আট জেলায় বন্যার ক্ষয়ক্ষতি

বন্যার্তদের পুনর্বাসনে সরকার দৃশ্যমান উদ্যোগ নিক

ছবি : বণিক বার্তা

বন্যার পানি নেমে গেলে যত দ্রুত সম্ভব পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। দেশে গত আগস্টের মাঝামাঝি শুরু হওয়া বন্যায় ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ হারিয়ে বর্তমানে নিঃস্বপ্রায় দুর্গত অঞ্চলের মানুষ। এছাড়া রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ অসংখ্য অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাছচাষী, পোলট্রি উদ্যোক্তা, খামারি, কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১১টি জেলার ৬৮টি উপজেলা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৫৩ লাখ ৬ হাজার মানুষ। 

স্বাভাবিকভাবেই এ পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু এখন থেকেই যদি বন্যার্তদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়া হয়, তাহলে এ বিপর্যয় সামলে ওঠা আরো কঠিন হয়ে পড়বে। আর পুনর্বাসনের দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে এবং তাদের উদ্যোগ হতে হবে দৃশ্যমান। জরুরি ভিত্তিতে এবং ধারাবাহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা প্রয়োজন। 

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ভাষ্যমতে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামো পুনর্বাসনে সরকারের কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। বন্যাকবলিত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছানোর ক্ষেত্রেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল চরম সমন্বয়হীনতা। বিপরীতে বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ দেখা গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান কেবল ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছে। যদিও তাদের পর্যবেক্ষণে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। দুর্গত এলাকার মানুষ নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন সংস্কারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রেও সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার তেমন কোনো নজির নেই।

বন্যা চলাকালীনও দেখা গেছে, ত্রাণসামগ্রী নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা বন্যাকবলিত এলাকায় গেছেন। কিন্তু রাস্তাঘাট ঠিকমতো না চেনার কারণে এবং শহর ও গ্রাম পানির নিচে ডুবে থাকায় কাছের জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও যেতে পারেননি। স্বেচ্ছাসেবী এক দলের সঙ্গে অন্য দলের সমন্বয় না থাকায় ঘুরেফিরে একই জায়গায় ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। দক্ষতা ও সমন্বয়ের অভাবে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছেনি। সে সময়ও সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে সমন্বিত পদক্ষেপের ঘাটতি ছিল। সম্প্রতি ত্রাণ বিতরণ চালু আছে এবং বন্যার পানি নেমে গেলে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন এক উপদেষ্টা। বন্যা উপদ্রুত এলাকার জনজীবন ও অবকাঠামোর দৃশ্যমান উন্নতি দেখে আমরা এ বিষয়ে আশ্বস্ত হতে চাই। 

এখনো অনেক গ্রামের পানি নামেনি এবং পানি নেমে যাওয়া এলাকার ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট হয়েছে। অক্সফামের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা। এ দুই জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। এছাড়া দুই জেলার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা শতভাগ অচল হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে, শুধু ফেনী জেলায় অন্তত ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফেনীর ছয় উপজেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হওয়ায় ১ লাখ ৬৭ হাজার কৃষক পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকার বেশি। এসব এলাকার কৃষিজমিতে তিন-চার ফুট বালি জমে গেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে ফসল উৎপাদনে। চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ও উপজেলাগুলোয় কৃষিতে মোট ৩৯৪ কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তথ্যমতে, বন্যাকবলিত জেলার উপজেলাগুলোর মধ্যে ৬০৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কুমিল্লার এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লার ৯৬৮ কিলোমিটার সড়ক পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দুটি ব্রিজ ও ২৬টি কালভার্ট ভেঙে গেছে।

এদিকে নোয়াখালীর মুছাপুর স্লুইসগেট (রেগুলেটর) ভেঙে যাওয়ায় জোয়ারের সময় সাগরের লবণাক্ত পানি নদীতে ঢুকে যাচ্ছে। এতে কৃষিজমি ও মাছ আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি নদীভাঙন তীব্র হয়ে উঠেছে। এছাড়া রেগুলেটরের ওপর নির্মিত রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় ব্যাহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলাজুড়ে ১৮ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগকবলিত জনসংখ্যা ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এ জেলার কৃষি, পানিসম্পদ খাতসহ মৎস্য খাতে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এতে স্বর্বস্বান্ত হয়েছেন কৃষক, মৎস্যচাষী ও পশু-পোলট্রি খামারিরা। লক্ষ্মীপুরের প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা এখনো পানির নিচে। 

এ পরিস্থিতিতে দুর্গত সব এলাকার মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে উৎপাদন ঠিক রাখা জরুরি। এজন্য কৃষককে পুনর্বাসনে আশু পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কৃষককে বীজ ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণসহ আর্থিক সহায়তা করতে হবে। পাশাপাশি জোর দিতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত ও ভেঙে পড়া সড়ক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে। কেননা যাতায়াতের পথ সুগম না হলে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে। এতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হতে পারে।

বন্যা-পরবর্তী সময়ে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং রোগবালাই প্রতিরোধ করা। এজন্য স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। এ সময় সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন গর্ভবতী নারী ও শিশুরা। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তৎপর থাকতে হবে।

সর্বোপরি প্রত্যেকের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান আবশ্যক। বিশেষ করে যাদের ঘরবাড়ি ও কৃষি, মৎস্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সব এলাকার স্থানীয় প্রশাসন এরই মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করেছে। এসব ক্ষয়ক্ষতি সারিয়ে উঠতে তাদের কী পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন তা অবগত করেছে ঊর্ধ্বতনদের। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যায় ১১ জেলায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো মেরামতে কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন সে হিসাব এখনো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছ থেকে আসেনি। ক্ষয়ক্ষতির হিসাব আসার পর তারা এ বিষয়ে বরাদ্দ দেয়ার উদ্যোগ নেবেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পুনর্বাসন কার্যক্রম ব্যাহত হবে—এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং কালক্ষেপণ না করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে সরকার ব্যবস্থা নিক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন