অভিমত

কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প

মো. মহিউদ্দিন রুবেল

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত পোশাক শিল্পের জন্য এক নতুন বাস্তবতা নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলোর কারণে পোশাক শিল্পে সাময়িকভাবে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল রফতানি-আমদানি কার্যক্রম এবং কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমে। ফলে শিল্পকে নগদপ্রবাহ সংকটসহ নানা ধরনের আর্থিক চ্যালেঞ্জের সম্মুক্ষীণ হতে হয়, সর্বোপরি সমগ্র সাপ্লাই চেইন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। বিশেষ করে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের কারণে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছিল। এতে করে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে বৈশ্বিক অংশীদারদের মধ্যে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। 

এ ঘটনাগুলো এমন এক সময়ে ঘটেছিল, যখন কিনা আমাদের কারখানাগুলো আসন্ন শীত মৌসুমের জন্য অর্ডার প্রক্রিয়াকরণে ব্যস্ত সময় পার করছিল। ব্যস্ততম এ সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি, নতুন বাস্তবতা শুধু উৎপাদনকেই মন্থরগতিসম্পন্ন করেনি, বরং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে ভবিষ্যতের অর্ডার সুরক্ষিত করার ব্যাপারে আমাদের সক্ষমতার মর্মমূলেও আঘাত হেনেছে। তার পরও আমরা এ শিল্পের প্রতিটি উদ্যোক্তা একান্তভাবে বিশ্বাস করি, যে চ্যালেঞ্জগুলো আমরা মোকাবেলা করেছি, সেগুলো আসলে শিল্প, তথা জাতীয় জীবনের সর্বত্রই নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য আমাদের বৃহত্তর প্রতিশ্রুতিরই অংশ এবং আমরা সাময়িক অসুবিধা সত্ত্বেও আমাদের ক্রেতাদের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং সেই আস্থা আরো কীভাবে বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছি। এ বিঘ্নগুলো শিল্পে আর্থিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাব রেখেছে, শাটডাউন চলাকালীন প্রতিদিন শিল্পে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ১৬ বিলিয়ন টাকা। যদিও কারখানাগুলো পুনরায় চালু হওয়ার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগের ব্যাকলগগুলো পুষিয়ে নেয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছে, তার পরও লিড টাইম মোকাবেলার জন্য আকাশপথে পণ্য রফতানির খরচ এবং অন্যান্য জরিমানার জন্য কারখানাগুলোর ওপর ব্যয়ের বোঝা আরো বাড়বে। এমনিতেই উৎপাদনের সময়সূচি বিঘ্নিত হওয়ার কারণে অনেক কারখানাকে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত সময় ওভারটাইম দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে, যা কারখানাগুলোর ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ যোগ করেছে।

উল্লেখ্য বর্তমানে কারখানাগুলো বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, বিশেষ করে কনটেইনার, পরিবহন, জাহাজ ভাড়া এবং ব্যাংকিং চার্জ সম্পর্কিত বর্ধিত ব্যয়গুলো বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে। বৈশ্বিক বাজারের চ্যালেঞ্জগুলোর প্রেক্ষাপটে এ অতিরিক্ত ব্যয়গুলো শিল্পের জন্য আরো জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যেখানে চাহিদা অনিশ্চিত থাকে।

আশার বিষয় হলো, শিল্প সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা বিবেচনায় নিয়ে ঝুঁকি কমানোর জন্য এরই মধ্যে সক্রিয়ভাবে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সব পরিস্থিতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং আমাদের ওপর ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চ্যানেলগুলো বাড়াচ্ছি। উপরন্তু লজিস্টিক ও সাপ্লাই চেইন কৌশলগুলোকে বৈচিত্র্যময় ও অপ্টিমাইজ করার জন্যও প্রচেষ্টা নেয়া হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের যেকোনো বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে শিল্পের দুর্ভোগ লাঘব করবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করে এবং অপারেশনাল দক্ষতার উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের উৎপাদন ও রফতানি সব পরিস্থিতিতে অবিঘ্নিত রাখা, যাতে করে যেকোনো অনিশ্চয়তার মুখেও ক্রেতাদের দেয়া আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে পারি।

এ সংকটময় সময়ে শিল্পকে তার অবস্থান পুনরুদ্ধারে সহায়তার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক সহায়তা দেয়া অপরিহার্য। পোশাক শিল্পের সার্বিক কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে ও মসৃণভাবে পরিচালনার জন্য কাস্টমস-সংক্রান্ত পরিষেবাগুলো আরো দ্রুততর এবং সহজতর করা, বিশেষ করে আমদানীকৃত কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি দ্রুত খালাসসহ ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলোর সহজীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায় নগদপ্রবাহের চ্যালেঞ্জগুলো কার্যকরভাবে মোকাবেলার জন্য নমনীয় ব্যাংকিং নীতি প্রণয়ন বর্তমান সময়ের দাবি।

উপরন্তু শিল্পকে সাম্প্রতিক বিপর্যয় থেকে পুনরুদ্ধার করা এবং ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত করার জন্য সক্ষমতা অর্জন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমগুলো সুচারুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে একটি স্থিতিশীল এবং অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য রেগুলেটরি রিফর্মও জরুরি। এ পদক্ষেপগুলো শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগী সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এর অব্যাহত অবদান নিশ্চিত রাখার জন্য চাবিকাঠি হবে।

অসংখ্য চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও শিল্পটি উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি, বর্জ্য কমাতে প্রযুক্তি গ্রহণ এবং উচ্চ মূল্য সংযোজন পণ্যে বিনিয়োগ করে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। তবে যেটাই হোক না কেন, সব পরিস্থিতিতে প্রতিযোগী সক্ষমতা বজায় রাখাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছ থেকে অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যেহেতু এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই যাচ্ছি, তাই এ সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার মূলমন্ত্র হবে একতাবদ্ধ হয়ে অদম্য মনোবল ধরে রাখা এবং সেই সঙ্গে চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে এগিয়ে চলার জন্য অভিযোজনযোগ্যতা অর্জন করা। সঠিক নীতি সহায়তা ও কৌশলগত সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত যে শিল্পটি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং বিশ্ববাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা অব্যাহত রাখবে।

মো. মহিউদ্দিন রুবেল: পরিচালক, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন