সব প্রস্তুতি নিয়েও সেদিন সেনা অভিযান শুরু করা যায়নি —জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদ

ছবি : সংগৃহীত

দেশের ইতিহাসে ২০০৭ ও ২০০৮ সাল ঘটনাবহুল দুটি বছর। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের কারণে ২০০৯ সালও আলোচিত। এ সময়টায় দেশের সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদ। ২০০৫ সালের ১৫ জুন থেকে টানা চার বছর এ পদে ছিলেন তিনি। অবশেষে পিলখানা হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে নীরবতা ভেঙে মুখ খুলেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে বৃহস্পতিবার এ বক্তব্য তিনি প্রকাশ করেছেন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো—

সেদিন পিলখানায় কী ঘটেছিল এবং কেন ৫৭ জন কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হলো, সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী ছিল, তা আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করছি। 

২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টায় সেনা সদরে প্রতিদিনের মতো কাজ শুরু হয়। সেদিন একটি জিএসপিসি মিটিং ছিল। এ মিটিংয়ে সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয়, পরবর্তী বছর কী কী জিনিস প্রকিউর করবে। এ সভার সভাপতি সেনাপ্রধান এবং সদস্য হলেন সেনাবাহিনীর পিএসওরা, নির্ধারিত ডাইরেক্টর ও রেলেভ্যান্ট সিনিয়র অফিসার। সেদিন সকাল থেকেই এ জিএসপিসি মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আনুমানিক সকাল পৌনে ৯টায় সিজিএস লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইবনে জামালী আমার কার্যালয়ে আসেন এবং বলেন, আমাদের কাছে কিছু ৮১ মিলিমিটার মর্টার সেল আছে, যেগুলো সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না। এর গুদামজাত ও রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবে বিডিআর ৮১ মিলিমিটার মর্টার সেল ব্যবহার করে। আপনি যদি বিডিআর মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন, তারা যদি এগুলো ট্রান্সফার করে নিয়ে যায় তাহলে অনেক উপকার হবে। আমি প্রস্তাবের গুরুত্ব অনুধাবন করে এডিসি ক্যাপ্টেন জুনায়েদকে বলি ডিজি বিডিআরকে টেলিফোনে সংযোগ দেয়ার জন্য এবং সে সংযোগ দিল। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বিডিআর মহাপরিচালক জেনারেল শাকিল আহমেদের সঙ্গে আমার কথা শুরু হয় এবং ৮১ মিমি মর্টার গ্রহণের প্রস্তাব দিই এবং তিনি সানন্দে গ্রহণ করলেন এবং গতকালের বার্ষিক প্যারেডের প্রশংসা করে কনভার্সেশন সমাপ্তি করি। কনভার্সেশনে মনে হয়েছে তার উচ্চ মনোবল রয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনি বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বলে আমার বিশ্বাস। যদি জানতেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আমাকে অবহিত করতেন। ৯টা বাজার ২ মিনিট বাকি, আমি এবং সিজিএস জিএসপিসি মিটিংয়ের জন্য কনফারেন্স রুমের উদ্দেশে যাত্রা করি। হয়তো জেনারেল শাকিল তার অফিস থেকে সেন্ট্রাল দরবারে অংশগ্রহণ করার জন্য একই সময়ে অফিস ত্যাগ করেন। সকাল ৯টায় জিএসপিসি মিটিং শুরু হয় এবং আমরা আমাদের ক্রয়ের ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে যাই। সাড়ে ৯টার দিকে আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ সভাকক্ষে প্রবেশ করে আমাকে বলেন পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে। আপনার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।

মনে মনে বললাম, একটু আগেই তো বিডিআর মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা হলো, হঠাৎ কী হলো। সে যাই হোক, সভা স্থগিত করে সিজিএস এবং ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনসকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিসে এলাম। ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আমি জেনারেল শাকিল এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোনে সংযোগ দেয়ার জন্য এডিসি ক্যাপ্টেন জুনায়েদকে নির্দেশ দিই। তাদের ফোন সার্বক্ষণিক ব্যস্ত ছিল এবং তাৎক্ষণিক সংযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে সামরিক গোয়েন্দার মাধ্যমে পিলখানা সম্পর্কে তথ্য আসা শুরু করল এবং কী ঘটছে পিলখানায় তা আমাকে জানানো হলো। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সময় বাঁচাতে কারো নির্দেশ ছাড়া ৪৬ ইনডিপেনডেন্ট ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিই। তারা তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে, যার নামকরণ হয় অপারেশন রেস্টোর অর্ডার। গৃহীত পদক্ষেপ সম্বন্ধে পিএসও-এফডি জেনারেল মবিনকে অবহিত করি। ৯টা ৪৭ মিনিটে বিডিআর মহাপরিচালককে ফোনে পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে?

তিনি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমাকে বলেন। তিনি বলেন, দরবার চলাকালীন দুজন সশস্ত্র সৈনিক দরবার হলে প্রবেশ করে একজন আমার পেছনে এসে দাঁড়ায় এবং ফেইন্ট হয়ে যায়। অন্যজন দরবার হল অতিক্রম করে বাইরে চলে যায়। তার পরপরই বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসে। গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে দরবার হলে উপস্থিত সৈনিকরা গণ্ডগোল শুরু করে দেয় এবং তারা হল থেকে বেরিয়ে যায়। মনে হলো সব পরিকল্পিত এবং সেই পরিকল্পনা অনুসারে সব বাস্তবায়ন হতে থাকে। তিনি আরো বলেন, আমি সেক্টর কমান্ডার এবং ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের পাঠিয়েছি তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য, যাতে দরবার শুরু করা যায়। তিনি আশা করেন, শিগগিরই দরবার শুরু করতে পারবেন। 

আমি তাকে জানাই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য ৪৬ ইনডিপেনডেন্ট ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছি এবং শিগগিরই তারা পিলখানার উদ্দেশে যাত্রা করবে। 

অনেকেই মনে করেন, বিডিআর মহাপরিচালক সাহায্যের জন্য আমাকে (সেনাপ্রধান) ফোন করেছেন। এটা সত্য নয়। আমি মহাপরিচালককে ফোন করি এবং আমরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছি তা তাকে জানিয়ে দিই। তিনি আমাকে ফোন করেননি। 

৯টা ৫৪ মিনিটে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মোবাইল ফোনে পেলাম। এর মধ্যে বিডিআর বিদ্রোহ সম্বন্ধে তিনি অনেক তথ্য পেয়ে গিয়েছিলেন। আমি ৪৬ ইনডিপেনডেন্ট ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে প্রস্তুত হতে বলেছিলাম তা তাকে জানাই। তিনি জানতে চাইলেন, কতক্ষণ সময় লাগবে এ ব্রিগেডকে তৈরি করতে। আমি তাকে জানাই, সাধারণত ৬ ঘণ্টা লাগে কিন্তু তাড়াতাড়ি করে ২ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুত করতে পারি। সেই ব্রিগেডকে পিলখানার দিকে যাত্রার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আদেশ চাইলে তিনি তা দিলেন। আদেশ পাওয়ার আগে ব্রিগেডটি সাধারণ প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ব্যস্ত ছিল। অস্ত্র গোলাবারুদ ম্যাগাজিনে, সামরিক যানবাহন গ্যারেজে, ওয়্যারলেস ও অন্যান্য সরঞ্জাম স্টোরে ছিল। এগুলো একত্র করে কমান্ড স্ট্রাকচার প্রস্তুত করতে সময় প্রয়োজন। তবে ৪৬ ব্রিগেড ১ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে যাত্রা শুরু করে। এগুলো সম্ভব হয়েছে ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাকিম ও ইউনিট অধিনায়কদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য। ব্রিগেড কমান্ডারের নেতৃত্বে ১০ জন কর্মকর্তা ও ৬৫৫ জন সৈনিক পিলখানার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।

সকাল সাড়ে ১০টায় ব্রিগেডের অগ্রভাগ জাহাঙ্গীর গেট অতিক্রম করে। এত অল্প সময়ে প্রস্তুত হয়ে যাত্রা শুরু করে, যা বিরল কৃতিত্বের উদাহরণ। এরই মধ্যে বিদ্রোহীরা বিডিআর গেটগুলোর চারপাশে ভারী মেশিনগান, মর্টারস, রকেট লঞ্চার ও অন্যান্য অস্ত্র মোতায়েন করে যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেয়। ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি প্রধান ফটকের কাছাকাছি পৌঁছায় এবং বিদ্রোহীরা টের পেয়ে একটি পিকআপকে লক্ষ্য করে রকেট ছোড়ে। রকেটটি পিকআপকে আঘাত করে এবং চালক ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে। অন্যজন গুরুতর আহত হন।

এখানে একটি বিষয় বলা দরকার, ১০টা ৩৫ মিনিটে সর্বশেষ তথ্য পাওয়ার জন্য বিডিআর মহাপরিচালককে আমার সঙ্গে ফোনে সংযোগ করতে আবার এডিসিকে বলি। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো না। হয়তো এ সময়ের মধ্যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, আনুমানিক সাড়ে ১০টায় মহাপরিচালককে গুলি করা হয় এবং তিনি নিহত হন। এর পরই উপমহাপরিচালক কর্নেল আনিস, কর্নেল কায়সারসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। লেফটেনেন্ট কর্নেল শামসের ধারণা অনুযায়ী, সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে বেশির ভাগ কর্মকর্তাকেই হত্যা করা হয়েছে। আর আমাদের ব্রিগেড দল ১১টার দিকে পিলখানার কাছে পৌঁছে। সেনাবাহিনী পৌঁছার আগেই বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড করেছে। সাধারণত আক্রমণের আগে সেনাবাহিনী শত্রুর দুর্বল স্থানগুলো বের করে সেই স্থান দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। রকেট দিয়ে আক্রমণ করার পর ব্রিগেডটি মোতায়েন হয়ে যায় এবং তাদের দুর্বল দিকগুলো বের করার চেষ্টা করে। 

এখানে উল্লেখ্য যে ক্যাপ্টেন শফিকের নেতৃত্বে ৩৫০ জন র‍্যাবের সদস্য ১০টার আগেই পিলখানায় পৌঁছে যান। তারপর তিনি পিলখানায় প্রবেশের জন্য তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি চান। প্রবেশের অনুমতি তিনি পাননি। তাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলে তিনি তাদের উদ্ধার করতে পারতেন। কিছুক্ষণ পরই তার সঙ্গে মিলিত হয়ে বিদ্রোহীদের দমন করা অতি সহজ হতো। আর তারা কোনো কর্মকর্তাকে খুন করতে পারত না। পিলখানার ভেতরে কী হচ্ছে? তারা কি কর্মকর্তাকে জিম্মি করছে না হত্যা করছে? শুধু আমরা গুলির আওয়াজ শুনছি। এ গুলির আওয়াজ ওই এলাকার চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ সেখানে লাইভ প্রোগ্রাম কাভার করছিল। আমার যা মনে পড়ে, মুন্নি সাহা লাইভ সম্প্রচার করছিল। বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের সম্পর্কে ভুল ও মিথ্যা বক্তব্য তুলে ধরছিল জনগণের সামনে। এর মাধ্যমে একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল কর্মকর্তাদের সম্বন্ধে। এছাড়া বিডিআর অন্যান্য ক্যাম্পেও এ বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে। সেনাপ্রধানের ক্লোজ প্রটেকশনের জন্য একটি সেকশন কমান্ডো ঢাকায় থাকে। বিদ্রোহীদের গতিবিধি নির্ধারণের জন্য হেলিকপ্টারযোগে তাদের অত্র এলাকায় পাঠানো হয়। বিদ্রোহীরা ওই হেলিকপ্টারে গুলি করে এবং হেলিকপ্টারটি গুলিবিদ্ধ হয়। বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে পিএসও-এফডি জানায় যে সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে যেকোনো আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাই সরকার আদেশ করল ৪৬ ব্রিগেডসহ অন্যান্য যারা সেখানে এসেছিল তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে। বলা হলো, সেনাবাহিনী যেন কমপক্ষে ২ কিলোমিটার উত্তরে চলে যায়। আর যদি সমঝোতা না হয় তাহলে তাদের সঙ্গে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। আনুমানিক দুপুর ১২টায় পিএসও-এফডি আমাকে টেলিফোন করে বলেন, আমি যেন জরুরি ভিত্তিতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যমুনায় দেখা করি। তিনি কেনই বা আমাকে এই সময়ে যেতে বললেন? কারণ ওই সময় প্রত্যেকটা মিনিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। যা হোক আমি সিজিএসকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে যমুনার উদ্দেশে রওনা হলাম। 

সেনাবাহিনীর দৃষ্টির আড়াল হওয়ার পর বেলা ১টার দিকে সাদা পতাকা নিয়ে প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম প্রধান ফটক দিয়ে আলোচনার জন্য পিলখানার ভেতরে প্রবেশ করেন। এরই মধ্যে সরকার থেকে বলা হলো যে সেনাবাহিনী প্রধান ফটক এলাকা ত্যাগ করবে এবং পুলিশ করবে আরেক দিকে, র‍্যাব অন্যদিক থেকে। 

আমার জানামতে, ডেইরি ফার্ম যেখানে আছে সে এলাকা অরক্ষিত ছিল। আমি বেলা ১টায় যমুনায় পৌঁছাই, সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখি সত্যিই এটা হতাশাজনক। দেখি পুরো যমুনায় লোকে লোকারণ্য, হাঁটার জায়গা নেই। যেসব লোককে আমি সেখানে দেখলাম, তাদের কোনো কাজ নেই। সেখানে আসছে কেবল কৌতূহলবশত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় আলোচনা করছিলেন। সভা থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসছিল না। আমি উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে (প্রধানমন্ত্রী) আমার উপস্থিতি জানাতে অনুরোধ করি। এবং তিনি জানলেন যে আমি যমুনায় এসেছি। আমি ভেবেছিলাম, তিনি আমাকে ভেতরে ডেকে নেবেন কিন্তু তা করা হলো না। বেলা ২টার পর খবর এল, পিলখানা থেকে একজন কর্মকর্তা পালিয়ে যমুনায় এসেছে। আমি তা শুনে তার কাছে ছুটে গেলাম। তিনি জানালেন, বিদ্রোহীরা বেশকিছু কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে। তবে বিডিআর মহাপরিচালক সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত নন। এই প্রথম নিশ্চিত হলাম বিডিআর বিদ্রোহীরা নিরপরাধ কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সভা শেষ করে আরেকটি ছোট সভায় অংশ নিলেন। তারপর তিনি তিন বাহিনীর প্রধানকে একসঙ্গে ডাকলেন। এখানে উল্লেখ্য যে আমি যমুনায় পৌঁছানোর দেড় ঘণ্টা পর বাকি দুই বাহিনীর প্রধান যমুনায় এসেছিলেন। অর্থাৎ আমাকে আসতে বলার বেশ কিছুক্ষণ পর তাদের বলা হয়েছে আসার জন্য। তিনি এসে আমাদের বললেন যে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম এবং ফজলে নূর তাপস বিদ্রোহীদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে যমুনায় আসছে। বিদ্রোহীরা সাধারণ ক্ষমা চাইছে। তিনি আরো বলেন, বিদ্রোহীদের কিছু বলার থাকলে আমরা যেন তাকে (প্রধানমন্ত্রী) বলি। আমি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে বলি, অপারেশন রেস্টোর অর্ডার পরিচালনার শুরুতেই আমাদের একজন সৈনিককে নিহত হতে হয়েছে এবং একজন গুরুতর আহত হয়েছে। এই মাত্র খবর পেলাম, বিদ্রোহীরা অনেক কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে। আমি আরো বলি, বিদ্রোহীদের কোনো শর্ত মানা যাবে না। আর আপনি তাদের বলবেন, কর্মকর্তা হত্যা এ মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। আর একটি প্রাণও যেন না হারায়। দ্বিতীয়ত, আটককৃত সব কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে এখনই মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ বিদ্রোহীদের অতিসত্বর আত্মসমর্পণ করতে হবে। চতুর্থত, আমি জোর দিয়ে বলি, সাধারণ ক্ষমা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। 

আমাদের সঙ্গে কথা বলার পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চলে গেলেন। আর এর মধ্যে কিছু সময় আমরা পেলাম। আলোচনা শুরু হয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে। বিদ্রোহীরা ৩টা ৪৮ মিনিটে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪ জন বিদ্রোহী আলোচনার জন্য যমুনায় প্রবেশ করে এবং তাদের একটি বড় কক্ষে রাখা হয়। 

আমি আমার এডিসিকে বললাম, এদের মধ্যে নেতাকে ডেকে নিয়ে আস। এডিসি জুনায়েদ ডিএডি তৌহিদকে ডেকে নিয়ে আসল। আমি তাকে দেখেই বললাম, আপনি আমাকে চেনেন? সে উত্তর দিল, হ্যাঁ, আপনি সেনাপ্রধান। 

আপনার কাছে আমার প্রশ্ন, কী হয়েছে পিলখানায়? কতজন কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং এখন কী অবস্থা? তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, সকাল ৯টায় বিদ্রোহীরা আমাকে একটা কক্ষে তালা মেরে রেখে দিয়েছিল। এখন আসার সময় তালা খুলে আমাকে নিয়ে আসে। আমি কিছুই জানি না। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

ঠিক আছে। আপনি জানেন না। আপনার সঙ্গে যারা এসেছে তারা নিশ্চয়ই জানেন। আপনি তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করেন এবং আমাকে উত্তর জানান। তিনি ভেতরে চলে গেলেন এবং আর এলেন না। আমি আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে আবার ক্যাপ্টেন জুনায়েদকে ভেতরে পাঠালাম ডিএডি তৌহিদকে ডেকে আনতে। তিনি তৌহিদকে নিয়ে এলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তো উত্তর দিলেন না। কী হয়েছে বলুন। স্যার, এরা সব জানে। কিন্তু কোনো কথাই বলছে না। এ কথা বলে তিনি সম্মেলন কক্ষে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলোচনার জন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে বসেন এবং সঙ্গে ছিলেন নানক, মির্জা আজম ও তাপস। 

প্রথম পর্যায়ে কী আলাপ হয়েছে তা আমার জানা নেই। এর কিছুক্ষণ পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী কক্ষ থেকে বের হয়ে আমাকে ডাকলেন। আমি গেলাম।

ওখানে গিয়ে দেখি, এ ১৪ জন সবাই নিচে তাকিয়ে আছেন। তাদের উষ্কখুষ্ক চুল, কাপড়ের অবস্থা খুবই খারাপ। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন রাস্তার বখাটে ছেলে। তাদের দাবি কী ছিল তা আমি জানি না। হয়তো প্রথম পর্যায়ে তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। 

কিন্তু এখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে আমি যা শুনেছি যে তোমরা অস্ত্র, গোলাবারুদ আত্মসমর্পণ করো এবং সবাই ব্যারাকে ফেরত চলে যাও। পরে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। 

আলোচনার শেষে নানক অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের আলোচনার সারাংশ জানালেন এবং তিনি এটাও বললেন যে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তারা বলেন যে তারা আত্মসমর্পণ করবেন এবং ব্যারাকে ফেরত যাবেন। 

বিদ্রোহীরা ৬টা ৩৭ মিনিটে যমুনা ত্যাগ করে পিলখানার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পিলখানা পৌঁছেই তারা ঘোষণা দেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রজ্ঞাপন তাদের হাতে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আত্মসমর্পণ করবে না। তারা পুনরায় গোলাগুলি শুরু করে এবং কর্মকর্তাদের খুঁজতে থাকেন। রাত ১২টায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শেখ ফজলে নূর তাপস (তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য) ও আইজিপি পিলখানায় বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য যান এবং তাদের সঙ্গে বসেন। একপর্যায়ে কিছু বিদ্রোহী অস্ত্র সমর্পণ করে এবং আটটি পরিবারকেই মুক্তি দেয়। তার মধ্যে শুধু তিনটি পরিবার ছিল সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের এবং পাঁচটি ছিল ডিএডি পরিবার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন জানতেন যে কর্মকর্তা ও পরিবারগুলোকে কোয়ার্টারগার্ডে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাদের মুক্তির ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি এবং তাদের সম্পর্কে খোঁজখবরও নেননি। তিনি ওই আটটি পরিবারকে নিয়ে পিলখানা থেকে বের হয়ে আসেন। 

এখানে উল্লেখ করতে চাই যে সকাল থেকেই কিছু পরিবারকে নিয়ে কোয়ার্টারগার্ডে রেখেছিল। কোয়ার্টারগার্ডের রুমগুলো খুবই ছোট। পরিবার, সন্তান, পিতা-মাতা, গৃহকর্মী সবাইকে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল। খাবার নেই, পানি নেই, কী যে কষ্ট! আমরা নিশ্চয় তা উপলব্ধি করতে পারি। কিছু সময় পরপরই হুমকি দিচ্ছে, যদি সেনাবাহিনী আক্রমণ করে তাহলে প্রত্যেককে হত্যা করা হবে। এ হুমকি তারা প্রথম থেকেই দিয়ে আসছিল। আর এ খবর আমার স্ত্রীকে কয়েকজন নারী কর্মকর্তা যারা বাইরে ছিল তারা ফোন করে জানিয়েছিলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই বিদ্রোহীরা পুনরায় গোলাগুলি শুরু করে এবং বেঁচে যাওয়া কর্মকর্তা যারা বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে ছিলেন তাদের খুঁজতে থাকে। আর কোয়ার্টারগার্ডে থাকা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে হত্যার কথা বলে। 

সকাল ১০টার দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবার আমাকে যমুনায় যেতে বলেন। আমি সকাল ১০টা ৩২ মিনিটে যমুনায় পৌঁছাই। সিদ্ধান্ত হয় যে বিদ্রোহীরা আজ যদি আত্মসমর্পণ না করে তাহলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। আমি তার থেকে অনুমতি নিলাম যে এ অভিযান পরিচালনার জন্য সাভার থেকে ট্যাংক আনতে চাই এবং তিনি এ অনুমতি দিলেন। আমি অতিসত্বর সাভার থেকে ট্যাংকের যাত্রা শুরুর আদেশ দিয়ে দিলাম। বলা বাহুল্য, ২৫ তারিখেই এপিসি, গান, অ্যামিনেশন বিভিন্ন স্টোরে ছিল সেগুলো একত্র করা হয় এবং ড্রাইভার ছিল না। বিভিন্ন ফরমেশন থেকে এনে জড়ো করে ২৫ তারিখে প্রস্তুত রেখেছিলাম। ট্যাংক, এপিসি ও ৪৬ ব্রিগেড থেকে জনবল নিয়ে পুরোপুরি আমরা প্রস্তুতি নিই যে আমরা অপারেশন চালাব এবং এ অপারেশনের নামকরণ করা হলো ‘অপারেশন রিস্টোর অর্ডার-২’। আমাদের এ প্রস্তুতি দেখে এবং ট্যাংক আসছে শুনে বিদ্রোহীরা উঠেপড়ে লাগল যে তারা শর্ত ছাড়া সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ২টা ১৮ মিনিটে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দিলেন, যা আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম। সেনাবাহিনীর অভিযানের প্রস্তুতি দেখে, সাভার থেকে ট্যাংক আসছে শুনে বিদ্রোহীরা আলোচনায় অতি আগ্রহী হয়ে পড়ে। ৪টা ৪৮ মিনিটে আমাকে বলা হয়, বিদ্রোহীরা কোনো শর্ত ছাড়াই সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছে এবং কিছুক্ষণ পরই সব গেটে তারা সাদা পতাকা উত্তোলন করে। রাত ৮টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি দল পিলখানার ভেতরে প্রবেশ করে এবং বিদ্রোহীরা কোনো শর্ত ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় ৩৩ ঘণ্টার বিডিআর বিদ্রোহ। প্রাণ হারালেন ৫৭ জন কর্মকর্তা, যারা সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ছিলেন। আরো কিছু বেসামরিক নাগরিকসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারালেন। পরিশেষে আমি আশা করব একটি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য বের করে, যারা এখনো দোষী চিহ্নিত হননি এবং এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের আইনের আওতায় এনে সঠিক বিচার করা হোক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন