আলোকপাত

এটা কি তবে বাংলাদেশের আরব বসন্ত?

ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ

ছবি : বণিক বার্তা

বহুকাঙ্ক্ষিত সরকারি চাকরিতে সমসুযোগের দাবিতে গত কয়েক সপ্তাহে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কঠোর দমন-পীড়ন চালিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ সামাল দিতে সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে, কঠোর কারফিউ জারি করেছে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। হাজার হাজার পুলিশ ও অর্ধসামরিক বাহিনী রাস্তায় পাহারা দিচ্ছে এবং এতে ১৭০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছে।

স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে অসাধারণ কিছু অগ্রগতির গল্প লেখা দেশটিতে এ ধরনের অস্থিরতা হঠাৎ করেই চলে আসেনি। আরব বসন্তের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়া বাংলাদেশী তারুণ্যের এ উত্থান দেখিয়েছে কীভাবে দুর্নীতি, গোষ্ঠীতন্ত্র ও বৈষম্যের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসক গোষ্ঠীর অধীনে জিডিপি বৃদ্ধি হয়ে থাকে। 

২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই গত দুই দশকে বাংলাদেশের সরকারি খাতে কর্মী সংখ্যা বেড়েছে এবং সরকারি কর্মচারীরা ধারাবাহিক বেতন বৃদ্ধি ও উন্নত সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু এসব চাকরি পাওয়া এখন রাজনৈতিক সমর্থনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার চাকরি দেবে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় কম রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারুণ্যের আনুগত্য থাকবে সরকারে—এ পরোক্ষ সামাজিক চুক্তি ভেঙে গেছে।

বাংলাদেশকে অসংখ্য বেকার ও অর্ধবেকার তরুণকে শ্রমবাজারে যুক্ত করতে হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর শেষ করার পর এক বা দুই বছরের মতো বেকার থাকছেন। আরো দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছে, যা বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ। দুর্ভাগ্যবশত, বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে আছে এবং সার্বিকভাবে বেতন বৃদ্ধি ধীরগতির, যা সরকারি চাকরির প্রতি মোহ বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রকৃত সমস্যা হলো সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা। ১৯৭২ সালে চালু হওয়া এ ব্যবস্থা কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা বরাদ্দ শুরু করে। ২০১০ সালে এ সুবিধা তাদের নাতি-নাতনিদের পর্যন্ত দেয়া হয়। ২০১৮ সাল নাগাদ সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য সংরক্ষিত ছিল। বাকি ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ সুবিধাবঞ্চিত জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। একই বছরে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সব কোটা বাতিল করে।

কিন্তু গত জুনে দেশের হাইকোর্ট সরকারি চাকরিতে বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেন। ফলে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার আগে ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা সংস্কারের দাবি তোলেন। এটি প্রথমদিকে মূলত আওয়ামী লীগের অনুগতদের পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয়। হাজার হাজার বীর যোদ্ধাদের জাল সনদ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে মেয়র, সংসদ সদস্য, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনসহ প্রায় ১১ হাজার লোককে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

শাসক দলের সহিংস প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা ছিলেন এ আন্দোলনের মূল শক্তি। সাম্প্রতিক দশকে কন্যাশিশু ও নারীরা শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ নিয়ে তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ রয়েছে তার প্রতিফলন ঘটেছে এ আন্দোলনে। শ্রমশক্তিতে শহুরে নারীদের ২০১০ সালে যেখানে অংশগ্রহণ ছিল ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ, তা ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ৩১ শতাংশে নেমে আসে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ উপাত্তে দেখা গেছে, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। শহুরে নারীদের বেকারত্বের হার (৯ দশমিক ৬ শতাংশ) পুরুষের তুলনায় (৩ দশমিক ৮ শতাংশ) বেশি, আর ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণীদের বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ, যা একই বয়সী পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ। এমনকি তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের অনুপাতও কমেছে।

গত ২১ জুলাই উচ্চ আদালত ত্বরিত গতিতে নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে সরকারি চাকরির ৯৩ শতাংশ পদ যোগ্যতার ভিত্তিতে পূরণ করার নির্দেশ দেন। আদালতের এ রায় কোটা ব্যবস্থার সংস্কার এবং দেশে আপাত স্বস্তি ফিরিয়ে আনলেও আওয়ামী লীগ শাসনামলের শুরু থেকে হয়ে আসা স্বজনপ্রীতির রাজনীতির সমাধানে তেমনভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে না। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে, যৌক্তিক সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারের ক্ষমতা কমেছে এবং অর্থনীতি ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি এবং সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কর্মকর্তাদের প্রবল দুর্নীতি জনসমাজে ক্ষোভ আরো বাড়িয়েছে।

যদিও সাময়িকভাবে দমন করা হয়েছে, তবুও তরুণদের প্রতিবাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হতে পারে। পুলিশ কর্তৃক প্রকাশ্য দিবালোকে একজন নিরস্ত্র ছাত্রকে হত্যার ভিডিও ফুটেজ দেশবাসী, বিশেষ করে যারা কোটা সংস্কারের উপকারভোগী হবে আগামীতে তাদের মর্মাহত করেছে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি করেছে। এর পরও নিরাপত্তা বাহিনীর এমন অপব্যবহারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়নি।

জনগণের প্রকৃত সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও গত জানুয়ারির নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ।বেশিরভাগ বিরোধী দলের বয়কটে আয়োজিত প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। নির্বাচিত হয়েই সমাজের বিভিন্ন স্তরে কঠোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে এ সরকার।আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমঝোতা ও আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে মন্ত্রিসভায় এমন সদস্য বিরল। অনেকে মনে করতে শুরু করেছেন, ছাত্রদের আন্দোলনে কঠোর দমননীতি ব্যবহার করে সরকার ক্ষমতায় থাকার সব অপশন ফুরিয়ে ফেলেছেন। 

এসব কিছুই ইঙ্গিত করে যে, বর্তমান প্রতিবাদ আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য যুগান্তকারী পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে যা নির্বাচনী গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে। একই সঙ্গে এটি ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে সহায়তা করতে পারে।

যা-ই হোক, ২০১১ সালের আরব বসন্তের মতো, কর্তৃত্বপরায়ণ নেতাদের বিরুদ্ধে গণ-উত্থান সবসময় সফল হয় না এবং ব্যর্থ বিপ্লব আরো দমন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে পরিচালিত করতে পারে। এছাড়া অস্থিতিশীল বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক বিষয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট নিষ্পত্তির চলমান প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে, বাংলাদেশকে চীনের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে এবং ভারতের ভূমিবেষ্টিত উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

বাংলাদেশে তরুণদের প্রতিবাদের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, যা ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বর্তমান গণবিক্ষোভ দেখায় যে, তরুণ বাংলাদেশীরা আবারো দেশকে একটি গণতান্ত্রিক পথে পরিচালনা করতে এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হতে পারে।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ: মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি অর্জন করেন। বাংলাদেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি প্রফেসরিয়াল ফেলো। এছাড়া তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়া (২০১৪-২২) ও যুক্তরাজ্যের রিডিং ইউনিভার্সিটিতে (২০০৬-১৩) অধ্যাপনা করেছেন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন