সাগরে নিম্নচাপ, টানা বৃষ্টিতে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে জলাবদ্ধতা

বাঁধধসের আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটছে উপকূলবাসীর

নিজস্ব প্রতিবেদক

উঁচু জোয়ারে তলিয়ে যায় বরগুনার বিষখালী নদীর ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশের ১০ জেলায় গতকাল ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। আগামী পাঁচদিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। এছাড়া আগামীকাল পূর্ণিমা। অন্য সময়ের তুলনায় পূর্ণিমার জোয়ার উঁচু হয়। এবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থল গভীর নিম্নচাপ। ফলে জোয়ারের চাপে বাঁধে ধসের আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটছে উপকূলবাসীর।

আবহাওয়া বুলেটিনের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, ফরিদপুরে ১৫১, মাদারীপুরে ১০৭, গোপালগঞ্জে ১৫১, বাগেরহাটে ১২২, যশোরে ১২৪, চুয়াডাঙ্গায় ১১৮, কুষ্টিয়ায় ১২২, বরিশালে ১২৯ ও পটুয়াখালীতে দেশের সর্বোচ্চ ১৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ফলে এসব জেলার নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ২৭টি পোল্ডারে বেড়িবাঁধের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ১৩ দশমিক ৯০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৪০ কিলোমিটার। চলতি বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের অনেক স্থান ধসে পড়ছে। এ নিয়ে আতঙ্কে উপকূলীয় নদীপাড়ের মানুষ। এর মধ্যে কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় ঝুঁকিতে রয়েছে ৩০ কিলোমিটার। শহরের সন্নিকটে দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুরের ২৯, ২৮/২ নম্বর পোল্ডারে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।

ক্লাইমেট মুভমেন্ট বাংলাদেশের কয়রা উপজেলা সমন্বয়ক শেখ সিরাজউদ্দৌলা লিংকন জানান, ষাটের দশকে নির্মিত আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো কোনো রকমে টিকে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব বেড়িবাঁধ প্রায়ই ভাঙনের কবলে পড়ছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। নষ্ট হয় ঘরবাড়ি, ফসল ও ঘেরের মাছ। শত শত বিঘা জমি নদীতে চলে যায়।

পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রিপন কুমার মণ্ডল জানান, ভদ্রা নদীর জোয়ারের পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে।

দাকোপ উপজেলার পানখালী ইউপি চেয়ারম্যান শেখ সাব্বির আহম্মেদ জানান, ৩১ নম্বর পোল্ডারের বেড়িবাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ।

দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান গাজী জালাল উদ্দিন জানান, জোয়ার-ভাটার তোড়ে তার ইউনিয়নের পাঁচ-ছয়টি স্থানের বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।

খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, ‘নদীতে জোয়ারের চাপ বাড়লে কোথাও না কোথাও ভাঙন ধরে। ভাঙনকবলিত জায়গায় তাৎক্ষণিক মেরামত করা হয়।’

এদিকে, নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং জোয়ার, প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাসে অনেকটা বিলীন হয়েছে বরিশালের গ্রাম রক্ষা বাঁধ। এ কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামের মানুষ। নদীতীরবর্তী এসব বাঁধ এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। সব মিলিয়ে মানুষ এখন চরম আতঙ্কে দিন পার করছে।

বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ১৫৮টি বেড়িবাঁধে ভাঙন ঝুঁকিপূর্ণ স্থান শনাক্ত করেছে পাউবো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পটুয়াখালী ও ভোলা জেলা। বরিশাল জেলায় ১০, পিরোজপুরে ১২, ঝালকাঠিতে ১০, পটুয়াখালীতে অর্ধশতাধিক, বরগুনায় ২৬ ও ভোলায় ৪৩টি বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে।

বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নে গিয়ে কথা হয় রাজ্জাক খানের সঙ্গে। কীর্তনখোলা নদী গিলে খেয়েছে তার বাপ-দাদার ভিটেমাটি। তার শেষ সম্বল নদীপাড়ের বসতঘর। সেটিও চলতি বর্ষা মৌসুমে হারানোর শঙ্কায় দিন কাটছে তার।

ভুক্তভোগী রাজ্জাক খান বলেন, ‘সবকিছুই তো নদীতে ভেঙেচুরে চলে গেছে। এখন কোনো রকম একটা ছাপড়া ঘর করে বসবাস করছি। জানি না এবার বর্ষায় এটাও টিকিয়ে রাখতে পারব কিনা।’

মেহেন্দীগঞ্জের মেঘনা তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা জানান, সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নদীতে ধসে যাওয়ায় অন্তত ১৬টি গ্রামের মানুষ বিপাকে পড়েছে। জোয়ারের পানি ঢুকছে লোকালয়ে। গ্রামের চারদিকে নদী। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সামান্য জোয়ারে তাদের বাড়িঘর তলিয়ে যায়। জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধ ধসে যাওয়ায় লেংগুটিয়া থেকে আমিরগঞ্জের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর উত্তরেও একই অবস্থা।

পাউবো পটুয়াখালী ও কলাপাড়া কার্যালয় জানায়, জেলায় মোট বেড়িবাঁধ রয়েছে ১ হাজার ৮১৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ রয়েছে ১৪ কিলোমিটার। কলাপাড়ার নীলগঞ্জের গৈয়াতলা এলাকায় ৭০০ মিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেখানে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া ধুলাশ্বর এলাকায় ৬০ মিটার, রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজে ১২০ মিটারসহ দুই উপজেলায় মোট ছয় কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। 

পাউবোর আওতায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে মির্জাগঞ্জে দুই কিলোমিটার, কাঁকড়াবুনিয়ায় প্রায় দেড় কিলোমিটারসহ বিভিন্ন অংশে মোট আট কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। 

বাঁধের ঢালে বসতি গড়েছেন মো. হানিফ হাওলাদার (৪৫) নামে এক জেলে। তিনি জানান, অতিরিক্ত পানির চাপে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ভেঙে ভেসে যেতে পারে। তাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।

পটুয়াখালী পাউবোর প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘এ জেলায় ৩৬টি পোল্ডার রয়েছে। বড় কোনো বন্যা হলে কিছু কিছু জায়গা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বেড়িবাঁধ ছুটে যায়। তবে বর্তমানে এমন কোনো আশঙ্কা নেই।’

বরিশাল পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন অলীদ বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে মাটির বাঁধগুলো নরম হয়ে থাকে। তার মধ্যে ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানলে ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

বরিশাল পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বলেন, ‘চলমান প্রকল্পগুলো যাতে দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’

এছাড়া বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে টানা দুদিনের বৃষ্টিতে হাঁটু সমান পানিতে তলিয়ে গেছে বরিশাল নগরীর বিভিন্ন এলাকা। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে সেসব এলাকার বাসিন্দারা। ফলে বেড়েছে নদ-নদীর পানিও। আর বরিশাল নগরীতে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা।

বরিশাল আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক আবদুল কুদ্দুস জানান, ভারি বর্ষণের ফলে কীর্তনখোলা নদীর পানি বিপৎসীমার দশমিক ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল।

এছাড়া টানা বৃষ্টিতে বরিশাল নগরীর বটতলা নবগ্রাম রোড, মুন্সি গ্যারেজ, বগুড়া রোড, কালীবাড়ি রোড, পলিটেকনিক রোড, ভাটিখানাসহ বেশির ভাগ সড়কে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। কোথাও কোথাও বাসাবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে পানি। বন্ধ রয়েছে বেশির ভাগ দোকানপাট। এতে দুর্ভোগে পড়েছে নগরবাসী। এর বাইরে জোয়ারের পানি বেড়ে নগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

অন্যদিকে, টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরার বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার মৎস্য ঘের, আমন ধান ও সবজিখেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে ১ হাজার ৭০০টি মাছের ঘের তলিয়ে গেছে বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান। আগামী আরো এক-দুদিন এমন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে আরো কয়েক হাজার চিংড়ি ঘের ও পুকুর ডুবে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির যুগ্ম সচিব আলী নূর খান বাবুল বলেন, ‘সাতক্ষীরা শহর ও তার আশপাশের প্রায় অর্ধেক এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। বিশেষ করে শহরের কামালনগর, পুরাতন সাতক্ষীরা, বদ্দিপুর কলোনি, ঘুড্ডিরডাঙি, রসুলপুর, পলাশপোল, ইটাগাছা, কুখরালিসহ শহরের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।’

সাতক্ষীরা পাউবো-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘টানা বৃষ্টিপাতের কারণে যেসব এলাকায় জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা নেই, সেসব এলাকায় দুই-তিন ফুট পর্যন্ত পানি বেড়েছে। পাউবো-২-এর অধীনে ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে।’

সাতক্ষীরা পাউবো-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন জানান, তার অধীনে ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোথাও ভেঙে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় টানা বৃষ্টিতে বাগেরহাট পৌর শহরের বেশির ভাগ এলাকার অলিগলি পানিতে তলিয়ে গেছে। বিড়ম্বনায় পড়েছে শহর ব্যবহারকারীরা। জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। অন্যদিকে টানা বৃষ্টিতে জেলার মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা, রামপাল ও কচুয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পানিতে অনেকের মাছের ঘের ডুবে গেছে। শুক্রবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

বাগেরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল বিরুনী বলেন, ‘পশুর নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে যদি বৃষ্টি অব্যাহত থাকে তাহলে নদীর পানি আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন