কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এখনো বহাল!

নজরুল ইসলাম

ছবি : বণিক বার্তা

এলাকাভেদে স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমিতে প্রতি বর্গমিটারের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শিত  করার সুযোগ রয়ে গেছে এখনো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২ সেপ্টেম্বর জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট, সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিটের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু বাজেটের সময় ঘোষিত আবাসন খাতে  বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নির্ধারিত পরিমাণে কর পরিশোধের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ (কালো টাকা) প্রদর্শিত (সাদা) করা সংক্রান্ত বিধানটি বহাল রাখা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগটি পুরোপুরি অসাংবিধানিক ও অনৈতিক। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের অপ্রদর্শিত বা জ্ঞাত উপায়বহির্ভূত আয়কে বৈধতা দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এ ধরনের নিয়ম দুর্নীতি বা অবৈধ পন্থায় আয়কারীদের উৎসাহ ও সুরক্ষা দেয়। আবাসন খাতে বর্গমিটারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধের পর এর উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলতে পারলে তা সমাজে অস্বচ্ছতা ও অন্যায্যতাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। 

এনবিআরের সাবেক সদস্য (শুল্ক ও মূসক) মো. ফরিদ উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার সব ধরনের সুযোগই বাতিল করা উচিত। এটা অন্যায্যতা, বৈষম্য। সামাজিক ন্যায্যতার প্রতি বড় হুমকি। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এটি বহাল রাখে, তাহলে এটা ছাত্রদের আন্দোলনের মূল দাবির প্রতি অন্যায় করা হবে। কেননা এটা তাদের আন্দোলনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’

আবাসন খাতে কালো টাকা সাদা করতে এলাকাভিত্তিক জমিতে বর্গমিটারে সবচেয়ে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয় রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোয়। এনবিআরের এ-সংক্রান্ত পরিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, এজন্য ঢাকার গুলশান থানা, বনানী, মতিঝিল, তেজগাঁও, ধানমন্ডি, ওয়ারী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন, কাফরুল, নিউমার্কেট ও কলাবাগান থানার অন্তর্গত সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসে প্রতি বর্গমিটারে ৬ হাজার টাকা এবং এসব এলাকায় জমির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১৫ হাজার টাকা কর দিতে হবে।

এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান ও বনানীর মতো অভিজাত এলাকাগুলোয় জমি ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম এখন সবচেয়ে বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব এলাকায় অ্যাপার্টমেন্টের পেছনে ব্যয় লন্ডন-দুবাই-নিউইয়র্কের সবচেয়ে অভিজাত এলাকাগুলোর বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্টের দাম ২০-৩০ কোটি টাকায়ও উঠছে। যদিও নিবন্ধনের সময় এর মূল্য দেখানো হচ্ছে ১-২ কোটি টাকা। এসব অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের বড় একটি অংশ ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। যদিও দেশের বিদ্যমান বেতন কাঠামো অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তারই এসব এলাকায় ফ্ল্যাট কিনতে পারার সামর্থ্য থাকার কথা নয়। 

গুলশানে একদিনেই চারটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবার। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য বলছে, বেনজীরের কেনা ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট চারটির দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অথচ অভিজাত ওই ফ্ল্যাটের বাজার মূল্য ২৫ কোটি টাকারও বেশি। আর সেই পুরো টাকাই নগদে পরিশোধ করা হয়েছিল। বেনজীরের মতো পুলিশের আরো অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই অপ্রদর্শিত অর্থে অভিজাত এলাকায় প্লট-ফ্ল্যাট কিনেছেন। কালো টাকা সাদা করার মতো বিধান এ ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীসহ অভিজাতদের অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ তৈরি করে।  

এনবিআরের প্রজ্ঞাপনের তথ্য অনুযায়ী, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমির পাশাপাশি স্থাপনার ক্ষেত্রেও এলাকাভেদে প্রতি বর্গমিটারের বিপরীতে নির্দিষ্ট অর্থ পরিশোধ করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রয়েছে। এখানে স্থাপনা বলতে কোনো শিল্প-কারখানাকে বোঝানো হয়েছে কিনা জানতে চাইলে শনিবার এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) একেএম বদিউল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ যেকোনো স্থাপনাই এর মধ্যে পড়বে।’  

বাজেট বাস্তবায়ন শুরুর পর গত ১ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যারা অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ প্রদর্শন করেছেন, তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে একেএম বদিউল আলম বলেন, ‘তখন তো সুযোগটি বাতিল হয়নি। তারা সেই সুযোগ পাবেন। তবে তাদের টাকা ওই তারিখের মধ্যেই এ চালানের মাধ্যমে জমা হয়েছে কিনা, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পেছনের তারিখ দিয়ে জমা দিলে হবে না।’ 

এনবিআরের পরিপত্রে বলা হয়, ঢাকা জেলার বংশাল থানা, মোহাম্মদপুর, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা মডেল, ক্যান্টনমেন্ট, চকবাজার, কোতোয়ালি, লালবাগ, খিলগাঁও, শ্যামপুর, শাহজাহানপুর, মিরপুর মডেল, দারুস সালাম, দক্ষিণখান, উত্তরখান, তুরাগ, শাহ আলী, সবুজবাগ, কদমতলী, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, ডেমরা, আদাবর, গেন্ডারিয়া, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর, উত্তরা পশ্চিম, মুগদা, রূপনগর, ভাসানটেক, বাড্ডা, পল্লবী, ভাটারা, চট্টগ্রামের খুলশী থানা, পাঁচলাইশ, পাহাড়তলী, হালিশহর, কোতোয়ালি, নারায়ণগঞ্জের সদর, সোনারগাঁ, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও গাজীপুর জেলার সদর থানার অন্তর্গত সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসে প্রতি বর্গমিটারে ৩ হাজার ৫০০ টাকা কর পরিশোধ করতে হবে। আর জমির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১০ হাজার টাকা কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে।

বাজেট পাস করে প্রণীত অর্থ আইন ২০২৪-এ কালো টাকা সাদা করার বিধান সম্পর্কে বলা হয়, ‘আয়কর আইন, ২০২৩ বা অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তির কোনো পরিসম্পদ অর্জনের উৎসের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবেন না, যদি ওই ব্যক্তি ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৩০ জুন ২০২৫-এর মধ্যে ২০২৪-২০২৫ করবর্ষের রিটার্ন বা সংশোধিত রিটার্ন দাখিলের আগে কর পরিশোধ করে ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্নে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ প্রদর্শন করেন। তবে কর আইন, ২০২৩-এর অধীনে কর ফাঁকির কোনো কার্যধারা চলমান থাকলে; বা এ আইনের অধীন ধারা ২০০-এর অধীন কোনো কার্যক্রম নেয়া হলে এবং তা চলমান থাকলে বা এই আইনসহ অন্য কোনো আইনের অধীনে ফৌজদারি কোনো কার্যধারা চলমান থাকলে এ সুযোগ নেয়া যাবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন) মঈদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সব ধরনের অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ প্রদর্শনই বাতিল করা উচিত। নয়তো দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়। আর আয়ের উৎস ও বৈধতা নিয়ে কেন প্রশ্ন করা যাবে না? জমি বিক্রি করে গরিবরা। কেনেন ধনীরা। তারা কর ফাঁকি দিয়ে অপরাধ করেন। আবার অবৈধ টাকা বৈধ করতে গিয়ে ছাড় পান! এটা তো সংবিধান পরিপন্থী। সংবিধানের ২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অনুপার্জিত আয় ভোগ করা যাবে না।’

ঢাকা জেলার দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও ধামরাই উপজেলা; চট্টগ্রাম জেলার আকবর শাহ থানা, ইপিজেড, কর্ণফুলী, চকবাজার, চান্দগাঁও, ডবলমুরিং, পতেঙ্গা, বন্দর, বাকলিয়া, বায়েজিদ বোস্তামি, সদরঘাট, গাজীপুরের জয়দেবপুর থানা, কালীগঞ্জ, বাসন, কোনাবাড়ী, গাছা, টঙ্গী, টঙ্গী পশ্চিম এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানা ও আড়াইহাজার উপজেলার অন্তর্গত সব মৌজার স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্লোর স্পেসের ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করতে হলে প্রতি বর্গমিটারে ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং জমির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৩ হাজার টাকা কর দিতে হবে।

অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রদর্শিত করার সুযোগটি রাখা যেতে পারে বলে মনে করছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (রিহ্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও ব্রিক ওয়ার্কস লিমিটেডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে খুব বেশি বিনিয়োগ হয় না। সামান্য টাকা আমরা পাই। আমরা এটাকে কালো টাকা বলি না। এটা যারা ভুলে আয়কর ফাইলে দেখাননি বা ঘোষণা দেননি; তাদেরকে আমরা বলি আবাসন খাতে বিনিয়োগ করতে। তবে কালো বা অবৈধ টাকাকে আমরা নিরুৎসাহিত করি। কালো বা অবৈধ টাকা নয়, আমরা চাই অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগ বহাল থাকুক।’

ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন ছাড়া অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও অন্য কোনো উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জেলা সদরে অবস্থিত সব পৌরসভার অন্তর্গত সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসে প্রতি বর্গমিটারে ১ হাজার টাকা এবং এসব এলাকায় জমির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। এর বাইরে অন্য যেকোনো পৌরসভায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসের ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করতে প্রতি বর্গমিটারে ৮৫০ টাকা কর দিতে হবে। এসব এলাকায় জমির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে দিতে হবে ১ হাজার টাকা। এসব কোনো ধাপেরই অন্তর্গত নয় এমন যেকোনো এলাকার সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসে প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ টাকা এবং এসব এলাকায় জমির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৩০০ টাকা কর দিতে হবে।

গত ২ সেপ্টেম্বর কালো টাকা সাদা করার বিধানের এক অংশ বাতিল করা হলেও অন্য অংশ বাতিল করা হবে কিনা জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুরো কর আইনই সংস্কার করা হবে। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা সংস্কার করব। প্রাথমিকভাবে একটি অংশ বাতিল করা হয়েছে। জাতীয় টাস্কফোর্সের সঙ্গে আমরা একসঙ্গে কাজ করব।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন