স্বাভাবিক হয়ে আসছে আশুলিয়া-গাজীপুর শিল্পাঞ্চল

নিজস্ব প্রতিবেদক

গাজীপুরে একটি কারখানায় কাজ শুরুর আগে শ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

অব্যাহত শ্রম অসন্তোষ কমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে আশুলিয়া ও গাজীপুর দুই শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলোয়। এ দুই এলাকার শিল্প পুলিশ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, গতকাল গাজীপুর, সাভার-আশুলিয়া-জিরানী, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা মেট্রোপলিটন ও চট্টগ্রাম এলাকায় মোট ২ হাজার ১৪৪ কারখানার মধ্যে খোলা ছিল ২ হাজার ১১৩টি। সাময়িক বন্ধ/ছুটি কারখানার সংখ্যা ৩১। আগস্টের বেতন দেয়া হয়েছে ২ হাজার নয়টি কারখানায়। আগস্টের বেতন না দেয়া কারখানার সংখ্যা ১৩৫।

আশুলিয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কয়েক দিন ধরে চলা শ্রমিক অসন্তোষের মুখে গত বৃহস্পতিবার ২১৯ কারখানা বন্ধ ও ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তবে গত শনিবার থেকে অধিকাংশ কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। গতকালও খুলেছে ২৯ কারখানা। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে শিল্প পুলিশ। এর আগে বন্ধ ও ছুটি ঘোষণা করা ১৭০ কারখানার উৎপাদন শুরু হয়েছে।

শিল্প পুলিশ জানায়, শ্রমিক অসন্তোষের মুখে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ১৩(১) ধারায় ৮৬টি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় ১৩৩টি পোশাক কারখানায়। তবে শিল্পাঞ্চলে কাজের পরিবেশ ফিরে আসায় গত শনিবার বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ১৩(১) ধারায় বন্ধ ৮৬টি কারখানার মধ্যে ৫০টিতে উৎপাদন শুরু হয়। গতকাল বাকি ৩৬টি কারখানার মধ্যে ১৮টিতে উৎপাদন শুরু হয় এবং সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা ১৩টি কারখানার মধ্যে ১১টিতে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বর্তমানে সব মিলিয়ে ২০টি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

কারখানার মালিকপক্ষ জানায়, গতকাল সকালে পার-পাঁচটি কারখানায় শ্রমিক প্রবেশ করলেও বিভিন্ন দাবিতে উৎপাদন বন্ধ রাখেন শ্রমিকরা। পরে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তারা কাজে যোগ দিয়ে উৎপাদন শুরু করেন।

বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় বন্ধ রয়েছে জেনারেশন নেক্সট, সান সোয়েটার, মাসকট ফ্যাশন, পার্ল গার্মেন্টসসহ ১৮টি পোশাক কারখানা।

শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, ‘আজ পরিবেশ অনেকটা ভালো। ২০টি কারখানা বাদে সব পোশাক কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত শিল্পাঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, অব্যাহত রয়েছে যৌথ বাহিনীর টহল কার্যক্রম।’

গাজীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরের সব পোশাক কারখানায় গতকাল পুরোদমে উৎপাদন কার্যক্রম সচল ছিল। সকাল থেকেই বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা শিফট অনুযায়ী ডিউটি পালন করেছে। তবে দুটি পোশাক কারখানায় আংশিক কর্মবিরতির খবর পাওয়া গেছে। পরে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসে তাদের দাবি পূরণ হওয়ায় শ্রমিকরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেন।

পুলিশ, মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল থেকে গাজীপুরের টঙ্গী, জয়দেবপুর, কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, কালিয়াকৈর ও শ্রীপুর এলাকার বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেয়া হয়। এসব কারখানার শ্রমিকরা নির্ধারিত সময়ে কাজে যোগ দেন। সারা দিন বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও রাত পর্যন্ত শ্রমিকরা উৎপাদনকাজে নিয়োজিত থাকেন। শিল্পাঞ্চলের কোথাও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়নি। কয়েক দিন ধরে বহিরাগত কিছু শ্রমিক যারা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছিলেন তাদের তৎপরতা কোথাও দেখা যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সতর্কতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। শিল্প পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন কারখানার সামনে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিয়োজিত ছিলেন।

গাজীপুর চৌরাস্তার চৌধুরীবাড়ি এলাকায় অবস্থিত স্টাইলিশ গার্মেন্টস কারখানার চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অ্যাপারেল ফেডারেশনের সদস্য ও বিজিএমইএর স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে পোশাক কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম চলছে। সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে আমরা খুবই খুশি।’

বিজিএমইএর পরিচালক ও গাজীপুরের লক্ষ্মীপুরায় অবস্থিত স্পেরো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম জানান, গাজীপুরে বিজিএমইএর সক্রিয় কারখানা রয়েছে ৮৭৬টি। এর মধ্যে গতকাল সব কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম চলমান ছিল। কোনো কারখানাই বন্ধ ছিল না। তবে গাজীপুরের পার্শ্ববর্তী আশুলিয়া ও জিরানী এলাকায় সক্রিয় ৪০৭টি কারখানার মধ্যে ১৬টি বন্ধ ছিল।

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গার্মেন্টস এলাকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি জয়েন্ট টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অ্যাডিশনাল সেক্রেটারিকে প্রধান করে গঠিত এ টাস্কফোর্সে বিজিএমইএর সদস্য, শ্রমিক ইউনিয়ন ও অন্যান্য কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। টাস্কফোর্সের সদস্যরা বিভিন্ন কারখানা ভিজিট করছি এবং বিভিন্ন সমস্যা ফাইন্ড আউট করছি।’

গাজীপুর কলকারখানা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে ২ হাজার ৬৩৩টি নিবন্ধিত কারখানা রয়েছে। এছাড়া অনিবন্ধিত কারখানা আছে ৬০০টির মতো। এসব কারখানায় শ্রম আইন লঙ্ঘনসংশ্লিষ্ট কোনো ঘটনা থাকলে কলকারখানা অধিদপ্তর মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। এছাড়া উভয় পক্ষকে নিয়ে কাউন্সেলিংও করে তারা। সূত্রটি জানায়, গতকাল গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকার দুটি কারখানায় শ্রমিকরা আংশিক কর্মবিরতি পালন করেন। এর মধ্যে এসকিউ সেলসিয়াস নামে একটি কারখানার সাড়ে ৪০০ শ্রমিক কারখানার ভেতরে বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মবিরতি পালন করেন। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল সাপ্তাহিক দুদিন ছুটি এবং ডিজিএম থেকে এক্সিকিউটিভ পর্যন্ত সবার পদত্যাগ। এ দাবিতে গতকাল সকালে কারখানার ভেতরে প্রবেশ করে উৎপাদনকাজে অংশ না নিয়ে তারা বসে থাকেন। পরে বিকালে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং একটি সমাধানে পৌঁছান তারা। অন্যদিকে শ্রীপুরের আনোয়ারা নিট কম্পোজিট কারখানার সুইং সেকশনের কর্মীরা কর্মবিরতি পালন করেছেন। ডায়িং ও নিটিং সেকশনে কাজ চললেও সুইং সেকশনের কর্মীরা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মবিরতি পালন করেন।

এদিকে টঙ্গীর বাদাম রোডে বড় দেওড়া এলাকার মাইশা মিম অ্যাপারেল লিমিটেড ও সাতাইশ এলাকার সিজন ড্রেসেস কারখানার শ্রমিকরা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে বিকালে আলোচনায় বসেন।

শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন জানান, শ্রীপুর এলাকার কোনো কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের খবর পাওয়া যায়নি। তবে দুটি কারখানার শ্রমিকরা কারখানার অভ্যন্তরে কর্মবিরতি পালন করেছেন এবং বিকালে মালিকপক্ষের সঙ্গে বসে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন