মিজানুর রহিমের বহুমাত্রিক দুনিয়া

সাফকাত সায়েম

শিল্পী: মিজানুর রহিম

সমকালীন দেশীয় চিত্রকলায় বহুমাত্রিক নাম মিজানুর রহিম। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে পেশা হিসেবে নেন শিক্ষকতাকে। সে শিক্ষকতার সঙ্গেই জড়িত ছিলেন চার দশক। এর মধ্যে উচ্চ শিক্ষার জন্য বেলজিয়ামে ছিলেন ১৯৭৫-৮০ সাল। সমকালীন চিত্রকলা নিয়ে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে চিত্রকর্মে। বাংলাদেশ ও বেলজিয়ামে তার বেশকিছু একক প্রদর্শনী হয়েছে। অংশগ্রহণ করেছেন চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, বুলগেরিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম ও বাংলাদেশের প্রদর্শনীতে। তার কাজ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর ও দেশী-বিদেশী সংগ্রাহকের হাতে।

জীবনের এ পর্যায়ে দাঁড়িয়েও মিজানুর রহিম একজন তরুণ শিল্পীর মতো কাজ নিয়ে মগ্ন। উৎসাহ পান তার একমাত্র কন্যা সাভেরা মিজান ও তার মেয়ে জামাই রাফায়াত রাকিবের। তার সাম্প্রতিক বড় কাজগুলোর প্রায় সবই অ্যাক্রেলিক। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিমূর্ত। নিসর্গ ও প্রকৃতি তার প্রধান অনুপ্রেরণা। কিন্তু শুরুটা তার এমন ছিল না। বেলজিয়ামে থাকা দিনগুলোয় তিনি বেশকিছু ফিগার আর্ট করেছেন। আর্টিস্ট্রি অব ফর্ম-৫ ও আর্টিস্ট্রি অব ফর্ম-৬ তার মধ্যে অন্যতম। স্কেচধর্মী অঙ্কনগুলোকে সমকালীন নির্মাণের পাশে দাঁড় করালে দীর্ঘ সময়ে শিল্পীর বিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।

নব্বইয়ের দশকে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু লিথো তৈরি করেছেন। তার মধ্যে ১৯৯৬ সালে তৈরি দ্য হারিকেন, দি অবলিভিয়ন ও এটারনাল নাইট পৃথকভাবে নজরে আসে। শিল্পীর আঁকায়ও ক্রমে রঙ জমতে থাকে। আগের ফিগার আর্ট ক্রমে বিবর্তিত হয়ে নৈসর্গিক রূপ নেয় এ পর্যায়ে। ২০১১ সালে শ্যাডোড ক্যানোপি ও স্টর্ম’স অ্যাপ্রোচ নামে দুটি চিত্রকর্মের কথা এক্ষেত্রে সবার আগে উল্লেখ করা যায়। চিত্রকর্ম দুটিতে সবুজ, কালো ও লাল রঙের যে মিশেল, তা ঈর্ষণীয় মুনশিয়ানাকেই ফুটিয়ে তোলে। তবে ১০ বছরে শিল্পীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি গাঢ় রঙ ব্যবহার করেছেন, যা আগে খুব একটা দেখা যায়নি। নীল রঙের প্রতি তার আলাদা টানেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। নীল রঙের প্রেক্ষাপট তৈরি করে সেখানে নিজের চিন্তাকে তুলে ধরা। একদিকে ২০২৩ সালে আঁকা কোয়ায়েট কনটেমপ্লেশন, হারবিংগার অব দ্য ডিপ, আনইয়েল্ডিং স্পিরিট ও ফিগারিস্ট মোশন; অন্যদিকে ২০২৪ সালে আঁকা সলিটারি রিফ্লেকশনস, ডার্ক ওভারচার, পিনাকলস অব সলিচুড, পিসফুল পারসিস্ট্যান্স। এ সময়ের ফিগার আর্টেও দেখা যায় বিবর্তন। হিলিং হ্যান্ডস ও রিলেন্টলেস এন্ডেভার এমন দুই অনন্য উদাহরণ, যেখানে তিনি রঙের ব্যবহারে অন্য মাত্রার আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

জাহিদুর রহিমের রঙের ব্যবহারও ব্যাকরণ মেনে চলা। কোনোটি সবুজ প্রধান ও নীলের সমারোহ। কোনোটিতে লাল আবার হলুদের প্রাধান্য। কালোর সমাবেশও রয়েছে বেশ। তার দাবি বাদামি ও খয়েরি রঙ প্রধান ছবির অনুপ্রেরণা এসেছে অস্ট্রেলিয়ার পর্বত গুহার ইমেজ থেকে। আকাশ, নদী, উপকূল, পাহাড়, সবুজ শস্য খেত এসবই তার বড় কাজের উপজীব্য। লাল প্রধান বিমূর্ত বিন্যাসও রয়েছে। বেশির ভাগ কাজ বর্গাকৃতি কিংবা প্রায় বর্গাকৃতির; কয়েকটা উল্লম্ব আয়তাকার। ২০২৩ সালে আঁকা মিজানুর রহিমের বেশকিছু নিসর্গ দৃশ্য অনুভূমিক আয়তাকার, এতে তুলির সঙ্গে স্পেচুলার ব্যবহার চমৎকার টেক্সচার পেয়েছে। শিল্পীর সাম্প্রতিক কাজে বিমূর্ত সৃজনের পাশাপাশি মানব অবয়বভিত্তিক ছবিও রয়েছে। নীলাভ পরিপ্রেক্ষিতে এক হালকা নীল তথা সাদাটে শাড়ি পরিহিতার চিত্রটি অনবদ্য। ফিগার ড্রইংয়ে তিনি যে দক্ষ, তার প্রমাণ রেখেছেন।

জাহিদুর রহিম উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন ছাপচিত্র নিয়ে। সে সময়ে তার আঁকা বেশকিছু ফিগার ড্রইং পরিচিতি অর্জন করে। লিথো মাধ্যমে তৈরি তখনকার কিছু কাজ শিল্প রসিকদের নজর কাড়বে সন্দেহ নেই। একইভাবে সমকালীন ও পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী ও শিল্পরসিকদের আনন্দ দেবে ও উজ্জীবিত করবে। দীর্ঘ সময় তিনি শিল্প শিক্ষাদান ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা প্রশাসনে যুক্ত ছিলেন। তাতেও আন্তরিকতা ও দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। তার শিল্পজীবনে সে অভিজ্ঞতা প্রতিবন্ধকতা হয়েছিল বলে মনে হয় না।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন