প্রাচীন বাংলায় চিত্রকলার ঐতিহ্য

আহমেদ দীন রুমি

অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার অনুলিপি ছবি: এমএপি

বৌদ্ধ বিশ্বাসের প্রাচীন পুস্তক ‘দিব্যাবদান’। বইটিতে উদ্ধৃত ‘বীতাশোকাবদান’ কাহিনী থেকে জানা যায়, পুণ্ড্রবর্ধনের নির্গ্রন্থীরা একটা চিত্রকর্ম তৈরি করেছিল গৌতম বুদ্ধকে অপমান করে। চিত্রকর্মে বুদ্ধকে রাখা হয়েছিল নির্গ্রন্থীদের পায়ের নিচে। এমন কাজে ক্রুদ্ধ হয়ে সম্রাট অশোক পুণ্ড্রবর্ধনের নির্গ্রন্থী আজীবিকদের সমূলে বিনাশ করেন। প্রায় আড়াই হাজার বছর পর দাঁড়িয়ে ঘটনার সত্যাসত্য নির্ণয় করতে বসা অনর্থক। তবে এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, সময়টিতে বাংলায় চিত্রকর্মের প্রচলন ছিল। বাংলায় চিত্রকলার সমৃদ্ধ সে ইতিহাস প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকেও জানা যায়। 

চতুর্থ শতকের শেষে উপমহাদেশে আসেন চৈনিক বৌদ্ধ ভিক্ষু ফা-হিয়েন। তার লেখা সফরনামায়ও উঠে আসে প্রাচীন বাংলার চিত্রকলার দলিল। ফা-হিয়েন এসেছিলেন মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চিন্তা সংবলিত কিতাবাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সমুদ্রপথে দেশে ফেরার আগে তিনি তাম্রলিপ্তি নগরীতে অবস্থান করেন দুই বছর। সেখানে তিনি ২২টি বৌদ্ধ বিহার দেখেছিলেন। সূত্রগ্রন্থ অনুলিখনের সঙ্গে সঙ্গে মূর্তির রেখাচিত্রও এঁকে নিয়ে গেছেন তিনি। মূর্তিশিল্পের উপস্থিতিই সে সময়কার শিল্পকলার ঔৎকর্ষ প্রমাণ করে। এছাড়া পাণ্ডুরাজার ঢিবি খুঁড়ে পাওয়া গেছে বাংলার প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন। সেখানে হরপ্পা সভ্যতার সমগোত্রীয় পুরাবস্তুগুলোর মধ্যে আবিষ্কার হয়েছে নানা রকমের নকশা আঁকা মৃৎপাত্র। সেখানে খুঁড়ে পাওয়া কালো মাটির পাত্রের গায়ে ধূসর সাদা বর্ণের চমৎকার রেখাচিত্র নজরে পড়ে। উয়ারী-বটেশ্বর থেকে প্রাপ্ত পুঁথি ও মূর্তি এখানকার উন্নত শিল্পকলার গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ভূমিকা পালন করে। মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রত্যক্ষ নিদর্শন না হলেও বাংলার আলপনা সংস্কৃতি এখানকার প্রাচীন কৃষি সভ্যতারই সূত্র বহন করে। অর্থাৎ প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকেই বাঙালি শিল্পীর প্রশংসনীয় দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। 

প্রাচীন বাংলার চিত্রকলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উল্লম্ফন সম্ভবত পাল আমলে। পাল রাজারা ছিলেন মহাযানপন্থী। সে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের ওপর ভর করেই ক্রমে তন্ত্রযান, বজ্রযান ও কালচক্রযান বৌদ্ধ মতবাদ বিস্তৃত হয় বাংলার চারপাশে। তন্ত্র সাধনার প্রয়োজনে বাড়তে থাকে বৌদ্ধ দেব-দেবীর প্রতিমার সংখ্যা। নানা বর্ণ ও বৈচিত্র্য বিম্বিত হতে থাকে তাদের চিত্রকলা ও নির্মাণে। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এসব তন্ত্রযান, বজ্রযান ও কালচক্রযান মতবাদের দেব-দেবীর প্রতিমাই আধিপত্য বিস্তার করে ছিল। পাল আমলের মধ্যে আবার সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটে সম্ভবত ধর্মপাল ও দেবপালের আমলে। তিব্বতীয় ঐতিহাসিক লামা তারানাথের বই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তারানাথ ১৬০৮ সালে ‘ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস’ নামে একটি বই লেখেন। সেখানে তিনি ধর্মপাল ও দেবপালদেবের সময় ধীমান ও তার পুত্র বিটপাল নামে দুই বাঙালি শিল্পীর প্রশংসা করেছেন। তারা দুজনই ভাস্কর্য, ধাতুমূর্তি গড়ন ও চিত্রকর্মে ছিলেন নিপুণ ও পারদর্শী। ধীমানের প্রচলিত চিত্রকলার ধারাই পরবর্তী সময়ে পূর্বদেশীয় ধারা নামে খ্যাত হয়। অবশ্য পিতা ও পুত্রের রীতি ভিন্ন হয়ে পড়ে। চিত্রকলায় পিতার রীতি পূর্বদেশীয় আর পুত্রের রীতি হয় মধ্যদেশীয়। এখানে মধ্যদেশ হলো মগধ বা দক্ষিণ বিহার। দক্ষিণ বিহারেই বিটপালের চিত্ররীতি ব্যাপ্তিলাভ করেছিল বলে তারানাথের দাবি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মধ্যযুগের নেপালি ভাস্কর্য ও চিত্রকলা গড়ে উঠেছিল পূর্বদেশীয় রীতিরই অনুসরণে।’

পালযুগের বিপুলসংখ্যক ধাতুমূর্তি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে নেপালের ভাস্কর্য ও চিত্রকলা এ রীতির আদর্শে সমৃদ্ধ হয়। তখন চিত্রকলার অনুশীলন কত ব্যাপক ছিল তা অনুমান করা যায় বিপুলসংখ্যক পুঁথিচিত্র থেকে। পালচিত্রকলা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায় সরসীকুমার সরস্বতী রচিত ‘পালযুগের চিত্রকলা’ গ্রন্থে। সরসীকুমার সে সময়ের চিত্রকলার নিদর্শনগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা ক. তারিখসহ চিত্র-সংযুক্ত পূর্বভারতীয় পুঁথি খ. তারিখবিহীন চিত্রযুক্ত পূর্বভারতীয় পুঁথি ও গ. তারিখসহ চিত্র সংযুক্ত নেপালি পুঁথি। এছাড়া তিনি তারিখবিহীন অথচ চিত্র সংযুক্ত কিছু নেপালি পুঁথির কথাও আলোচনা করেছেন। পালযুগের চিত্রকলার বিচারে নেপালি চিত্রকলা অন্তর্ভুক্ত করার কারণে নেপালি চিত্রে সে সময় পালযুগের পূর্বভারতীয় রীতিরই সম্প্রসারিত রূপ দেখতে পাওয়া যায়। যা-ই হোক, পাল আমলের পুঁথিগুলো লেখা ও আঁকা হয়েছে তালপাতায়। কেবল আশুতোষ সংগ্রহশালার ১১০৫ খ্রিস্টাব্দে নেপালে প্রস্তুত ‘পঞ্চরক্ষা’ পুঁথিটি লেখা ও আঁকা হয় কাগজে। তালপাতা সাধারণত ভঙ্গুর। তাই বহু পুঁথিই জলবায়ুর প্রকোপে জীর্ণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ সে আমলে তালপাতাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী করার ব্যবস্থা নেয়া হতো। 

বাংলা অঞ্চলে দুই শ্রেণীর তালপাতা পাওয়া যায় ‘খড়তাড়’ ও ‘শ্রীতাড়’। শ্রীতাড়ই পুঁথির পক্ষে উপযুক্ত। পাতার দৈর্ঘ্য ৯০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। তবে প্রস্থে প্রায় সবসময়ই ৩৫ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার। এ পাতা প্রথমে সংগ্রহ করে গোছা বেঁধে পানিতে মাসখানেক ডুবিয়ে রাখা হতো। তারপর শুকনো করে প্রতিটি পাতা মসৃণ করে নেয়া হতো। এরপর পাতাগুলো সাজিয়ে সমান করে কেটে পুঁথি বাঁধার ছিদ্র করে লেখার উপযোগী বানানো হতো। লিপিকর পুঁথি লিখতেন দৈর্ঘ্যের সমান্তরালে। প্রতি পাতায় পাঁচ থেকে সাতটি পঙক্তি। যেসব পুথি চিত্রিত হতো সেগুলোয় লিপিকর শূন্যস্থান ছেড়ে যেতেন। পুঁথি লেখার পর চিত্রকর সে শূন্যস্থান চিত্র দিয়ে পূর্ণ করতেন। 

চিত্র রচনার প্রক্রিয়া সাধারণত জটিল। সরাসরি পাতার ওপরেই তুলির আঁচড়ে প্রাথমিক রেখাকর্ম করে নেয়া হতো। এরপর বিষয় অনুযায়ী নানা বর্ণে চিত্রফলকটি রঞ্জিত হতো। রূপের গড়নের প্রয়োজনে রঙের গাঢ়তার তারতম্যে আর উজ্জ্বল বর্ণের ছোঁয়ায় সম্পূর্ণ করা হতো রঙের কাজ। ছবিতে ব্যবহৃত রঙের মধ্যে দেখা যায় হরিতালের হলুদ, খড়িমাটির সাদা, উদ্ভিদজাত গাঢ় নীল, প্রদীপের শিষের কালি, সিঁদুর লাল আর নীল ও হলুদের মিশ্রণে তৈরি সবুজ। সব রঙে সাদা মিশিয়ে ইচ্ছামতো হালকা করে নিতেও দেখা যায়। তবে সাধনসূত্রের ধ্যান অনুসারে, দেব-দেবীর বর্ণ নির্দিষ্ট হওয়ায় শিল্পীর নিজস্ব রুচির স্থান ছিল সামান্যই। দেব-দেবীর ধ্যান অনুসরণে ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে গৌর বা হলুদ রঙ, নীল ও সবুজ বর্ণ। 

পালযুগের চিত্রিত পুঁথিগুলোর অধিকাংশই হলো প্রামাণ্য মহাযানগ্রন্থ ‘অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা’র অনুলিপি। এছাড়া আছে পরবর্তীকালের বজ্রযান মতের ‘পঞ্চরক্ষা’, ‘কাবণ্ডব্যূহ’, ‘কালচক্রযান’ প্রমুখ গ্রন্থের অনুলিপি, কিন্তু যা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য তা হলো পুঁথির গ্রন্থ ও চিত্রের মধ্যে কোনো সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ চিত্রগুলো গ্রন্থের বিষয়াবলির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং স্বমহিমায় স্বতন্ত্রভাবে বিরাজমান। পুঁথিচিত্রের বিষয় হলো গৌতম বুদ্ধের জীবনেব প্রধান আটটি ঘটনা। লুম্বিনী বনে জন্ম, বুদ্ধগয়ায় বোধিলাভ, সারনাথে ধর্মচক্র প্রবর্তন, কুশীনগরে মহাপরিনির্বাণ, শ্রাবস্তী নগরে অলৌকিক ক্রিয়া প্রদর্শন, সংকাশে স্বর্গাবতরণ, রাজগৃহে নালগিরি বশীকরণ ও বৈশালীর আম্রবনে বানরের মধুদান। পাশাপাশি রয়েছে মহাযান-বজ্রযানসম্মত দেবদেবীর প্রতিকৃতি। দেবদেবীর মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছেন প্রজ্ঞাপারমিতা, তারা, লোকনাথ, মৈত্রেয়, মহাকাল, বজ্রপাণি, বসুধারা, কুককুল্লা, চুন্দা, বজ্রসত্ত্ব, মঞ্জুঘোষ প্রমুখ। 

সাধারণত পুঁথিগুলোর নির্বাহক ছিলেন মহাযানপন্থী বৌদ্ধ স্থবির-উপাসক-ভিক্ষু। এমনকি মহাযানাশ্রয়ী সামন্তনৃপতি ও রাজকর্মচারীরও নাম পাওয়া যায় পুঁথির সংঘটক হিসেবে। পুঁথিগুলো তারা করিয়েছিলেন পুণ্য কামনায়, কেবল নিজের নয়, আপন গুরু-উপাধ্যায়, মাতা-পিতা এমনকি সব প্রাণিসত্তার পুণ্যের জন্য। তবে এ সাধারণ উদ্দেশ্যের চেয়ে কিছু গভীরতম প্রেরণার উৎস অবশ্যই দেখতে পাওয়া যায় ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ গ্রন্থের ভেতর। সম্যক বা অনুত্তর জ্ঞানের স্বরূপ আর মানবকল্যাণে তার যথাযথ প্রয়োগ কীর্তিত হয়েছে গ্রন্থটিতে। সে কারণে তাত্ত্বিকতার চেয়ে বেশি পেয়েছে ধর্মীয় গুরুত্ব। যেকোনো ধর্মানুষ্ঠানে এ গ্রন্থের পাঠ ও আবৃত্তি পুণ্যার্জনের অপরিহার্য অঙ্গ রূপে বর্ণিত হয়েছে। গ্রন্থের অনেক স্থানে অনুলিপি প্রস্তুতি একটি বিশেষ পুণ্যকর্ম বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। ধূপ, দীপ, পুষ্প, মাল্য প্রভৃতির সঙ্গে গ্রন্থটির অনুলিপি অর্চনার নির্দেশও দেয়া হয়েছে বারবার। “মতাদর্শের সঙ্গে যখন কালক্রমে যুক্ত হলো তান্ত্রিক ধর্মবিশ্বাস, তখন এ ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ গ্রন্থের প্রয়োজন হলো নানা তান্ত্রিক দেব-দেবীর প্রতিকৃতির সংযুক্তিকরণ। ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’র প্রতিপাদ্য হলো শূন্যতাবোধ ও সে বোধে পৌঁছবার উপায়। তন্ত্রমতে, এ শূন্যতাবোধ লাভ করলে বীজমন্ত্রের মধ্যে অসংখ্য দেব-দেবীর রূপদর্শন সম্ভব। সাধকের ধ্যানে এসব দেবদেবী আপন আপন গুণ নিয়ে আবির্ভূত হন। সাধক দেবদেবীর দৃশ্যমান রূপ ধ্যান করে আপন সাধনপথে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন। সাধকের ধ্যানের দেবদেবী ক্রমে তন্ত্রযান-বজ্রযান-কালচক্রযানীদের যত্নে আসন পায় পুঁথির পাতায়। সেগুলোর পাঠ, আবৃত্তি ও পূজার্চনা ছিল সিদ্ধির উপায়। এভাবে বৌদ্ধ ধর্ম ও দার্শনিক প্রেরণায় তৈরি হয়েছে প্রাচীন বাংলার চিত্রকলার গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়। 


গ্রন্থপঞ্জি 

১. বাংলার চিত্রকলা, অশোক ভট্টাচার্য, ১৯৯৪

২. পালযুগের চিত্রকলা, সরসীকুমার সরস্বতী, ১৯৭৮

৩. বাংলাপিডিয়া


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন