয় যখন চেঞ্জ এল তখন একাডেমিগুলোও চেঞ্জ করতে বাধ্য হলো। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সেলিমা হাশমীও উদাহরণ হিসেবে আসতে পারেন। তার প্রতিষ্ঠানেও সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে যায়। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরেও যেসব প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা নিয়ে কাজ করে তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তারপর শিল্পকলায় যেসব সেমিনার হয়, আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স করানো হয় সেখানে যদি শিল্পের নতুন ধারণা ও পদ্ধতির সঙ্গে নবীন শিল্পীদের পরিচিত করানো হয় তাহলে তারাও আগ্রহী হয়ে উঠবে। সেমিনারে, প্রকাশনায় শিল্পী কামরুল হাসান, এস এম সুলতানদের মতো শিল্পীদের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু, তার ভাষা বা প্রকাশভঙ্গি ইত্যাদির ওপর গবেষণা করে সেগুলো প্রকাশ করা হয় তখন নবীন শিল্পীরাও গুরুত্ব বুঝতে পারবেন, এগিয়ে যেতে সাহস পাবেন এবং শিল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এর প্রভাব পড়বে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন