পদত্যাগ করিয়ে নতুন লোক বসালেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না

ছবি : বণিক বার্তা

ড. কাজী মারুফুল ইসলাম অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি এবং বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেছেন। রাষ্ট্র, শাসন ব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বিষয় তার গবেষণায় অগ্রাধিকার পেয়েছে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য একাধিক গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও শাসন ব্যবস্থাসহ প্রাসঙ্গিক আরো বিষয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবরিনা স্বর্ণা

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ‘উন্নয়ন’ শব্দটা আমরা বেশ শুনেছি। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকারের পতন ঘটল। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন আসলে কতটা অর্থপূর্ণ?

আমরা উন্নয়ন উন্নয়ন বলে এক ধরনের জিগির এতদিন শুনেছি এবং কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের সমাজের ব্যাপক উন্নয়ন প্রয়োজন। কিন্তু উন্নয়ন শব্দটিকে যেভাবে আমরা শুনে আসছিলাম, বিশেষ করে গত ১৩-১৪ বছরে, সেখানে উন্নয়নকে কেবল একমাত্রিকভাবে দেখানো হয়েছিল। আর সেটা হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এ ধরনের (অবকাঠামোগত) উন্নয়নের এক ধরনের রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। অর্থাৎ এটির সঙ্গে অনেকগুলো অর্থনৈতিক সম্পর্ক যুক্ত। এখানে অর্থনীতিতে মূলত আমরা যা দেখেছি তা হলো দুর্নীতি, শোষণ ও সম্পদের পাচার। ফলে উন্নয়ন বলতে যে ধারণাকে বাজারজাত করা হয়েছে গত শাসনামলে সেটা মূলত ছিল তাদের একটা দীর্ঘ অর্থনৈতিক শোষণ ও সম্পদ পাচারের একটি দীর্ঘ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। তার হাত ধরে কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেটা সারা দেশেই হয়েছে, যা অস্বীকার করার কোনো রাস্তা নেই। কিন্তু আমরা এ জায়গায় ফিরতে চাই যেখানে উন্নয়ন বলতে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বোঝাবে না।

এটা নিয়ে কোনো একাডেমিক বিতর্কের সৃষ্টি না করে যে ভদ্রলোকের সংজ্ঞাটা বেশ সহজে বোধগম্য এবং অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য সেটি নিয়েই আলোচনা করি। অমর্ত্য সেনের বই ‘Development as Freedom’-এ তিনি কতগুলো পরাধীনতাকে চিহ্নিত করেছেন আর সেই পরাধীনতা থেকে মুক্ত বা স্বাধীন হওয়াটাই হলো উন্নয়ন। সুতরাং এ সংজ্ঞায়নের জায়গা থেকে যদি আমরা দেখি তাহলে বলতে পারি না বিগত বছরগুলোয় যে উন্নয়ন হয়েছে সেটা মানুষকে স্বাধীন করেছে বা তার পছন্দ বা বেছে নেয়ার ক্ষমতাকে বাড়িয়েছে। স্বাধীনতার অন্যতম একটা জায়গা হলো মানুষের বাকস্বাধীনতা। মানুষের কথা বলার অধিকার, ভোটের অধিকার, পছন্দ করার অধিকার—এসব অধিকার তো ছিল না। ফলে যেটা হয়েছে—জিডিপির হার বা পরিমাণের সঙ্গে রাজনৈতিক অনুন্নয়ন বা মানবাধিকারের লোপ ঘটার তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে যে উন্নয়নের গল্প অনেকটাই ফাঁপা বেলুনের মতো হয়েছে এবং তা ফেটে যাচ্ছে। 

সেজন্য আমি বলব সামগ্রিক উন্নয়ন হয়নি। একটা অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেষ্টা ছিল, যে প্রক্রিয়ার মধ্যে আবার সম্পদ পাচার, দুর্নীতির মতো অপরাধগুলোও জারি ছিল। বস্তুত সেটা আমাদের অনুন্নয়নের দিকেই নিয়ে গেছে। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কোন দিকে এ সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করছেন, যেকোনো দেশের প্রেক্ষাপটেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের করণীয় কী হতে পারে? 

সুশাসনকে আমরা একটু অন্যভাবে দেখতে পারি, কারণ এ ধারণা নিয়েও একটি বিতর্কের জায়গা আছে। তার পরও যদি সুশাসনের মোটাদাগের সংজ্ঞা বলি তাহলে এর মূল বা প্রধানতম শর্ত হচ্ছে গণতান্ত্রিকতা। তার মানে, আমাদের সমাজে সুশাসন কিন্তু শাসন বা রাজনীতি থেকে আলাদা নয়। রাজনীতিতে যদি গণতন্ত্র না থাকে তাহলে শাসন কখনো ‘সু’ হয় না। সেটা কুশাসনে পর্যবসিত হয়। কারণ যারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন গণতন্ত্র তাদেরকে একটা দায়বদ্ধতার মধ্যে নিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করে। যেমন প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন বা যদি একটা কার্যকর সংসদ থাকে তাহলে সংসদের মধ্য দিয়ে জবাবদিহি বা দায়বদ্ধতার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকে। 

সুশাসনের সর্বজনীন সংজ্ঞাটার ওপর যে বিতর্ক সেটাকে পাশে রেখেও যদি আমরা ভাবি তাহলে সুশাসন বলতে প্রথমত ও প্রধানত হলো দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি নিশ্চিত করা। কিন্তু সেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে গেলে আমাদের এমন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা থাকা দরকার, যার মাধ্যমে যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তাদের সাধারণ জনগণ জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারবে। সেটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকদিন আমাদের দেশে অনুপস্থিত। এটা যে শুধু গত ১৫ বছরে অনুপস্থিত ছিল তা নয়, ১৯৭২ সাল থেকেই আমরা এক্ষেত্রে ক্রমাগতভাবে পিছিয়েছি। এরপর সুশাসনের অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ। সেটি নিশ্চিত করার অন্যতম উপায় হলো একটি নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থা করা। যেসব উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হবে সেগুলো স্বচ্ছভাবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা। সেটির মধ্যে জনগণের মতামতকে মূল্য দেয়ার ব্যবস্থা করা যা করা হয়নি। বরং এর বিপরীতে আমরা দেখেছি সিদ্ধান্তগুলোকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনাগুলোয় নাগরিকদের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অস্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতার অভাব দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছে। ফলে আমাদের বর্তমান সরকারের কাছে জন-আকাঙ্ক্ষার একটি প্রবল চাপ রয়েছে যেখানে যে উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক না কেন তার শুরুই হতে হবে দুর্নীতি দমন করা দিয়ে, নিদেনপক্ষে একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যে নিয়ে আসা এবং এটির জন্য এ সরকারেও যারা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছেন তাদেরকেও প্রশ্ন করে যেতে হবে, দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে হবে। 

তাৎক্ষণিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কীরূপ কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে? আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক পদত্যাগের হিড়িক দেখছি সেটি আদৌ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কোনো সুফল বয়ে আনবে নাকি পরিস্থিতিকে আরো বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যাবে?

পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়। যারা আজকে বিভিন্ন পদে আছেন তারা বিগত সরকারের আমলে ওইসব পদের দায়িত্ব পেয়েছেন—এটা একটি সরল সিদ্ধান্ত হবে। নিশ্চিতভাবে অনেকেরই সেই পদে যাওয়ার যোগ্যতা আছে। অনেকেরই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে এবং সরকারি কাজ বা সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি আছে। তাদের যদি রাতারাতি সরানো হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে একটি বড় রকমের শূন্যতা তৈরি হবে এবং হয়েছেও। এটি যেকোনো উদ্যোগ দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এখানেই প্রশ্ন আসে, এ রকম পরিস্থিতি কেন উদ্ভূত হয়েছিল? কারণ হলো আইনের শাসনের অভাব। আইনে বলা হয়েছে, দায়িত্বশীল পদগুলো যোগ্যতার ভিত্তিতে অধিকৃত হবে কিন্তু সেখানে যোগ্যতা ছাড়াও রাজনৈতিক আনুগত্যের মাপকাঠি একটি পরিমাপক হিসেবে কাজ করেছে। যার যে বিচার পাওয়ার কথা সে বিচারগুলো তারা পাননি। কারণ হলো, হয় সেখানে আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে নতুবা আইনের প্রয়োগই হয়নি। ফলে আইনের শাসনের বারবার ব্যত্যয় ঘটেছে।

সেজন্য আমি মনে করি না যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে পদত্যাগ করিয়ে সেখানে রাতারাতি আরেকজনকে এনে বসিয়ে দিলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রথম শর্তই হলো নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা, আইন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নিয়ম না মেনে চললে কখনই কিছুর সুফল পাওয়া যাবে না। আমাদের আইনে অবশ্যই দুর্বলতা আছে কিন্তু আইন তো আছে। সেই আইন ন্যূনতম অনুসরণ করলে এ রকম বিশৃঙ্খলা হওয়ার কথা নয়। একটি উদাহরণ দিই। আমরা গত শাসনামলে দেখেছি অনেকগুলো মামলায় এমন কিছু মানুষের নাম জড়িয়ে দেয়া হয়েছে যারা কিনা মৃত, কেউ কেউ ঘটনার সময় বিদেশেও অবস্থান করছেন, অর্থাৎ কোনোভাবেই তারা ওই ঘটনায় জড়িত নন। তাদের হয়রানির জন্য এমন মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা করা হয়েছে। আইন যদি ঠিকমতো প্রয়োগ হতো তাহলে এ ধরনের মামলা আদালতের গ্রহণ করার কথাই না বা পুলিশ থেকেও সেখানে কোনো রকম চার্জশিট দেয়ার কথা নয়। অনেক ক্ষেত্রে মামলাই হওয়ার কথা নয়। এভাবে পর্যালোচনা ছাড়া যদি মামলা গৃহীত হতে থাকে তাহলে আইনের শাসন আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে এবং ক্রমশ সেটা আরো কঠিন হয়ে যাবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকে যা নির্বাচিত সরকারের থাকে না। সীমার মধ্যে থেকেই বর্তমান অরাজক পরিস্থিতি সামাল দিতে বা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বর্তমান সরকারকে আপনি কী পরামর্শ দিতে চান?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বললে, রাষ্ট্রকে টিকে থাকতে হলে রাষ্ট্রের ‘লেজিটিমেট মনোপলি অব ভায়োলেন্স’ থাকতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের টিকে থাকার প্রয়োজনে তার সীমানার মধ্যে একটা বৈধ ও গ্রহণযোগ্য কর্তৃত্ব তৈরি করতে হবে যে রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পর্যায়ে সংঘটিত সহিংসতা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সাধারণ সময়ে সেই দায়িত্ব একটি রাষ্ট্রের পুলিশ থেকে শুরু করে বিডিআর, সেনাবাহিনী পর্যন্ত বিভিন্ন বিন্যাসে পালন করে থাকে। এ প্রায়োগিক জায়গার সামর্থ্য যখন কমে যায় তখন সমাজের বিভিন্ন জায়গা থেকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর উত্থান এবং পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে সহিংসতার উৎপাদন হতে থাকে যা আইনের শাসন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে দেয়। দেশে এখন সে রকমই একটি পরিস্থিতি বিদ্যমান।

এ রকম পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো একটি দক্ষ, জনবান্ধব ও পেশাদার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গড়ে তোলা। যেটি সবকিছুর ওপরে নিয়ন্ত্রণ তৈরি করতে পারবে। এটিকে প্রশাসনিকভাবে তৈরি ও পরিচালিত করার যে বৈধতা সেটা এ সরকারের রয়েছে। কারণ এ সরকারের কাছে জনগণের সেই আকাঙ্ক্ষা এবং জনসমর্থন রয়েছে।

সম্প্রতি আমরা দেখলাম, একটি আনসার বাহিনীর কিছু সদস্য তাদের দাবি-দাওয়া জানাতে সমবেত হলো। সরকার সেগুলো বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দিলেন। অর্থাৎ বিষয়টিকে স্বাভাবিক অহিংস পন্থায় মোকাবেলার চেষ্টা করা হলো। তারা এ ব্যবস্থা মানলেন না এবং সহিংস হয়ে উঠলেন। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ফোর্স প্রয়োজন এবং সেই ফোর্সটা প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে চলবে না। কেননা জনদাবি রয়েছে যে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগও করতে হবে। ফলে এ জায়গাতেই প্রথমত ও প্রধানত কাজ করতে হবে। 

এক্ষেত্রে আমি মনে করি না যে পুলিশ বাহিনীকে এখন সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করার কোনো প্রয়োজন আছে। কারণ পুলিশ বাহিনীতে অসংখ্য যোগ্য মানুষ আছে। বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ করা হলেও নিয়োগকৃতদের মধ্যে কিছু যোগ্য মানুষ আছে এবং এজন্য দ্রুত এ বাহিনীর একটা নিরপেক্ষ ও পেশাদারি মূল্যায়নে যাওয়া প্রয়োজন। একটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা করে দ্রুততার সঙ্গে যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের বাছাই করে আনতে হবে। সমর্থন দিয়ে তাদের সক্রিয় করতে হবে যেন তারা সমাজে এখন প্রাথমিকভাবে যে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা তৈরি করা দরকার সেটি করতে আইনসম্মতভাবে বলপ্রয়োগ করতে পারে। এখন এটি নিশ্চিত করাই প্রধান কাজ। 

দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ধারায় প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে দেখেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে দেশের সিংহভাগ জনগণ বিশেষত তরুণ প্রজন্ম চাইছে নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি যেটি পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। সে রকম কোনো সম্ভাবনা বা উপায় দেখতে পাচ্ছেন?

অনাগত ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি অনুমান করা উচিত নয়, কারণ সেখানে ভুল প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কোনো একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থানে কতগুলো বাস্তব শর্ত লাগে, সে শর্তগুলো আমি এখন উপস্থিত দেখছি। প্রথমত, আমাদের সনাতন রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা প্রমাণিত যার সাক্ষী আমরা সবাই। এটা নিয়ে নতুন কোনো গল্প বলার সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, এসব দলের চেয়েও পুরনো ঔপনিবেশিক আমলে প্রতিষ্ঠিত আরো কিছু দল রয়েছে, যেমন কমিউনিস্ট পার্টি বা এ রকম কিছু পুরনো দল যারা কিনা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক উপযোগিতা ধরে রাখতে ক্রমশ ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং বাস্তবে এ দেশের শ্রমজীবী বা ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষাকে পুরোপুরিভাবে ধারণ করতে পারে এমন রাজনৈতিক দলের পরিষ্কার অভাব আছে। সেই অভাবটা পূরণের জন্য বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যাদের নেতৃত্বে এবারের গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে তাদের মধ্যে আমি কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি। এক. তারা প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন। দুই. তাদের নেতৃত্বের ধরন সনাতনী নেতৃত্ব থেকে আলাদা। এটা বেশ বিকেন্দ্রীভূত এবং এরা সৃজনশীল ও ফ্লেক্সিবল। এদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী ও মতধারার পারস্পরিক লেনদেন ও সহ-উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। খেয়াল করবেন, আন্দোলনে ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ অন্য ইউনিটগুলোও তাল মিলিয়ে কাজ করছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করেছে। অথচ এরা কেউ কারো অধীনস্থ নয়, কোনো একক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়। এটা সাম্প্রতিক বিশ্বের চলমান প্রবণতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। 

এ ছাত্র নেতৃত্ব প্রকাণ্ড একটি আন্দোলন ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক চেতনা সংগঠিত হচ্ছে। যেটা হয়তো শুরুতে ছিল না। এখন তাদের আকাঙ্ক্ষা, বোঝাবুঝি ক্রমশ একটির সঙ্গে অন্যটির বিনিময় হচ্ছে, তাদের কমন স্মৃতি ও কল্পনা তাদেরকে আরো কাছাকাছি আনছে। ফলে তাদের নেতৃত্বও স্পষ্ট হচ্ছে। যেহেতু বাজারের ডিমান্ড-সাপ্লাই নীতি অনুযায়ী দেশে এখন তরুণ নেতৃত্বের চাহিদা আছে এবং তরুণদের মধ্যেও সে রকম প্রস্তুতি দেখা দিচ্ছে, সেহেতু চাহিদা ও জোগানের মেলবন্ধন ঘটার একটা সম্ভাবনা আমি দেখছি। 

আমি মনে করি, এ আন্দোলনকে নেতৃত্ব দানকারী প্লাটফর্মটি যদি নিজেদের মধ্যকার ঐক্য টিকিয়ে রাখতে পারে এবং জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে না যায় তাহলে নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা আমি দেখছি।

জন-আকাঙ্ক্ষার সূত্র ধরেই বলি, সুশাসনের বড় অংশীজন জনগণ। বিগত কোনো সরকারই সরলভাবে ক্ষমতা ছাড়েনি, তাদের অবসানও স্বাভাবিকভাবে হয়নি। জনগণের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ততা ধরে রাখতে পারেনি। সেই জায়গা থেকে বর্তমান সরকারকে কী সুপারিশ করবেন?

বাংলাদেশ আসলে অদ্ভুত একটা দেশ। আমরা আগে ভাবতাম আমরা রাষ্ট্র ছাড়া চলতে পারি না, কিন্তু সম্প্রতি আমরা প্রমাণ করেছি যে আমরা রাষ্ট্র ছাড়াও চলতে পারি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দেশ মোটামুটি একটা নিয়মের মধ্যেই চলছে। খুব বেশি অনিয়ম হচ্ছে বা বিশৃঙ্খলা এমনটা নয়। দোকান চলছে ঠিকমতো, অফিস চলছে ঠিকমতো, গাড়ি চলছে ঠিকমতো। যদিও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সরকারের উপস্থিতি বা নিয়ন্ত্রণ খুবই সামান্য আছে। রাষ্ট্র এখন অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় অনুপস্থিতির কাছাকাছি। কিন্তু সমাজ ভেঙে পড়েনি, এসব চলছে। এটা এক ধরনের শক্তি। তবে এ শক্তির একটা সংকট হচ্ছে এটা এভাবে বেশি দিন টিকতে পারবে না। 

সরকার যে জন-আকাঙ্ক্ষার জায়গায় সাড়া দিচ্ছে, তাদের মূল্য দিচ্ছে সেটি প্রমাণ করার জন্য এখনই সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে আরো শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা দরকার। দ্বিতীয়ত, নিত্যপণ্যের দাম কমানোসহ অন্য অর্থনৈতিক সমস্যাগ্রস্ত জায়গাগুলো উন্নত করার মাধ্যমে বিগত সরকারের থেকে একটি পরিষ্কার পার্থক্যের জায়গা সৃষ্টি করা। তৃতীয়ত, দুর্নীতি দমনের জন্য তাদের স্পষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আগের সরকারের যেসব অত্যাচার ছিল, যে অবিচারগুলো ছিল, বিশেষ করে এ আন্দোলনে যে খুনগুলো হয়েছে সেই খুনের বিচারের একটি পরিষ্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ জায়গাগুলোয় এখন জরুরি ভিত্তিতে কাজ করে দেখানো লাগবে। একই সঙ্গে মানুষের স্বপ্নকে রাষ্ট্রে ধারণ করার যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে এবং রাষ্ট্র সংস্কারের যে বড় ধরনের আখ্যান তৈরি হয়েছে, সেই সংস্কার কী দিয়ে শুরু হবে, কোথায় শুরু হবে সেটার একটি খসড়া রূপরেখা জলদি প্রণয়ন করতে হবে। সেটার জন্য সময় লাগবে হয়তো কিন্তু প্রাথমিক আলোচনা এখনই শুরু করতে হবে। আলোচনা-পরবর্তী লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ ঘটাতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন