ভোজ্যতেল আমদানিতে ট্যাংকার সংকট

সুজিত সাহা I চট্টগ্রাম ব্যুরো

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের ভোজ্যতেলের বাজার ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। বর্তমানে এ বাজারে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে পণ্য আমদানিতে পরিবহন সংকট। ট্যাংকার সংকটে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রয়োজনমাফিক ভোজ্যতেল আনতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। বেড়েছে পরিবহন খরচও। আমদানিকারকদের দাবি, ট্যাংকার সংকটের কারণে পণ্য পরিবহনে তাদের ব্যয় বেড়েছে টনপ্রতি ১০-১৫ ডলার। পণ্য আমদানিতে এ পরিবহন সংকট বজায় থাকলে ভোজ্যতেলের মূল্য আবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে করছেন ব্যবসায়ীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রিজার্ভ সংকট ও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাত অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ব্যবসায়ী সময়মতো আমদানি পণ্যের অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি। ফলে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজগুলোকে নির্ধারিতের অতিরিক্ত সময় বন্দরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। আবার বাংলাদেশে ভোজ্যতেল নিয়ে আসা ছোট ট্যাংকারগুলোকে এমনিতেই খালি অবস্থায় ফিরতে হয়। এর সঙ্গে অনিশ্চয়তা যুক্ত হওয়ায় এখানে ভোজ্যতেল পরিবহনে শিপিং কোম্পানিগুলোর আগ্রহে ভাটা পড়েছে। 

এর মধ্যেই আবার সাম্প্রতিক মাসগুলোয় চীন ভোজ্যতেল আমদানি ব্যাপক মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতেও আসন্ন দিওয়ালির কারণে ভোজ্যতেলের চাহিদা ও আমদানি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তুলনায় ওই দুই দেশে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে পণ্য পরিবহন তুলনামূলক বেশি লাভজনক হিসেবে দেখছে শিপিং কোম্পানিগুলো। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ভোজ্যতেল রফতানিকারী ও পণ্য নিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন একধরনের আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। তবে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠার পথে থাকায় শিগগিরই এ সংকট কেটে যাবে বলে প্রত্যাশা দেশের শিপিং ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেখানে ভাড়া বেশি সেখানেই জাহাজ মালিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভিস দেয়ার আগ্রহও বেশি। চীন ও ভারতের মতো দেশগুলোয় চাহিদা ও ভাড়া দুটোই বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশের মতো স্বল্প চাহিদার রুটগুলোয় ভোজ্যতেল আমদানির জন্য জাহাজ সংগ্রহ এমনিতেই কিছুটা কষ্টসাধ্য। তাছাড়া দেশের গত কয়েক মাসের পরিস্থিতির কারণে জাহাজ আসার পর নির্ধারিত সময়ে পণ্য খালাস হবে কিনা এ বিষয়ে অনিশ্চয়তার কারণে জাহাজের সংকট বাড়ছিল। উপরন্তু বাংলাদেশ থেকে ফিরতি পথে ছোট অয়েল ট্যাংকারগুলো খালি অবস্থায় ফেরত যায়। এ কারণে বিগত এক-দেড় মাস ধরে বাংলাদেশে ভোজ্যতেল পরিবহনের জাহাজের কিছুটা সংকট রয়েছে। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় সহসা সংকট কেটে যেতে পারে বলে আশা করছি।’ 

সময় ও পরিবহন খরচের বিচারে বাংলাদেশে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ভোজ্যতেল আমদানি সহজ ও লাভজনক। ব্যবসায়ীদের দাবি, বর্তমানে আমদানি অব্যাহত রাখতে তাদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলের এলসি পেমেন্টের জটিলতা দ্রুত নিরসন করা গেলে সাময়িক এ সংকট দূর হবে বলে আশা করছেন তারা।

জানতে চাইলে দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে ভোজ্যতেলের সিংহভাগই আসে মালয়েশিয়া থেকে। ভোজ্যতেল পরিবহনের ছোট আকারের ট্যাংকারগুলো অন্য গন্তব্যে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত থাকায় আমাদের ফ্রেইট চার্জও এখন টনপ্রতি ১০-১৫ ডলার বেড়েছে।’

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ১৬০ থেকে ৫ হাজার ১৭০ টাকায়, সুপার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ২৮০ থেকে ৫ হাজার ২৯০ টাকায়, সয়াবিন লেনদেন হচ্ছে ৫ হাজার ৬৮০ থেকে ৫ হাজার ৬৯০ টাকায়। গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি মণ পাম অয়েল লেনদেন হয়েছিল ৪ হাজার ৮০ থেকে ৪ হাজার ৯০০ টাকার মধ্যে। এ সময়ের ব্যবধানে পাম অয়েলের পাইকারি দাম বেড়েছে প্রায় ২৫০ টাকা। জুনে বিশ্ববাজারে টনপ্রতি অপরিশোধিত পাম অয়েল ৮৭৪ ডলারে লেনদেন হলেও জুলাইয়ে দাম ছিল ৮৯৬ ডলার। আগস্টে পাম অয়েলের বুকিং বেড়ে ৯৩৩ ডলারে উন্নীত হয়। যদিও সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাম অয়েলের টনপ্রতি বুকিং দর আরো বেড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০ ডলার হয়ে গেছে। বিশ্ববাজারে বুকিং দর বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাইকারিতে পণ্যটির দাম আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, বেশকিছু ব্যাংকের লেনদেন নিয়ে জটিলতা, প্রশাসক নিয়োগ ও ডলার সংকটের কারণে আগের আমদানি করা ভোজ্যতেলের পেমেন্ট নিয়ে রফতানিকারকদের মধ্যে কিছুটা সংশয় রয়েছে। দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সরবরাহকারীরাও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাছাড়া বুকিং দর বাড়তি থাকার পাশাপাশি এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বাড়তি চাহিদার কারণে বাংলাদেশমুখী অয়েল ট্যাংকারের সাময়িক সংকট রয়েছে। স্বল্প দূরত্বের কারণে পাম অয়েল পরিবহনে  ছোট আকারের (৭ থেকে ১৫ হাজার টন ধারণক্ষমতা) ট্যাংকারের চাহিদা বেশি থাকায় বাড়তি চার্জ দিয়ে আমদানি করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মিল মালিক ব্যবসায়ীরা।

যোগাযোগ করা হলে দেশের অন্যতম ভোজ্যতেল আমদানি, পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক (পরিচালনা ও বিপণন) তারিক আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে এখন পাম অয়েলের চাহিদা বেশি। ইন্দোনেশিয়া কয়েক বছর ধরে পাম অয়েলকে ডিজেল উৎপাদনে ব্লেন্ডিং করছিল। এ বছর ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল ডিজেলে রূপান্তর ৩৫ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশে উন্নীত করেছে।’ পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধি ও বেশ কয়েকটি দেশের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ পাম অয়েল আমদানিতে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

দেশে ভোজ্যতেল আমদানির শীর্ষ কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপ। একসময় এমইবি গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, রুবাইয়া গ্রুপ, নূরজাহান গ্রুপসহ একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেল বাণিজ্যে যুক্ত থাকলেও বড় ধরনের লোকসান ও ঋণখেলাপি হয়ে ভোজ্যতেলের মার্কেট থেকে ছিটকে গেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বোতলজাত পর্যায়ে দেশে ২০-২৫ শতাংশ ও খোলা পর্যায়ে ৫ শতাংশ সয়াবিনের চাহিদা থাকলেও বাদ বাকি ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার হয় পাম অয়েল। আমদানি হওয়া পাম অয়েলের শতভাগই আসে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন