আধুনিক ছবি আঁকতে গেলে শিল্পীকে পথ বের করতে হয়

ছবি : বণিক বার্তা

গ্রামবাংলার অনবদ্য জীবনকথা, সংস্কৃতি কৃষ্টি নিয়ে কাজ করেছেন, নিজের চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে দেশকে বিশ্বদরবারে ফুটিয়ে তুলেছেন যে কয়েকজন শিল্পী তাদের মধ্যে অন্যতম আব্দুস শাকুর শাহ নিজের কাজ জীবনগল্প নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারিহা আজমিন

বাংলার লোক ঐতিহ্য, ফোক মোটিভকে আধুনিক চিন্তায় যারা হাজির করেছেন আপনি তাদের অন্যতম। আপনার শিল্পযাত্রা, গবেষণা কীভাবে শুরু হলো, জানতে চাই। 

আমার শিল্পযাত্রা শুরু হয়েছে অনেকগুলো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। একটা সময়ে আমি ছবি আঁকতাম তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর যে সমস্যা সেসব নিয়ে। তারপর যখন থেকে আমি আধুনিক ছবি আঁকা শুরু করি, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে এঁকেছি। এরপর আঁকলাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু একটা সময় আমি দেখলাম আমার নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না। মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো দেখি সব রাইফেল হাতে, দৌড়-ঝাঁপ এসব নিয়ে। সবকিছু নিয়ে স্টাডি করার পর দেখলাম আমি আব্দুস শাকুর আমার ছবিতে কোথাও বোঝা যায় না। শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক সবার মধ্যে এমন সময় হতাশা কাজ করে।

যখন নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকেই তখন কাজ বন্ধ করে দেয়। এমন সময়েই একদিন আমি আমাদের চারুকলার শিক্ষকদের রুমে যাই, দেখলাম কিছু বিদেশী ইনভাইটেশন কার্ড। পেইন্টিংয়ের কম্পিটিশনের ছবি পাঠাতে বলেছে। ভাবলাম একটু চেষ্টা করে দেখি। চিন্তা করছিলাম কী পাঠাব, কোন ধারার ছবি পাঠাব। যখন আমার ছবি খুঁজছিলাম, দেখলাম তৃতীয় বিশ্বের যে সমস্যা সেগুলো পাঠালে ওদের সাবজেক্টের সঙ্গে মেলে না। তখন আমি খুঁজতে থাকি দেশ নিয়ে কিছু করা যায় কিনা। তখনই আমি শীতলপাটি দেখতাম। এর মধ্যে অনেকগুলো লোকজ মোটিভ আছে। ময়ূর, হাঁস, টিকটিকি, কুমির ইত্যাদি ফর্ম শীতলপাটির ভেতরে আছে। এটি বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল এবং নোয়াখালী অঞ্চলে হয়। 

তখন আমি চিন্তা করলাম এখান থেকে একটা মোটিভ নিয়ে মডার্ন ছবি করা যায় কিনা। তাই সেখান থেকে একটা ময়ূর এঁকে নিয়ে এলাম ওদের মাপেই এবং সে অনুযায়ী ড্রয়িং করে কম্পোজিশন করে ছবি আঁকা। এভাবে শীতলপাটির লোকজ ধারায় তিনটি কাজ করেছি। বিড়াল, ময়ূর আর সূর্যমুখী ফুলের ওপরে ছিল একটি। ছবিগুলোর সঙ্গে কিছু লোকজ গীতি লিখলাম এবং কম্পিটিশনে পাঠালাম। সেখানে প্রায় ২২ হাজার ছবি জমা পড়েছিল এবং আমি পুরস্কার পাই। 

তখনই আমি বুঝতে পারলাম এ ধারার আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য আছে বিদেশীদের মধ্যে। আমাকে জানানো হয়েছিল আমি যে ছবিটি এঁকেছি আমার ছবিতে আমার দেশকে বোঝা যায়। আমি তখন চিন্তা করলাম একটা ছবিতে আমার দেশকে বোঝা যায়। দেশে তখন লোকজ ধারার ৪০-৫০টি বিষয় ছিল এবং আমি দেখলাম প্রথম লোকজ ধারা নিয়ে কাজ করেছেন যামিনী রায়। বাঁকুড়ার মন্দিরের টেরাকোটা ছিল, সেখানকার একটি ধারা বের করে আধুনিক কাজ করেছেন তিনি। তারপর আমাদের এখানে জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান এঁকেছেন। ধীরে ধীরে আরো অনেকেই এঁকেছেন। আমি যখন আঁকলাম তখন ভাবছিলাম এতগুলোর ভেতরে আমি কোথায় জায়গা পাব। আমি কোনো কিছু করতে গেলে হয় কামরুল হাসানের মতো হবে না হয় যামিনী রায়ের মতো হবে। যামিনী রায় ভারতের একজন আধুনিক শিল্পী। তখন আমি খুঁজতে থাকলাম এবং প্রায় ২২টি ফর্ম সংগ্রহ করলাম লোকজ ধারার। তালপাতা, নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, গাজির পট, বেহুলা-লখিন্দর—এসব কিছুর ওপরেই আমার ফর্ম এবং আধুনিক শিল্প ধারার কথা মাথায় রেখেই আমি আঁকি।

মৈমনসিংহ গীতিকা আমাদের লোকসাহিত্যের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। আপনি তা নিয়ে কাজ করেছেন। কেন এ সাহিত্যকর্ম আপনাকে আকর্ষণ করেছিল? 

দীর্ঘদিন লোকজ ধারার কাজ করার পর একটা সময় দেখলাম একই জায়গায় থেকে থাকার মতো হয়ে গেছে। মৈমনসিংহ গীতিকা বইটি পড়ে দেখলাম এখানেও আমাদের লোকজ অনেক বিষয় আছে। এটি নিয়ে বাংলাদেশে কোনো শিল্পী কাজ করেননি। অনেকে ইলাস্ট্রেশন করেছেন, তবে সেভাবে ছবি আঁকেননি। ১৯৮০ সালের দিকে হবে যখন আমি মৈমনসিংহ গীতিকার সাতটি চরিত্র নিয়ে কাজ শুরু করলাম। যেখানে বেশির ভাগই প্রেমবিষয়ক ঘটনা। মহুয়া, মলুয়া—এ চরিত্রগুলোর কম্পোজিশন কেমন হবে এগুলো ভাবছিলাম। তখন ওই আধুনিক চিন্তায় মহুয়ার একটা মুখ কম্পোজ করলাম। পাশে মহুয়ার গীতিকবিতাগুলো লিখলাম। এভাবেই আমার লেখা এবং কম্পোজিশন যারা সমালোচক, ছবি দেখেন তাদের ভালো লেগে যায় এবং তারা বলেন, তোমার এটি ভালো স্টাইল, এটি তুমি কন্টিনিউ করো। এভাবেই এটি নিয়ে কাজ করা। 

কাজলরেখা, চন্দ্রাবতী এঁকেছেন। তাদের আলাদাভাবে উপস্থাপন করার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল?

প্রায় সব চরিত্রের সঙ্গেই যুক্ত প্রেমের ঘটনা। সেখানে আবার প্রেমটা ভেঙেও যায়। সব চরিত্রেই তাই। শুধু চন্দ্রাবতী পড়তে গিয়ে দেখতাম ভারতে একমাত্র তিনিই মহিলা কবি। এভাবেই চরিত্রগুলো পড়ে, জেনে সেগুলো নিয়ে আমার কাজ। দেখা যায় বেশির ভাগ চরিত্রেরই শেষ পরিণতি মৃত্যু। প্রেমের শেষে আর কোনো সমাধান নেই। বেশির ভাগই দেখা গেছে আত্মহত্যাও করেছে। স্থানীয় মাতব্বররা আর তাদের মিলন হতে দেয়নি। আবার যেগুলো লোকাল রাজনীতির গল্প সেগুলোয় আরো নানা ঝামেলা। 

‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ নিয়েও আপনার কাজ ব্যাপকভাবে পরিচিত। এ বিষয়ে শুনতে চাই।

শিল্পকলার একটি প্রস্তাব এসেছিল, এ বিষয়ে একটি এক্সিবিশন করার। জসীমউদ্‌দীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কাজটি করা হয়েছিল। আমি তখন মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়েই কাজ করতাম। আমাকে তারা বললেন নক্সী কাঁথার মাঠ বা সুজন বাদিয়ার ঘাট নিয়ে কাজ করতে। আমি বিষয়টি পড়লাম, দেখলাম এখানে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মৈমনসিংহ গীতিকার মতো অনেকগুলো চরিত্র নেই। শিল্পকলার কাজ ছাড়া যখন আবার ফেলোশিপের কাজের জন্য ইতালিতে গিয়েছিলাম তখনো নক্সী কাঁথার মাঠ নিয়ে কাজ হয়েছে। 

লোক ঐতিহ্যের মোটিফ ও চিত্রকলায় বিদ্যমান আধুনিক প্রবণতা-পদ্ধতি-কৌশলের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে করেন?

আধুনিক একটি ছবি আঁকতে গেলে শিল্পীকে একটি পথ বের করতে হয়। একটি হলো বাঁকা পথ আর একটি সহজ। শিল্পী যদি মনে করে, একজন মানুষ তার ছবি দেখে ভাববে সহজে ছবি আঁকা যায়। সহজ ছবি হলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। যে ছবি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না সে ছবির তো প্রয়োজন নেই। যত সহজে একজন শিল্পী ছবি আঁকবে যত কম রঙ ব্যবহার করে, ততই সহজে সে ছবি মানুষ বুঝতে পারবে। আমাদের সমাজের কাছে কিছু দায়বদ্ধতা আছে। ছবির মধ্য দিয়ে যদি কোনো মেসেজ দিতে না পারি তাহলে সে ছবির মানে নেই। পাবলো পিকাসোর সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি গোয়ের্নিকা, সাদা-কালো রঙে আঁকা। কত সহজ সে ছবি এবং প্রত্যেকের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সারা বিশ্বেও তাই। 

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার কাজ আছে। এগুলো কোন সময়ে করা?

আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজাকারদের কারণে বর্ডারে আটকা পড়লাম। গ্রামে ছিলাম তখন। সেখানেও খুবই খারাপ অবস্থা ছিল। বাজারেও বের হওয়া যায়নি। আমি এক গহিন গ্রামে গিয়ে অবস্থান নিয়েছিলাম। যেখানে আর্মি যায় না। খাবারের কষ্ট ছিল অনেক। আমরা যারা সে অবস্থা থেকে বেঁচে ফিরেছি আমরা জানি সে কী ভংয়কর পরিস্থিতি ছিল। আমি প্রথম দিকে কিছু ছবি এঁকেছিলাম। পরে ভারতে গিয়েও বেশকিছু এঁকেছি। কিন্তু আর আঁকা হয়নি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকলে শুধু মুক্তিযুদ্ধের ছবিই আঁকতে হবে। কখনই শেষ হবে না মুক্তিযুদ্ধের ছবি। হাজার বছর পরেও দেখা যাবে একজন শিল্পী পাওয়া গেছে খুব নামকরা যিনি মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকেন। পৃথিবীব্যাপী এমনই হয়েছে। ২০১৩ সালে কিছু পত্রিকার পৃষ্ঠায় আমি মুক্তিযুদ্ধের শেড কিছু ছবি এঁকেছি। গণহত্যা, আটকা পড়া ছয় কোটি মানুষকে নিয়ে লাল আর কালো রঙ ব্যবহার করে এঁকেছিলাম। 

আপনি দেশের সিনিয়র শিল্পী ও শিক্ষকদের একজন। অনেক বিখ্যাত শিল্পী আপনার অগ্রজ বা বন্ধু ছিলেন। শিল্পীজীবনের এ সঙ্গীদের নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য স্মৃতি থাকলে তা শোনাবেন?

আমার সঙ্গের বেশির ভাগই আর ছবি আঁকেনি। আর্ট কলেজে পড়েছে এমন অনেকের মধ্যে আমরা চার বন্ধু ছবি আঁকতাম। একজন মারা গেল, একজন জাপানে আছে, ও ছবি আঁকে। আমার সিনিয়র অনেকেই ভালো ছবি আঁকেন, এর মধ্যে শহীদ কবির, বীরেন সোম, মনিরুল ইসলাম আছেন। এছাড়া আমাদের অনেক শিক্ষক রফিকুন নবী, হাসেম খান। জয়নুল আবেদিন স্যার ও সফিউদ্দীন আহমেদ স্যারের হাত ধরেই ছাত্ররা মডার্ন আর্ট শুরু করল।

আপনি একজন ক্যালিগ্রাফারও। বাংলাদেশে শিল্পের এ ধারার ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি কিছু বলতেন। 

ক্যালিগ্রাফ আর্ট বলতে যেটা বোঝায় আমি সেটা করিনি। সেটি আলাদা বিষয়। হিন্দি, আরবি, উর্দু, চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ান এসব ভাষার ক্যালিগ্রাফি হয়। তবে বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির সে চর্চাটা হয়নি। আমাদের বর্ণমালায় ফর্মটা আলাদা। আমি যেটি করেছি ছবির পার্ট হিসেবে করেছি। মৈমনসিংহ গীতিকা করলাম, সেখানে ছবির নিচে যে কবিতা লিখেছি সেটি অনেকে বলে ক্যালিগ্রাফ। ছবির কম্পোজিশনের স্বার্থেই করা।  

এখন কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন? সামনে কোনো পরিকল্পনা আছে কি? 

চেষ্টা করি সারা দিনে একটা হলেও ড্রয়িং করার। বসে থাকলে সময় কাটে না। গান শুনি আর কিছু ড্রয়িং করি। সাতদিনে দুদিন আমি স্টুডিওতে যাই। সামনে গ্যালারি কায়া ও ধানমন্ডিতে আমার একটি এক্সিবিশন হওয়ার কথা রয়েছে। করোনার ওপর কিছু ছবি এঁকেছিলাম। সেগুলো নিয়েই দুটি এক্সিবিশন হবে। এছাড়া আমার একটি বই পাবলিশড হওয়ার কথা আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন