আহতদের সহযোগিতা করতে গিয়ে প্রাণ হারান মুগ্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ছবি: সংগৃহীত

১৮ জুলাই। উত্তরায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে পুলিশের। সে সংঘর্ষে আহত হয় অনেকে। সেদিন আহতদের যারা হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন, তাদেরই একজন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) এমবিএর শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। সঙ্গে ছিল বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ একটি গুলি এসে লাগে মুগ্ধর কপালে। তাৎক্ষণিকভাবে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

বন্ধুরা জানান, কারো বিপদ দেখলেই সহযোগিতার জন্য ছুটে যেতেন মুগ্ধ। ব্যতিক্রম হয়নি কোটা সংস্কার আন্দোলনেও। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সংবাদ পেয়ে ১৮ জুলাই দুপুরে বন্ধু আশিককে সঙ্গে নিয়ে ছুটেছিলেন তাদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে। আহতদের হাসপাতালে নেয়া এবং আন্দোলনরতদের পানি ও খাবার বিতরণ করছিলেন। 

সেদিনকার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বর্ণনা করেছেন মুগ্ধর বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা ইষ্টি কুটুমের মুখোমুখি হয়ে রোড ডিভাইডারের ওপর বসলাম একটু বিশ্রামের জন্য! প্রথমে জাকির এরপর মুগ্ধ আর সবশেষে আমি! হঠাৎ সবাই আমির কমপ্লেক্স আর রাজউক কমার্শিয়ালের ওইদিক থেকে দৌড়ে আসছে! আমরা দেখলাম! কিছুটা ধীরগতিতেই উঠব ভাবলাম! ২-৩ সেকেন্ড পর মুগ্ধর পায়ের ওপরে হাত রেখে বললাম “চল দৌড় দেই!” আমার বন্ধু শেষবারের মতো আমাকে বলল, চল!” জাকির উঠে দৌড় দিল আগে, তারপর আমিও উঠে দৌড় দিলাম ৩-৪ কদম যাওয়ার পর আমার সামনেই জাকিরকে দেখছি দৌড়াচ্ছে। কিন্তু আমার পাশে মুগ্ধ নেই! থেমে গেলাম, পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখি আমার বন্ধু ওই বসা অবস্থা থেকেই মাটিতে পড়ছে, চোখ দুটো বড় করে আমার দিকে তাকায় আছে, হাতে সেই অবশিষ্ট বিস্কুট আর পানির বোতলের পলিথিন, কপালে গুলির স্পষ্ট চিহ্ন। আমি চিৎকার করলাম, “‍জাকির মুগ্ধ গুলি খাইসে”।’ 

আশিক আরো উল্লেখ করেন, ‘সামনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম অসংখ্য পুলিশ অস্ত্র হাতে এদিকে আসছে! আমি দৌড়ে মুগ্ধর কাছে গিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম, পারছিলাম না। পাশেই একজন সাহস করে আসল! দুজন মিলে কোলে তুললাম মুগ্ধকে! একটু আগেই মুগ্ধ আমার সঙ্গে মানুষকে হাসপাতালে নিচ্ছিল। এখন আমি নিজেই ওকে কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছি! ইমারজেন্সিতে নিয়ে বেডে রেখে এক কোনায় মাটিতে বসে পড়লাম ওই রুমেই! কিছুক্ষণ পর ঝাপসা চোখে দেখলাম মুগ্ধর আইডি কার্ড হাতে ডাক্তার আমাকে বলছে “আপনার কী হয়?” বললাম আমার ভাই। আমাকে বলল পালস খুঁজে পাচ্ছি না, আপনি একটু রিল্যাক্স হয়ে বাসায় ফোন দেন! আমি স্নিগ্ধকে কল করলাম সঙ্গে সঙ্গে!’

মুগ্ধর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। তিনি লিখেছেন, ‘আমার ভাই রাজনীতির বিপক্ষে তবে সে মানুষের অধিকারের পক্ষে ছিল। এমনকি যখন সে গুলিবিদ্ধ হয় তখনো তার হাতে ছিল ওয়াটারকেস। গুলিটি তার কপালে ছোট গর্ত তৈরি করে ডান কানের নিচে বড় গর্ত করে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে আসলেই একটি রত্ন ছিল।’ 

তিনি আরো লেখেন, আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে মুগ্ধই মায়ের সবচেয়ে বেশি যত্ন নিত। যখন যা প্রয়োজন হতো সবকিছু করত। সে প্রায়ই বলত, জীবনটা বড় হওয়া দরকার, লম্বা নয়। হ্যাঁ সে সত্যিই এটা সঠিক প্রমাণ করেছে।

মুগ্ধ বিইউপিতে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (এমবিএ) অর্জনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন চলতি বছরের মার্চে। এর আগে গত বছরই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, গান এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমেও ছিল তার সরব উপস্থিতি। কারো বিপদ দেখলেই সহযোগিতার জন্য ছুটে যেতেন বলে জানিয়েছেন তার বন্ধুরা। 

খুলনায় মুগ্ধর রুমমেট ছিলেন রবিউল আলম ভুঁইয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মুগ্ধ ছিল বন্ধুত্বপরায়ণ। খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশতে পারত। এমন কেউ নেই যে মুগ্ধর কাছে সহযোগিতা চেয়ে পায়নি। সারাদিন ক্লাস, আড্ডা আর সোশ্যাল ওয়ার্ক এসবেই মুগ্ধর সময় চলে যেত। যে একবার তার সঙ্গে মিশত তার পক্ষে মুগ্ধকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। পড়ালেখার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করত। তার কখনো সরকারি চাকরির লক্ষ্য ছিল না, কখনো চাকরির আবেদনও করেনি। সে শুধু গিয়েছিল শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিতে পাশে থাকতে। অথচ ফিরল শুধু তার মরদেহ। মুগ্ধর মতো বন্ধু হারানোর এ দুঃখ, এ শোক কোনো শব্দে প্রকাশযোগ্য নয়। আমরা এ হত্যার ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি।’

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর জন্ম ১৯৯৮ সালের ৯ অক্টোবর। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেছেন উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ২০২৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর গত মার্চে ভর্তি হন বিইউপিতে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ ছিলেন যমজ। বড় ভাই সরকারি চাকরিজীবী। নিজের খরচ চালাতেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে। কখনো কখনো পরিবারকেও সহযোগিতা করতেন। স্কাউটিংয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এজন্য ‘ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছিলেন তিনি। 

ফেসবুক আইডিতে নিজের সম্পর্কে উপলব্ধি লিখে রেখেছিলেন—‘নোয়িং হোয়েন টু লিভ ইজ ইম্পর্ট্যান্ট’ (কখন চলে যেতে হবে তা জানতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ)। 

মুগ্ধর বন্ধু মেধা বলেন, ‘মুগ্ধ আমাদের জন্য ছিল একটা সাহসের নাম। বিশেষ করে খুলনা থেকে ঢাকা যাওয়ার পর আমার কাছে মুগ্ধ ছিল একটা ভরসার নাম। আমি জানতাম যেকোনো প্রয়োজনে শুধু একবার ডাকলেই তাকে পাশে পাব। অথচ আমাদের সেই সাহসকে এভাবে হারাতে হলো। এ ক্ষতি অপূরণীয়। আমরা মুগ্ধর মৃত্যুকে কোনো মুখরোচক গল্পে পরিণত করতে চাই না। তবে আমরা চাই তার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, যেভাবে তার মৃত্যু হয়েছে সেটি উঠে আসুক। এভাবে দেশের একজন মেধাবী সন্তানের মৃত্যুর বিচার হোক।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন