অভিমত

বন্যা-পরবর্তী ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সমন্বিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

গত ৫ আগস্ট ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী  এলোমেলো অবস্থায় হঠাৎ করে প্রচণ্ড বন্যার কবলে পড়েছে দেশের ১১টি জেলার ১০ লাখ ৯ হাজার ৫২২টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধকোটির ওপরে। ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন স্তরে প্রশাসনিক শূন্যতার কারণে মশকনিধন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় মশক প্রজননের পরিমাণ বহুলাংশে বেড়েছে। ফলে জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। আবার পুরো জুনে রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৯৮ জন, সেপ্টেম্বরের দুইদিনেই রোগীর সংখ্যা হয়েছে ৭৬৭ জন। এটা সত্যিই অত্যন্ত ভয়ংকর। তার ওপর বন্যাকবলিত মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় তারা সর্বাত্মক ডেঙ্গু ঝুঁকিতে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার পরিপূর্ণ প্রজনন সময় চলছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ভাঙা রাস্তাঘাট, ডোবা, ব্যাম্ব স্ট্রাম্ফ, লিফ এক্সইল, গাছের ছিদ্র প্রভৃতি প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রগুলোর বিস্তৃতি যেমন বাড়চ্ছে, একই তালে এডিস মশার ট্রান্সমিশন হচ্ছেও সমান তালে। তাই বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় মানুষের জন্য এক অকল্পনীয় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে। এ বছরের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বিশ্লেষণে দেখা যায় চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশন ছাড়া) সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাও আশঙ্কাজনক। আবার ডেঙ্গুর চিকিৎসাও এক ভয়ানক নৈতিক বিপর্যয় বয়ে আনবে। সব মিলিয়ে এক অশনিসংকেত চলছে দক্ষিণ অঞ্চলসহ সারা দেশে। এখন এ চরম দুর্ভোগ মোকাবেলায় আমাদের কী করণীয়। এডিস মশার যে প্রজাতি গ্রামে বা জঙ্গলে পাওয়া যায় তা হলো এডিস অ্যালবোপিকটাস। বর্তমানে এ প্রজাতি অত্যন্ত শক্তিশালী উঠেছে। ত্রাণ তৎপরতার জন্য শহর থেকে বন্যা-অধ্যুষিত এলাকার প্রচুর আনাগোনার মাধ্যমে উভয় প্রজাতি অর্থাৎ এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস অ্যালবোপিকটাসের বিস্তৃতি চলছে সমানতালে। একইভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তৃতিও ঘটছে প্রকট হারে। তাই বন্যাকবলিত এলাকার মশাও ডেঙ্গুর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলবে। এ অবস্থায় সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে এখুনি নিম্নক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ আশু প্রয়োজন। 

 বন্যার্তদের মাঝে কাপড় বিতরণের সময় অবশ্যই মশারি বিতরণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। 

 পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের সময় মশার কয়েল বিতরণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

 মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরঞ্জামাদি ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা।

 সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রজননস্থল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান প্রদানের ব্যবস্থা করা।

 সব অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করে করণীয় নির্ধারণ করে দেয়া।

 যেসব মানুষ নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে তাদের বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানিতে জন্মানো লার্ভা ধ্বংসের ব্যবস্থা গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। 

 স্থানীয় সরকারের যে যে ইউনিট কর্মক্ষম আছে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মশক নিধন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। 

 বন্যাকবলিত এলাকার যেসব স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, খেলার মাঠ, হাট-বাজার, মন্দির, প্যাগোডা প্রভৃতি স্থাপনা ও স্থানে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রজনন ক্ষেত্রে অবশ্যই লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড স্প্রে করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবদিক থেকেই আমাদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। তাই একে মোকাবেলা করা অত্যন্ত কঠিন হলেও জরুরি। তাই হাল ছাড়লে চলবে না। কারণ মশার বিস্তৃতি থাকলেও যদি তা আক্রান্ত না হয় তবে কিছুটা স্বস্তি থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, অনাক্রান্ত মশাও এখন জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটাচ্ছে। তাই এ জটিল সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে আমাদের নিরাপত্তা। একটি প্রাণও আমাদের কাছে মহামূল্যবান।

 বন্যাকবলিত এলাকার চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোকে ডেঙ্গু রোগীর প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিতকরণের জন্য সুবন্দোবস্ত করা প্রয়োজন। অর্থাৎ চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা।

 বিদ্যালয়গুলো খোলার আগে এবং পরে শিক্ষার্থীর মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।

 জনসাধারণ শুধু সচেতন হলেই হবে না, মশক নিধনে সব ধরনের কর্মকাণ্ডে সবাইকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা নিশ্চিত করতে হবে। এটা শুধুই সরকারের দায়িত্ব নয়।

 মশক নিধন করে ডেঙ্গুর বিস্তৃতি রোধ করা প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক ও মৌলিক দায়িত্ব।

বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য ছাত্রসমাজ আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছে। দেশ সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে প্রতিটি স্থানেই অতন্দ্রপ্রহরীর মতো কাজ করে চলেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত অকস্মাৎ বন্যা মোকাবেলায় তাদের তুলনা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসিতে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় স্বেচ্ছায় কত নিয়মতান্ত্রিকভাবে ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ ও নির্দিষ্ট স্থানে বিতরণ চলছে। ৫ আগস্ট এমন বিজয় অর্জনের পর সব অশনি শক্তিকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে এ অকুতোভয় ছাত্রসমাজ। এজন্যই বাংলাদেশের মানুষ প্রচণ্ড আশায় বুক বেঁধেছে। তাই বন্যা-উত্তর ডেঙ্গুর চোখরাঙানিকে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে অবশ্যই সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে আমরা সক্ষম হব ইনশা আল্লাহ। জেড-জেনারেশনের কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন