ডেভিড

সাহস-স্বাধীনতা-সৌন্দর্যের প্রতীক

রুহিনা ফেরদৌস

১৫০৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ফ্লোরেন্সের নাগরিকদের জন্য উন্মোচন করা হয় মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড ছবি: একাডেমিয়া গ্যালারি

প্রথমবার ফ্লোরেন্সে পা রেখে মনে হবে ভুল করে কোনো আর্ট মিউজিয়ামে ঢুকে পড়েছেন। আন্দ্রেয়া দেল ভেরোক্কিও, ফিলিপ্পো লিপ্পি, সান্দ্রো বত্তিচেল্লি, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, রাফায়েলের মতো মায়েস্ত্রোরা একসময় একই শহরে ছিলেন। ইতালীয় রেনেসাঁর কেন্দ্র ফ্লোরেন্সে এখনো সে সময়ের ছোঁয়া পাওয়া যায়। তাই শহরে ঢোকার পর আপনাকে নাছোড়বান্দার মতো তাড়া করবে মাইকেলেঞ্জেলো আর লরেনজো দি’মেদিচি। একজন শিল্পী, অন্যজন পৃষ্ঠপোষক। ফ্লোরেন্সের অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে মেদিচি-মাইকেলেঞ্জেলোর সময়-স্মারক। 

ইতালির রেনেসাঁর প্রভাবশালী পরিবার মেদিচি। ১৫০০-১৭০০ শতকে তারা ফ্লোরেন্স শাসন করেছেন। ব্যাংকার হলেও শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতির সমর্থক ও সংরক্ষক হয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন শিল্পীদের। মেদিচিদের দরবারকে তাই বলা হতো বুদ্ধিজীবী, শিল্পী আর মানবতাবাদীদের মিলনস্থল। ইতালি রেনেসাঁর গডফাদার নামেও পরিচিত তারা। শিল্পপ্রেমী লরেনজো নিজেও ছিলেন কবি ও দার্শনিক। ব্যক্তিগত বিলাসিতার চেয়ে শিল্প-সংস্কৃতির যত্ন নেয়াকেই গুরুত্ব দিতেন। মাইকেলেঞ্জেলোর কাজ দেখে তাকে প্রাসাদে থাকার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। 

ঠিক করে রেখেছিলাম ইতালি দেখার শুরুটা করব মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড দিয়ে। শেষ হবে ভ্যাটিকানে পিয়েতায়। যাওয়ার আগে হাতে খুব বেশি সময় না থাকায় সরাসরি একাডেমিয়ার ওয়েবসাইটে টিকিট পাইনি। বাধ্য হয়ে অনলাইনে গাইডেড ট্যুর এজেন্টের দ্বারস্থ হই। সুবিধা একটাই, গ্যালারিতে ঢুকতে হলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে না। একজন গাইড গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে, নির্ধারিত সময়ে আমাকে গ্যালারিতে দিয়ে আসবে।

গ্যালারিয়া দেল’একাডেমিয়া বা একাডেমিয়া গ্যালারিতে আমার ঢোকার সময় ছিল ২২ জুন দুপুর ১২টায়। গিয়েছি একটু আগেভাগেই, সাড়ে ১০টার দিকে। ততক্ষণে ঢোকার দরজা থেকে চত্বর পর্যন্ত দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন হয়ে গেছে। খানিক খুশিই হলাম। যাক, আমাকে অন্তত এভাবে রোদের মধ্যে দাঁড়াতে হচ্ছে না। 

ইউরোপে গরমের একটা বিশেষ চরিত্র আছে। রোদে দাঁড়ালে যতটা অস্বস্তি হয়, ছায়ায় আবার ততটাই আরাম লাগে। সময় কাটাতে আমি একটু ঘুরছি, কফি খাচ্ছি। আর আশপাশ দেখছি। কেউ বিখ্যাত কোনো শিল্পীর নকল ছবি বিক্রি করছে, কেউ বাড়তি দামের টিকিট। একটা ছবির পাশে দাঁড়াতেই শুনলাম, ২০ ইউরো, তোমার ১৫ দিলেই হবে। আমি না, না, করে চলে আসার সময় পাশে দাঁড়ানো এক লোকের চোখে চোখ পড়ায় হেসে দিয়ে বলল, ‘ট্যুরিস্ট ট্র্যাপ, ডোন্ট গেট কট।’ আমার ট্যুর গাইড এসে বলল, ‘তুমি চাইলে এখনই ঢুকে যেতে পার, একটু বেশি সময় থাকতে পারবে।’ আমি খুশি মনে তাকে অনুসরণ করলাম।

১৫৬৩ সালে মেদিচি পরিবারের প্রথম কসিমো দি’মেদিচির শাসনামলে চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য আর স্থাপত্যের মতো শাখাগুলো চর্চার জন্য বানানো হয় ফ্লোরেন্সের একাডেমি অব ফাইন আর্টস, চারুকলার জন্য নিবেদিত ফ্লোরেন্সের প্রথম দিককার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যা অন্যতম। ১৭৮৪ সালে পিয়েত্রো লিওপোল্ডো তাসকানির গ্র্যান্ড ডিউক হওয়ার পর এর পুনর্গঠনে হাত দেন। একাডেমি অব ফাইন আর্টসের একটা শাখা আর্টস অব ড্রয়িং। একাডেমিয়ার শুরুটা এভাবে। 

১৭৮৬ সালে পিয়েত্রো লিওপোল্ডো বড় ধরনের সংস্কারের অংশ হিসেবে কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেন। তার আদেশে গির্জা ও কনভেন্ট (বাংলায় মঠ বা বিহার) বন্ধ করে দেয়া হলে সেখানে থাকা মূল্যবান শিল্পকর্মগুলো জব্দ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে এখানে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর ১৮১০ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি ইতালিসহ সমগ্র ইউরোপে একই ধরনের নীতিকে প্রসার করেন। অনেক গির্জা ও কনভেন্ট বন্ধের নির্দেশ দেন। ফলে সেসব জায়গার শিল্পকর্মগুলোও বাজেয়াপ্ত করে বিভিন্ন স্থানীয় জাদুঘরে রাখা হয়। তবে একাডেমিয়ার চূড়ান্ত সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ১৮৭৩ সালে পিয়াজ্জা দেলা সিগনোরিয়া থেকে মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড নিয়ে আসার পর। 

পিয়াজ্জা দেলা সিগনোরিয়া হচ্ছে ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কেন্দ্রীয় চত্বর বা স্কয়ার। জায়গাটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত। এটি বহু শতাব্দী ধরে ফ্লোরেন্সের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সাক্ষী। তবে বললেই তো আর ডেভিডকে আনা যায় না। এজন্য নয় বছর ধরে নিতে হয়েছে প্রস্তুতি।

ওই সময় ইতালির নামকরা স্থপতি এমিলিও ডি ফ্যাব্রিস। তার ওপর দায়িত্ব পর একাডেমিয়ার ট্রিবিউন নির্মাণের। ট্রিবিউন বলতে এমন একটি স্থান বা কক্ষকে বোঝায়, যা মাস্টারপিস বা বিখ্যাত কোনো শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জন্য নকশা করা হয়।

মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিডের বিশালত্ব আর সৌন্দর্যকে যদি চোখ ভরে উপভোগ করতে চান, তাহলে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্ব থেকে দেখতে হবে। ফ্যাব্রিসও এমনভাবেই ট্রিবিউনটি নকশা করেছেন যেন দর্শনার্থীরা কখনো কাছ থেকে, কখনো দূরে দাঁড়িয়ে কিংবা চারপাশে ঘুরে ঘুরে ডেভিডের সৌন্দর্যকে নজরবন্দি করতে পারেন। 

আমি একটু একটু করে এগোচ্ছি। দূর থেকেই মনে হলো, এটা কোনো পার্থিব দৃশ্য নয়। একটা পাথুরে মূর্তির চারপাশ থেকে অদ্ভুত অপার্থিব আলো ছড়িয়ে পড়ছে। যতটা কাছ থেকে দেখা যায়, ততটা কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ১৭ ফুট লম্বা ডেভিডকে দেখতে দেখতে ভুল করে হঠাৎ রক্তমাংসের মানুষ বলেও ভ্রম হয়। চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ, গোলিয়াথকে পরাজিত করার তীব্র সংকল্পকে মাইকেলেঞ্জেলো পাথর থেকে খোদাই করে কীভাবে এত জীবন্ত করে তুললেন! এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হারিয়ে গেলাম অতীতের গোলকধাঁধায়। প্রথমবার ডেভিড দেখে নিশ্চয়ই ফ্লোরেন্সবাসীও একই ভুলভুলাইয়ায় পাক খেয়েছেন। তবে আমরা ডেভিড বললেও ইতালিয়ানরা বলে দাভিদ। 

এ কাজে হাত দেয়ার সময় মাইকেলেঞ্জেলোর বয়স ছিল মাত্র ২৬। ১৫০১ সালে কাজ শুরুর পর ১৫০৪ সালের সেপ্টেম্বরে এসে শেষ হয় ভাস্কর্যটি। বিশাল এক পাথর খণ্ডে শুধু হাতুড়ি-বাটালি চালিয়ে বাইবেলের নায়ক ডেভিডকে ফুটিয়ে তোলেন। দৈত্য গোলিয়াথকে সে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছে। ডেভিডকে তিনি দেখান গোলিয়াথের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগ মুহূর্তের নির্ভীক মূর্তিতে, চেহারায় যুদ্ধের মেজাজ ও সংকল্পের ছাপ। একটি গুলতি আর পাঁচটি মসৃণ পাথর মুঠোয় যুদ্ধক্ষেত্রের ডেভিড তাই ফ্লোরেন্সবাসীর সাহস, স্বাধীনতা ও সৌন্দর্য্যর প্রতীক হয়ে ওঠে। তুলে ধরে রেনেসাঁর আদর্শকেও ।

ডেভিড ছাড়াও একাডেমিয়ায় রয়েছে মাইকেলেঞ্জেলোর দাস সিরিজের অসমাপ্ত কাজগুলো। যেমন বিয়ার্ডেড স্লেভ, ইয়ং স্লেভ বা অ্যাটলাস স্লেভ, শিল্পী যেন পাথর থেকে মানুষগুলোকে মুক্ত করতে চাচ্ছেন। এগুলো করেছিলেন পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের সমাধির জন্য। সাবিন নারীদের অপহরণ করে নিয়ে জিয়ামবোলোনিয়ারের বিখ্যাত মার্বেল ভাস্কর্য ‘রেপ অব দ্য সাবিনেস’-এর দেখা পাবেন গ্যালারিতে ঢোকার শুরুতেই। 

একাডেমিয়ায় দেখা মেলে রেনেসাঁ যুগের চিত্রকলার একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহের। গুরুশিষ্য ফিলিপ্পো লিপ্পি ও সান্দ্রো বত্তিচেল্লির ‘ডিসেন্ট ফ্রম দ্য ক্রস’ ও ‘ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড। আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় ‘সোনালি জমিনের চিত্রকর্ম’গুলোর কথা। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বোঝাতে ব্যবহার করা হয় সোনালি পটভূমি, যা ১৩০০-১৫০০ শতাব্দীর শুরুর দিকের ফ্লোরেন্সের নামকরা শিল্পীদের কাজের এক সমৃদ্ধ সংগ্রহ। বাড়তি দেখা ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সংগীত যন্ত্র বিভাগটি। যেখানে ১৭০০ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৯০০ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত তাসকানির গ্র্যান্ড ডিউক, মেদিচি ও লরেন পরিবারের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে আনা প্রায় ৫০টি বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। আপনি চাইলে মাল্টিমিডিয়া স্টেশনের মাধ্যমে সুরও শুনতে পারবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন