রাজধানীর বড় বড় বিপণিবিতান

বিক্রি কমেছে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারীর বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীরা

ফারিন জাহান সিগমা

কারফিউ শিথিল থাকার সময় রাজধানীর বিপণিবিতানগুলো খোলা থাকলেও ক্রেতার আনাগোনা নেই বললেই চলে। গতকালের চিত্র ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

রাজধানীর নিউমার্কেট। বিকাল ৪টা নাগাদ দোকান বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রহমান বেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আজিম। স্বাভাবিক সময় দিনে তার দোকানে বিক্রি হয় গড়ে ৪০-৫০ হাজার টাকা। কখনো কখনো তা ৬০-৭০ হাজার টাকায়ও পৌঁছায়। সেখানে গতকাল সারা দিনে তার দোকানে ক্রেতা এসেছে তিন-চারজন। মোট বিক্রি হয়েছে ৩-৪ হাজার টাকার মতো। গত কয়দিনে তার দোকানের বিক্রি কমেছে ৯০ শতাংশের বেশি। 

তিনি জানালেন, নিউমার্কেটে এমন অনেক দোকান আছে যেখানে সকাল থেকে একজনও ক্রেতা মেলেনি। গোটা বিপণিবিতানেই ব্যবসায়ীরা এখন অত্যন্ত অনিশ্চিত সময় পার করছেন। বেচাকেনা প্রায় নেই বললেই চলে। অনেকেই এখন বিদ্যুৎসহ ইউটিলিটি বিল, কর্মচারীদের বিলসহ দোকানের খরচ তোলা নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। 

রাজধানীর বেশির ভাগ বিপণিবিতানেই এখন কম-বেশি এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। সংঘর্ষের পর কারফিউর মধ্যে ক্রেতা পাচ্ছে না দোকানগুলো। অধিকাংশ দোকান মালিকের দাবি, গত কয়দিনে তাদের বেচাবিক্রি কমেছে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসার খরচ তুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। 

টানা পাঁচদিন বন্ধ থাকার পর গত বুধবার প্রথম কয়েক ঘণ্টার জন্য খোলে রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান ও দোকানপাট। ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত শুধু কারফিউ শিথিল থাকাকালে দোকান খোলা রাখতে পারছেন শপিং মলগুলোর ব্যবসায়ীরা। বাকি সময় ব্যবসা বন্ধ রাখতে হচ্ছে তাদের। যদিও এ সময়ের মধ্যে কোনো ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন না তারা। তিনদিন পার হলেও এখনো বিপণিবিতানগুলোয় ক্রেতার উপস্থিতি খুবই কম। 

বসুন্ধরা শপিং মলে পোশাকের দোকান ‘টম অ্যান্ড জেরি’। দোকানের কর্মচারীরা জানালেন, এ দোকানের পেছনে প্রতিদিন ব্যয় হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। কিন্তু গত তিনদিনেও দোকানে ১০ হাজার টাকার বিক্রি হয়নি। গতকাল সারা দিনে একজন ক্রেতারও দেখা মেলেনি। বেচাকেনা নেই বললেই চলে।

ফার্মগেটে ফার্মভিউ শপিং মলের এক কাপড়ের দোকানের স্বত্বাধিকারী হাজেরা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘করোনার সময়ে আমাদের প্রায় ১৫ লাখ টাকার মতো লোকসান হয়েছিল। সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের দুই বছর সময় লেগেছে। বিগত ১৫ দিন ধরে আমাদের তেমন কোনো বেচাকেনা নেই। আমার দোকানে দুজন কর্মচারী আছে। তাদেরও বেতন দিতে হয়। এবার আমাদের ক্ষতির পরিমাণ লাখের ওপরে যাবে। করোনার পর আমরা এবারই বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে যাচ্ছি। তিনদিন ধরে কারফিউ শিথিল করলেও ক্রেতা নেই। মানুষজন এখনো আতঙ্কের মধ্যে আছে।’

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস ব্যাহত হওয়ার কারণেও অনেক ব্যবসায়ীকে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে ক্রোকারিজ বা আমদানিনির্ভর পণ্যের দোকানগুলোয় এ ধরনের ক্ষতির মাত্রা বেশি। নিউ সুপার মার্কেটের মদিনা ট্রেডিংয়ের এক কর্মচারী বলেন, ‘আমরা দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করি। আমাদের কয়েক ট্রাক পণ্য বন্দরে পড়ে আছে। দোকানে যা আছে তাই বিক্রি করতে পারছি না। ’

ব্যবসায়ীরা জানালেন, তাদের ক্ষতির মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি। লেনদেন নিয়েও সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। বিভিন্ন বিপণিবিতানের দোকান মালিকরা জানিয়েছেন, এখন তাদের অনেকেই কর্মচারীদের বেতনই ঠিকঠাকভাবে পরিশোধ করতে পারছেন না। কেউ কেউ কর্মচারীদের আংশিক বেতন দিচ্ছেন।  

ফার্মভিউ শপিং মলের এক দোকান মালিক বলেন, ‘যে টাকা সারা দিনে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে বিদ্যুৎ বিলই উঠবে না। কর্মচারীদের বেতন দেব কীভাবে। তাও যতটুকু পারি দিচ্ছি। তারা তো আর না খেয়ে থাকতে পারবে না।’

ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের দোকানপাট আরো বেশি সময় খোলা রাখার পাশাপাশি ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যথায় তারা দোকান চালানোর খরচটুকুও তুলে আনতে পারবেন না। 

ঠিকঠাক বেতন পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় পার করছেন বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীরাও। নিউ মার্কেটের জনতা ফ্যাশনে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন হোসেন শাহাদাত। দেশব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকদিন বন্ধ ছিল তাদের দোকান। এখন কারফিউ শিথিল হলে স্বল্প পরিসরে খোলা রাখা হচ্ছে দোকানটি। তবে বেচাকেনা কমে যাওয়ায় এ মাসের সম্পূর্ণ বেতন পাননি তিনি। 

শাহাদাত বলেন, ‘নিউমার্কেটে আমাদের স্বত্বাধিকারীর আরো তিনটি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে কর্মচারীর সংখ্যা ১০-১২। বর্তমানে আমরা আছি দুজন। বাকিরা যে যার বাড়িতে চলে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় কেউ আসার সাহসও পাচ্ছে না। আমরা যারা দোকানের কাছাকাছি জায়গায় থাকি, তারা চলে এসেছি। পেটের দায়ে কাজ করতে আসি। সংসারে আমি একমাত্র উপার্জনকারী। পাঁচদিন দোকানপাট সব বন্ধ ছিল। এর আগেও তেমন বেচাকেনা হয়নি। বাধ্য হয়েই কাজে আসতে হচ্ছে।’ 

বিপণিবিতানের আরো কয়েকটি দোকান মালিক ও কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় ক্রেতাদের বিপণিবিতানগুলোয় উপস্থিতি কম। এখনো মানুষের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছে। তারা ধারণা করছেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসতে আরো কয়েকদিন সময় লাগবে। কিন্তু যতদিনে এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, ততদিনে লোকসানের পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। 

ক্রেতারা বলছেন, এখনো জনমনে বেশ আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত কয়েকদিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অনেকেই নেহাত প্রয়োজন না হলে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। 

রাজধানীর গ্রিন রোডে কথা হয় এমনই এক ক্রেতার সঙ্গে। একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক ওই ক্রেতা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ কয়দিন পুরোপুরি বাসায় অবস্থান করেছি। সাতদিন পর আজ বের হলাম কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করতে। এখনো ভেতরে আতঙ্ক কাজ করছে। খুব দরকার ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরাও তেমন বের হচ্ছে না। তাদের বেরও হতে দিচ্ছি না।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন