সুলতানি বাংলায় শিল্পের সিনথেসিস

আহমেদ দীন রুমি

ছবি: ব্রিটিশ লাইব্রেরি

চিত্রকলায় বাংলার ইতিহাস প্রাচীন। গৌতম বুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে যে এখানে শিল্পচর্চা হতো, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ নেই। তবে প্রাচীন বাংলার চিত্রকলা বলতে পাল আমলের সমৃদ্ধ পুথিচিত্রের কথা আসে সবার আগে। পাল শাসনের অবক্ষয় ও পতনের পর ক্রমেই যে শূন্যতা তৈরি হতে থাকে, তা ঘনীভূত হয় সেন আমলে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়াতেই বাংলায় শুরু হয় তুর্কি শাসন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে শিল্পচর্চার ধরনেও।   

চতুর্দশ শতাব্দীতে দিল্লির শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। সুযোগ বুঝে বিদ্রোহ করতে থাকেন আঞ্চলিক শাসকরা। বাংলা ছিল বিদ্রোহের প্রথম কাতারে। যেহেতু আগে থেকেই একটা স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরম্পরা ছিল; দিল্লি থেকে বাংলার দূরত্বও ছিল অনেক। ফলে সুলতানি আমলজুড়েই বাংলা স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে জানান দিতে চেয়েছে দফায় দফায়। স্বাতন্ত্র্যের সে স্বাক্ষর বিম্বিত হয় চিত্রকলায়ও। মূলত সুলতানি বাংলার চিত্রকলায় ছিল মিথস্ক্রিয়ার প্রবণতা। প্রাচীন বাংলায় পাল আমল ছিল মিনিয়েচার চিত্রকলার স্বর্ণযুগ। বৌদ্ধ পুথিচিত্রের সিলসিলা সুলতানদের আমলে নতুন ধারার মিনিয়েচার হিসেবে যাত্রা করে। পাশাপাশি শাসক ও অভিজাতদের হাত পৌঁছেছিল পারসিক চিত্র শিল্পের ধারায়। চীনা পরিব্রাজক মাহুয়ান লিখে গেছেন বাংলার শহরগুলোয় পেশাদার শিল্পীদের কথা। তাদের মধ্যে মধ্য এশিয়ার শিল্পীদের থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সুলতানি বাংলায় চিত্রকলাচর্চার শ্রেষ্ঠ নজির ‘শরফনামা’ পাণ্ডুলিপির মিনিয়েচার। হোসেনশাহি সুলতান নাসির উদ্দিন নুসরত শাহর (১৫১৯-৩২ খ্রিস্টাব্দ) আমলে তৈরি হয় পাণ্ডুলিপিটি, বর্তমানে রক্ষিত আছে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে।

বইয়ের প্রতি আগ্রহ মুসলিম দুনিয়ায় প্রথম দিক থেকেই। কোরআনের আয়াত ক্যালিগ্রাফি করার জন্য বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন দেয়ার রেওয়াজ শুরু হয় তখনই। ক্রমে আরবি হরফ আলংকারিক চরিত্র অর্জন করে। ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যুক্ত হয় আরবীয় লতা ও ফুলের নকশা। দিনকে দিন ঐতিহাসিক কাহিনীও পেল চিত্ররূপ। উজ্জ্বল বর্ণে রঞ্জিত ছবিগুলো পাণ্ডুলিপির গৌরব ও মূল্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিল। দক্ষ লিপিকার ও নিপুণ শিল্পীর দ্বারা লিখিত ও সজ্জিত এসব মূল্যবান গ্রন্থের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ধনী ও রুচিসম্মত অভিজাতরা। একদিকে পারস্য প্রাচীনকাল থেকেই শিল্পকলায় সমুন্নত। অন্যদিকে বাইজেন্টাইন অধিকারের পর সেখানকার চিত্রকলাও আকৃষ্ট করল মুসলিম চিত্রকরদের। মধ্য এশিয়ার তুর্কমানরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে যুক্ত হলো চীনা চিত্ররীতির পরম্পরা। এভাবে অন্ততপক্ষে তিনটি শিল্পধারার সংযোগের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠল মুসলিম মিনিয়েচার ঐতিহ্য। পারসিক সে শৈলীর ধারাই এসে পৌঁছেছিল বাংলায়। 

নুসরত শাহর আমলে গৌড়ের সুলতানি দরবারে আহূত হয়েছিলেন সুদূর পারস্যের শিল্পী। তার কিছুদিন পরই সাফাভি সম্রাট শাহ তাহমাস্প চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকতা ত্যাগ করেন। শিল্পের প্রতি আতিশয্যকে ইন্দ্রিয়পরায়ণতাজাত মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ মনে করতেন তিনি। সাফাভি দরবার থেকে অনেক শিল্পীই বাধ্য হয়ে নানাদিকে ছড়িয়ে পড়েন। সাফাভি শৈলীর অন্তত চারজন শিল্পী মির মুসাব্বির, মির সৈয়দ আলি, দোস্ত মুহম্মদ ও আব্দুস সামাদ মোগল সম্রাট হুমায়ুনের দরবারে আসেন। ফলে এ কথা বেশ চমৎকৃত হওয়ার মতো যে মোগল চিত্রকলায় দিল্লি বিকশিত হওয়ার বহু আগেই বাংলায় পারসিক শিল্পীদের পোষকতা মিলেছিল এবং স্বতন্ত্র স্বাক্ষর নিয়ে বিকশিত হয়েছিল। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর পুত্র সুলতান সিকান্দার ছিলেন সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহর আমলে অনেক পারসিক কবি ও চিত্রশিল্পী বাংলায় এসেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। হোসাইন শাহি আমলে সে পৃষ্ঠপোষকতার ঐতিহ্য আরো দৃঢ় হয়। 

‘শরফনামা’ নিজামি রচিত ইসকান্দারনামার অংশ। সুলতান নুসরত শাহর জন্য ১৫৩১-৩২ সালের দিকে অনুলিপি করেছিলেন হামিদ খান। ইসকান্দার তথা আলেকজান্ডার পারসিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রভাবশালী চরিত্র। একই সঙ্গে তাকে দার্শনিক, আদর্শ শাসক ও বিশ্ববিজেতা হিসেবে দেখা হতো। তাকে নিয়ে লিখেছেন মহাকবি ফেরদৌসী, নিজামি, আমির খসরু ও জামি। এদিকে অবিভক্ত বাংলার প্রথম সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নিজেকে দ্বিতীয় ইসকান্দার দাবি করেছেন। মধ্যযুগীয় সাহিত্যেও সিকান্দারনামা যথেষ্ট সমাদৃত। স্বাভাবিকভাবেই সিকান্দার সম্পর্কে বাংলার ধারণা ছিল স্পষ্ট। সুলতান নুসরত শাহ কর্তৃক সিকান্দারনামার প্রথমার্ধ তথা শরফনামার মিনিয়েচার তৈরির নির্দেশনা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। 

৭২ পাতাবিশিষ্ট শরফনামার পাণ্ডুলিপিতে চিত্রকর্ম অঙ্কিত আছে নয়টি। দুর্ভাগ্যবশত কোনো ছবিতেই শিল্পীর নাম নেই। ফলে ছবিগুলো কার আঁকা তা জানা যায় না। ছবিগুলো পারসিক চিত্রধারায় অঙ্কিত হলেও বাংলার স্থানীয় প্রভাব লক্ষ করা যায়। রূপনির্মিতির সারল্যে, বিশেষত পাতা কাটা খিলান, ছত্রি ও নানা বর্ণের টালির অলংকরণ সমন্বিত স্থাপত্যের সুমিত ব্যবহারে এবং বৃক্ষের রীতিসিদ্ধ রূপায়ণে তখনকার বাংলার পরিবেশ শিল্পীর রূপভাবনায় কাজ করেছিল বলে মনে হয়। পাণ্ডুলিপিটি একদিকে স্বর্ণখচিত, অন্যদিকে ব্যবহার করা হয়েছে উজ্জ্বল রঙ। চিত্রকর্মের প্রতিটিই অবস্থিত লাইনগুলোর মাঝখানে। চিত্রকর্মের নায়ক ইসকান্দার। কখনো তাকে যুদ্ধের মাঠে দেখা যায়, কখনো সিংহাসনে আরোহণ করা অবস্থায়। 

কিছু ক্ষেত্রে শরফনামায় ইরানীয় মিনিয়েচারের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। পাতার কাঠামো উল্লম্ব, চার কলামে টেক্সট এবং লেখার ভেতরে চিত্রকর্ম প্রভৃতি সেখানে প্রধান। কিছু বৈশিষ্ট্য চতুর্দশ শতাব্দীর সিরাজ ঘরানার চিত্রকর্মের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে মেঘ আর আকাশ আঁকার ধরনে রয়েছে নিজস্বতা। নিচের দিকের মানুষ কিংবা প্রাণীর অবয়বকে ছোট করে আঁকার বৈশিষ্ট্যও অনেকটা নিজস্ব। পাণ্ডুলিপিতে আঁকা ভবনে দেখা যায় তৎকালীন বাংলার স্থাপত্যকলার ছাপ। বাংলাদেশের বাঘা মসজিদের স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে শরফনামায় ইসকান্দারের পেছনকার দেয়ালের কর্মে সাদৃশ্য ঢের। একদিকে ইরানীয় ঘরানাকে যেমন অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তেমনি বিকশিত হয়েছে হিন্দুস্তানি ঘরানাও। সার্বিক বিচারে শরফনামাকে পরীক্ষামূলক কোনো পুস্তক বলে মনে হয় না; বরং মনে হয় এটা সৃজনশীল ও পরিণত সৃষ্টি। ফলে এর আগে এ রকম চিত্রচর্চার ধারা থাকা খুবই স্বাভাবিক। এটা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়, এ ধরনের চিত্রকলার চর্চা সুলতানি যুগের প্রথম দিক থেকেই চলে আসছিল। সমকালীন মালবে অঙ্কিত ‘নিমতনামা’র সঙ্গে তুলনা করেও দেখা যায় ‘শরফনামার’র চিত্রকর্ম উৎকৃষ্টতর। শরফনামার অস্তিত্বই প্রমাণ করে, তার আগেও শতাধিক বছর ধরে চিত্রকর্মের নিজস্ব ঘরানা তৈরি হয়েছিল বাংলায়। 

শরফনামা যেন একই সঙ্গে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যকার সিনথেসিসের দলিল। বাংলায় মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগেই এখানে সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার যাত্রা হয়ে গিয়েছিল। অনেক পরে আকবর যে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে দিল্লিতে পরিচিতি অর্জন করে, বাংলায় আগেই সেটা করেছেন নুসরত শাহ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন