পাঁচ সদস্যের জাতীয় কমিটি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত জনবান্ধব করতে সুশাসন ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি এবং অপর্যাপ্ততা দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন পাস করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ আইনের আওতায় চাহিদার ঘাটতি নিরসনে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানো হয়। কিন্তু জ্বালানির অভাবে উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র অব্যবহৃত থাকছে। একদিকে জ্বালানি সরবরাহ না করতে পারায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে সরকারকে জরিমানা গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সক্ষমতা বাড়িয়ে ডেকে আনা হয়েছে দেশের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি। আবার এ আইনের মাধ্যমে নষ্ট করা হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক বিদ্যুতের বাজার। ফলে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী লুফে নিয়েছে বিপুল মুনাফা। বাড়তি অর্থ আদায়ে অতিরিক্ত চাপ পড়েছে জনগণের ওপর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। 

দুই বছরের জন্য আইনটি করা হলেও এ আইনের মেয়াদ তিন দফা বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। পাসের পর থেকেই আইনটি নিয়ে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ আইনের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থই প্রাধান্য পায়। ফলে এ খাতে প্রতিযোগিতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অনুপস্থিত ছিল। জনস্বার্থ সবসময়ই উপেক্ষিত ছিল। কেননা আইনটিতে এ খাতের কেনাকাটা ও অবকাঠামো নির্মাণে কোনো অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে আদালতে যাওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। যে কারণে এটিকে এ খাতের দায়মুক্তি আইন হিসেবে অভিহিত করা হয়। যদিও বিগত সরকারের সময়কালে সারা দেশে বিদ্যুৎ প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে সুশাসন ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। 

এ আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্কারে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। ২০১০ সালের ওই আইনের আওতায় করা চুক্তির মাধ্যমে এ খাতের মেগা প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। চলমান রয়েছে আরো কয়েকটি। বর্তমানে এ আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেটি ভালো একটি উদ্যোগ। এর আগে ১৮ আগস্ট প্রায় ১৪ বছর পর এ আইনের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে সরকার। একই সঙ্গে আগামীতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সব মূল্যবৃদ্ধির কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়েছে। 

এ আইনের আওতায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনেকগুলো অন্যায্য চুক্তি সম্পাদন হয়েছে, যার সুবিধা নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারসংশ্লিষ্ট ও ক্ষমতাঘনিষ্ঠ অনেকেই। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ মুনাফা করলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। এ আইনের কারণে সংশ্লিষ্ট কাউকেই এতদিন জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ফলে সরকারের এ উদ্যোগে এসব চুক্তিতে কী ছিল সেটি জনগণ জানতে পারবে।

দেশে ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল ২৭টি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। দেশে এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ১৫২টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২০০৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত শাসনামলে নির্মাণ হয়েছে ১২৫টি। এগুলোর মধ্যে ওই বিশেষ আইনের আওতায় নির্মাণ হয়েছে ৯১টি। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট এবং উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার। জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ফলে চাহিদার ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে লোডশেডিং করে। চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের কারণে সরকারকে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। ফলে এ আইনকে পুঁজি করে বিভিন্ন গোষ্ঠী নানা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। তাই এ খাতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে এ-যাবৎ কালের সব চুক্তি পুনরায় নিরীক্ষা হওয়া দরকার। কুইক রেন্টাল ও ব্যয়বহুল যে কেন্দ্রগুলো আছে সেগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পদ্ধতি বাতিল করা প্রয়োজন। বতর্মানে প্রিপেইড মিটারের কারণে ভুতুড়ে বিল আসায় গ্রাহকের হয়রানি বাড়ছে। ফলে এসব মিটার বাতিল করে গ্রাহক হয়রানির সব ধরনের সুযোগ বন্ধ করা অতীব জরুরি। 

২০২০ ও ২০২৩ সালে কিছু আইন করে বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ৩৪ (ক) বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারি করেছে। এর মধ্য দিয়ে গণশুনানির মাধ্যমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। আশা করি, সংস্থাটি এখন জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নেবে। 

জ্বালানি হলো একটি কৌশলগত আবশ্যিক পণ্য। জ্বালানি তেল ব্যতীত এখনো কোনো উন্নয়নকাজ সমাধানের কথা চিন্তা করা যায় না। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে মুহূর্তেই তার দাম বেড়ে যায়। কিন্তু বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমলে দেশের বাজারে সেভাবে কমে না। এজন্য বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে জ্বালানির দাম নির্ধারণে নতুন কোনো ফর্মুলার প্রয়োজনও নেই, শুধু সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে বিশ্বে প্রধানত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অধিকাংশ দেশ মার্কেট ডিটারমাইন্ড বা বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার কোনো কোনো দেশ সর্বোচ্চ দর বা প্রাইস সিলিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের মতো কিছু দেশ ফিক্সড প্রাইস বা নির্ধারিত দরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে বহুদিন ধরেই ডায়নামিক ডেইলি প্রাইসিং মেথড অবলম্বন করা হচ্ছে। সেখানে প্রতিদিন ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বিবেচনায় দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়। বিশ্বের যেসব জায়গা থেকে তেল আমদানি করা হয়, তার সঙ্গে সরকারি কর ও মুনাফা যোগ করে প্রতিদিন তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয় ভারতে। প্রতিদিন সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেয়, কত দামে ডিজেল-পেট্রল বিক্রি হবে। অনেক কিছু বিকেন্দ্রীকরণ করা হলেও এখানে ভারত সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ আছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ঘণ্টায় তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। যুক্তরাজ্যে প্রতিদিনই জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করে। কিন্তু সেখানে সরকারি কোনো সংস্থা সেটা নির্ধারণ করে না। ক্রুড অয়েলের দাম, সরকারি কর, ভ্যাট ইত্যাদির সঙ্গে নিজেদের মুনাফা মিলিয়ে পাম্প মালিকরাই প্রতিদিন সেটা ঠিক করেন। ফলে একই দিন একেক এলাকায় তেলের দাম একেক রকমও হতে পারে। ভারতেও এলাকাভেদে তেলের দাম ভিন্ন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সব জায়গায় একই দামে তেল বিক্রি হয়। দাম নির্ধারণেও বাংলাদেশে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) এড়িয়ে বিগত সরকার নির্বাহী আদেশে জ্বালানির দাম নির্ধারণ করে। এতে বিপিসি অতিমুনাফা ও চুরি-দুর্নীতি করলেও তা রোধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয় না। এর চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণকে। 

কেননা জ্বালানির দামের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির বিরাট সম্পর্ক আছে। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ভয়াবহ চাপে পড়ে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নেয়া অতীব জরুরি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন