আলোচনায় অ্যান্ডি ওয়ারহলের ‘মাও’ সিরিজ

সাফকাত সায়েম

ছবি : বণিক বার্তা

সময়টা ১৯৭২ সাল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথ বদলে দেয়ার সময়। স্নায়ুযুদ্ধের আবহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন দীর্ঘ টানাপড়েনের পর চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের সঙ্গে দেখা করতে চীন সফর করেন। নতুন করে সংজ্ঞায়িত হয় দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ। পশ্চিমা গণমাধ্যমে একচেটিয়া প্রচারণা পায় সফরটি। এর মধ্য দিয়েই মাওয়ের ছবি কর্মপন্থা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমা দুনিয়ায়। ঠিক সে পরিস্থিতির পাটাতনে দাঁড়িয়ে মার্কিন চিত্রশিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহল মাও সেতুংয়ের প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করেন।

প্রতিকৃতির জন্য ওয়ারহল মাওয়েরদ্য লিটল রেড বুক থেকে নেয়া একটা ছবিকে আদর্শ হিসেবে ধরেছেন। বইটি চীনা রাষ্ট্রচিন্তকের আদর্শ উদ্ধৃতির একটি সংগ্রহ। ১৯৬৬-৭৬ সালে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় চীনা কমিউনিস্ট দর্শন ছড়িয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বইটি। চীনের জনতার ওপর মাওয়ের যে প্রভাব, সেটা ছায়া বিস্তার করেছে ওয়ারহলের কল্পনাকে। ষাটের দশকে ওয়ারহল ভোগবাদ পুঁজিবাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন তার শিল্পে। মাঝে মাঝে দু-একটা রাজনৈতিক ইশারা দেখা গেলেও তা মুখ্য হয়ে ওঠেনি। সবচেয়ে সফল অংশটা ছিল মূলত অরাজনৈতিক।

নিক্সন চীনে যাওয়ার পর ওয়ারহলের জনৈক বন্ধু মাওকে নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। এটিই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিণত হয় তার প্রথম রাজনৈতিক প্রতিকৃতি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে সচেতন থাকার স্বাক্ষরে। একই বছর ওয়ারহল রিচার্ড নিক্সনকেও চিত্রিত করেছিলেন। কয়েক বছর পর আঁকেন রুশ বিপ্লবী নেতা লেনিনের প্রতিকৃতি। তবে সেগুলোকে ছাপিয়ে গেছে মাওকে নিয়ে কাজ। সেটা কেবল গভীরতায় নয়, পরিমাণেও। মাওকে নিয়ে ওয়ারহলের মোট শিল্পকর্ম ২০৯টি। পাঁচটি সিরিজে ১৯৯টি পেইন্টিং তৈরি করেছিলেন মাওয়ের। পাশাপাশি তৈরি করেছেন ১০টি স্ক্রিনপ্রিন্টের একটি সিরিজ। বিভিন্ন মুদ্রণ, পেইন্টিং অনন্য কৌশলের ব্যাকরণে তৈরি করা হয়েছিল। একটা থেকে আরেকটাতে বদলে নিয়েছেন রঙ। ফলে তৈরি হয়েছে ভিন্ন আবহ। একটা চিত্রেই বহুমাত্রিক সংকেত যেন। মাওকে নিয়ে ওয়ারহলের বড় চিত্রকর্ম চারটি। এগুলো এতটাই বড় যে আঁকার জন্য স্টুডিও নয়; কারখানায় কাজ করতে হতো। এতটাই ব্যয়বহুল হয়েছিল যে সহযোগিতা নিতে হয়েছে দুটি গ্যালারির। প্রথমটি নডলার অ্যান্ড কোং এবং দ্বিতীয়টি ক্যাস্টেলি। সহযোগিতা করেছেন একজন সংগ্রাহক পিটার ব্র্যান্ট। সহযোগিতার স্বীকৃতি হিসেবেই প্রতিটি পক্ষকে একটা করে প্রতিকৃতি উপহার দেয়া হয়। ২০০৮ সালে ক্যাস্টেলির মাধ্যমে মাওয়ের একটা প্রতিকৃতি আসে হংকংয়ে জেমস মেয়রের হাতে। নডলারের সংগ্রহে থাকা চিত্রকর্মটি ১৯৭৪ সালে চলে যায় আর্ট ইনস্টিটিউট অব শিকাগোর কাছে। পিটার ব্র্যান্টও ধরে রাখেননি হাতে। ১৯৭৭ সালে উপহার দেন মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টে। মাওয়ের অতিকায় চতুর্থ প্রতিকৃতিটিকে ওয়ারহল নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। পরে বিক্রি করে দেন। হাত ঘুরে ২০০৭ সালে সেটা চলে আসে জার্মান সংগ্রাহক এরিখ মার্কসের হাতে। মাওয়ের যতগুলো প্রতিকৃতি ওয়ারহল এঁকেছেন, তার মধ্যে চারটি আকারে কাঠামোয় আলাদা; সাধারণভাবেজায়ান্ট মাওহিসেবে পরিচিত।

সথবি-এর মতো প্লাটফর্মগুলোর সুবাদে দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমা চিত্রকর্ম এসেছে প্রাচ্যে। কিন্তু বর্তমানে উল্টো চিত্রও দেখা যাচ্ছে। প্রাচ্যে আসা সে চিত্রকর্মগুলো ফের জায়গা খুঁজে নিচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়ায়। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ওয়ারহলের মাও। চীনা সংগ্রাহক লিউ ইচিয়ান ওয়াং ওয়েইয়ের উদ্যোগে নির্মাণ হয়েছিল বেসরকারি সংগ্রহশালা লং মিউজিয়াম। গত বছর থেকে তারা তাদের সংগ্রহশালা থেকে বিক্রিও শুরু করেছে। নানা হাত ঘুরে তাদের কাছে এসেছিল মাওয়ের সেই অতিকায় প্রতিকৃতির একটি। সম্প্রতি তা ১০ কোটি ডলারের বেশি দামে বিক্রি হতে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন