শীতল যুদ্ধের দৃশ্যরূপ

তানভীর পারভেজ

ওয়ান: নাম্বার থার্টি ওয়ান, ১৯৫০। শিল্পী: জ্যাকসন পোলক ছবি: দ্য মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট

শত বছরের অধিক কাল ধরে দৃশ্যশিল্পে বিমূর্ত শিল্পধারা একচ্ছত্রভাবে প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। দৃশ্যশিল্প বলতে অনেকেই মনে করেন শুধু বিমূর্ত শিল্প। বিমূর্ততাকে দৃশ্যশিল্পের সর্বোচ্চ পর্ব বলেও বিবেচনা করা হয়। অন্তত আমাদের দেশে, দৃশ্যকলা শিল্পীদের যোগ্যতার সর্বোচ্চ মানদণ্ড নির্ভর করে সেই শিল্পীর শিল্পচর্চায় বিমূর্ততার আকারায়নের ওপর। বিমূর্ত শিল্পের ব্যাখ্যায় বলা হয়, দৃশ্যশিল্পের একটি শৈলী বিমূর্ত শিল্প, যা বাস্তবতার দৃশ্যজ উপস্থাপন করা থেকে বিরত থেকে আকার, ফর্ম, রঙ, টেক্সচার ইত্যাদি ব্যবহার করে বাস্তবতার অপ্রতিনিধিত্বমূলক এক দৃশ্যের উপস্থাপন করে। অর্থাৎ বিমূর্ততাবাদীরা মূল বস্তু বা বাস্তব দৃশ্যের সঙ্গে সরাসরি সাদৃশ্যপূর্ণ যেকোনো বিষয়ের প্রতিনিধিত্বমূলক দৃশ্যজ উপস্থাপনকে নকল বলে ধারণা করে। তাই তারা বলে থাকেন, আপনার কাছে আসল আছে, তাহলে নকল তৈরি করতে কেন সময় নষ্ট করবেন। কালখণ্ডের বিচারে সর্বপ্রথম বিমূর্ত শিল্প রচনা করেন সুইডিশ নারী শিল্পী হিলমা আফ ক্লিন্ট। তবে বলা হয়ে থাকে দৃশ্যশিল্পকে বাস্তবতার কঠিন শৃঙ্খল থেকে পরিপূর্ণ মুক্তি দেন ওয়াসিলি ক্যান্ডিনস্কি। 

বিমূর্ত শিল্পশৈলীর দিকে অগ্রসর হওয়ার মূল কারণ যদি আমরা অনুসন্ধান করি তবে দেখব বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নতুন বেশকিছু চিন্তা মানুষের স্বীকৃত বিশ্বাসকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিয়েছে এবং মানুষের পূর্ববর্তী সব অনুধাবনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বিশেষ করে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ, ফ্রেডরিখ নিটশের খ্রিস্টীয় নৈতিকতার প্রত্যাখ্যান এবং কার্ল মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের অবচেতন মনস্তত্ত্ব, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সর্বোপরি রাদারফোর্ডের পরমাণুর বিভাজনের মতবাদ মানবসভ্যতাকে চিন্তার যে বাস্তবতায় এনে হাজির করেছে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই দৃশ্যকলায় ঘটেছে কিউবিজমের আবির্ভাব। মূলত দৃশ্যকলায় কিউবিজমের মধ্য দিয়ে বিমূর্ততার শিকড় রচনা হয়। বিমূর্ততাই পরবর্তী সময়ে একের পর এক আভঁ-গার্দ আন্দোলনগুলোর মধ্য দিয়ে ইউরোপের দৃশ্যশিল্পে সমসাময়িক সামাজিক রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আগে উদ্ভাবিত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং চর্চিত শিল্পধারার শৈলীকে নান্দনিক শৈল্পিক বৈধতায় চ্যালেঞ্জ করে। সেই সঙ্গে দৃশ্যশিল্পের শৈলীতে এবং নান্দনিক বোঝাপড়ার দিক থেকে নতুনত্বকে প্রবর্তন করে। শিল্পের প্রাণকেন্দ্র তখন প্যারিস। বলা হয় একের পর এক আভঁ-গার্দ আন্দোলনের সাফল্যের উচ্ছ্বাসের জোয়ারে প্যারিসের শিল্প আন্দোলন দিন দিন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বিমূর্ততার সর্বজনপ্রিয় পর্বটি রচনা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে। ১৯৪৬ সালে একটি প্রদর্শনীর পর্যালোচনায় ঔপন্যাসিক, গল্পকার, শিল্প সমালোচক রবার্ট এম কোটস যুক্তরাষ্ট্রের বিমূর্ততাকে শনাক্ত করতে গিয়েঅ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম বা বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ নামটি কয়েন করেন।

একদিকে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারা মানুষের জীবনমানের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকতার নতুন সমীকরণ, অর্থনৈতিক শ্রেণীবিভেদ সামাজিক মূল্যবোধের অসহায়ত্বসহ নানাবিধ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ সমাজ হতাশাগ্রস্ত। বামপন্থী নীতিগুলো তখন তাদের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য বিষয়, শিল্পীরাও এর থেকে বাদ পড়ে না। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সরকারের ফেডারেল আর্ট প্রজেক্টের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বৃহৎ আকৃতির ম্যুরাল তৈরির কর্মকাণ্ড শুরু হয়। সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আমেরিকার আঞ্চলিক চিত্রের প্রচার উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যুরাল রচিত হয়েছে সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম শিল্পধারায়। প্রজেক্টের বেশকিছু অংশে শিল্পীদের সম্পূর্ণভাবে নিরীক্ষা করার সুবিধা দেয়া হয়েছিল। নিউইয়র্কভিত্তিক এমনই এক উদার পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন জ্যাকসন পোলক, মার্ক রথকো আরশিল গোর্কির মতো বেশকিছু শিল্পী। মনে রাখতে হবে, পোলক রথকো ছিলেন গভীরভাবে মার্ক্সবাদের সমর্থক, তারা মূলত ইউরোপীয় কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পপুলার ফ্রন্টকে সমর্থন করতেন। সে সময়আমেরিকান আর্টিস্টস কংগ্রেস নামে একটি সংগঠন পপুলার ফ্রন্টের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সোভিয়েত কৌশলকে সমর্থন করে একাধিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড চালায়। দেশত্যাগী ফরাসি পরাবাস্তববাদী নেতা আন্দ্রে ব্রেটন, মেক্সিকান ম্যুরালিস্ট দিয়েগো রিভেরা এবং নির্বাসিত মার্ক্সবাদী বিপ্লবী, তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ লিওন ট্রটস্কির সঙ্গেটুওয়ার্ডস ফ্রি রেভল্যুউশনারি আর্ট শিরোনামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইশতেহার রচনায় যোগ দিয়েছিলেন। তারা জোর দিয়েছিলেন, ‘শৈল্পিক সমাজতান্ত্রিক রেডিক্যালিজম একসঙ্গে চলতে হবে। অন্যদিকে নিউইয়র্কভিত্তিক শিল্প নিরীক্ষায় সুবিধাপ্রাপ্ত শিল্পীরা কিউবিস্ট-উৎপন্ন বিমূর্ততা, ইউরোপীয় শিল্পধারার অভিব্যক্তিবাদ পরাবাস্তববাদের সঙ্গে মিথ আর আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের টোটেমগুলোর প্রভাবকে একত্র করে, আদিমতাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নতুন ধরনের শৈলী অনুসন্ধান করেন। নতুন প্রবণতাকে সমর্থন করতে শুরু করেছিলেন কমিউনিস্টপন্থী শিল্প সমালোচক ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ। গ্রিনবার্গের দৃষ্টিতে এসব প্রচেষ্টা ছিল নিউইয়র্কভিত্তিক আভঁ-গার্দ রেনেসাঁর উত্তরণ পর্ব। উত্তরণটি দুটি ধাপে ঘটেছিল: যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প প্রথমে জাতীয়তাবাদ থেকে আন্তর্জাতিকতাবাদে এবং তারপর আন্তর্জাতিকতা থেকে সর্বজনীনতায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। শিল্পকলার জগতে প্যারিশিয়ান আধিপত্যকে সম্পূর্ণভাবে বিলীন করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদচর্চার সূচনা এভাবেই ঘটে।

মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তখন একটি শক্তিশালী অর্থনীতি, একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী আর পরমাণু বোমাসহ শ্রেষ্ঠত্বের ট্রাম্পকার্ড। তখন শৈল্পিক আধিপত্য, সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী বিশ্বাস করে, যুদ্ধ জয়ের প্রধান কৌশল সাংস্কৃতিক বিজয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে গ্রিনবার্গ ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প বিশ্বের সর্বোত্তম শিল্প। ওই একই বছর মে মাসে চাপের মুখে গ্রিনবার্গ কমিউনিজমের বিরুদ্ধে এবং আধুনিক শিল্পের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিলেন। তার বিভিন্ন লেখায় তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প সবচেয়ে আধুনিক এবং পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উচ্চাঙ্গের শিল্প বা হাই আর্ট। গ্রিনবার্গের মতে, শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ঔপনিবেশিক জাতি থেকে উপনিবেশ স্থাপনকারী জাতি হিসেবে রূপান্তরিত হলো। স্বতঃস্ফূর্ততা, বিশুদ্ধতা অসম্পূর্ণতার সঙ্গে ক্যানভাস এবং শিল্পীর সীমাহীন স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আজকের যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভোগবাদী আধুনিকতা তাকেও গ্রহণযোগ্য স্বীকৃতি দেয় বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ। আধুনিকতা তথা মডার্নিজমকে বুঝতে হলে বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদচর্চার যাত্রাটা আমাদের আমলে আনতে হবে। আধুনিকতার নতুন বীভৎসতা, দৃশ্যত সর্বগ্রাসিতা নয়, তাই সোভিয়েত তথা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রতিনিয়ত রক্তক্ষয়ী ছিল না, যুদ্ধটিশীতল যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার গ্রিনবার্গ আহ্বান জানান, শীতল যুদ্ধে শিল্পীকেও তার ভূমিকা পালন করতে হবে। গ্রিনবার্গ স্পষ্টত মনে করতেন, ‘উচ্চ সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য শিল্পীদের অবশ্যই কঠোরভাবে কমিউনিস্টবিরোধী হতে হবে। অথচ স্বয়ং ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ, জ্যাকসন পোলক, মার্ক রথকোসহ আরো অনেক কমিউনিজম সমর্থকের হাতেই রচিত হলো কমিউনিজমবিরোধী সিআইএর প্রজেক্ট। পরিশেষে বলতে হয়, ইতিহাসের পরিহাস, কমিউনিজমের আঁতুড়ঘরে জন্ম নিল পুঁজিকেন্দ্রিক ভোগবাদী আধুনিকতার দৃশ্যরূপ।

ইতিহাসের ধারণাকে দৃশ্যত প্রকাশ করতে আর্ট অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ নামে কনসেপচুয়াল জনরার একটি দললেনিনের প্রতিকৃতি সবার সামনে নিয়ে আসে। আর্ট অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ আশির দশকে অনেক শিল্পীর আঁকা লেনিনের প্রতিকৃতি সিরিজের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসে। শিল্পী ভি চারাঙ্গোভিচের আঁকা ভিআই লেনিনের প্রতিকৃতিটি জ্যাকসন পোলকের রচনাশৈলীতে আঁকা হয়েছে, দাড়িসহ বাম দিকে বাঁকা লেনিনের মুখ। ছবির মাঝেই আমরা দেখব স্পষ্টতই প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি ভিন্ন শৈল্পিক নীতি একসঙ্গে আবদ্ধ; বাস্তববাদ এবং বিমূর্ততায় রচিত আজকের আধুনিকতা। স্নায়ুযুদ্ধের আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই যেন অসম্ভব অস্থিরতা নিয়ে একই বিন্দুতে স্থির হয়েছে। শীতল যুদ্ধ পৃথিবীকে দুই মেরুতে ভাগ করেছে, মেরুকরণ আজও জাতিতে-জাতিতে বিগ্রহ সৃষ্টি করছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। মানবজাতিকে যার খেসারত কতকাল বইতে হবে তা শুধু ভবিষ্যৎ জানে।

তথ্যসূত্র

1. Rereading Abs tract Expressionism, Clement Greenberg and the Cold War, Daniel Neofetou, Bloomsbury Visual Arts; New York, London.

2. How New York Stole the Idea of Modern Art, Serge Guilbaut, Translated by Arthur Goldhammer, The University of Chicago Press, Chicago and London.

3. Abs tract Art, Anna Moszynska, Thames & Hudson Ltd, London.

4. After Modern Art 1945-2000, Dr David Hopkins; OXFORD University Press, New York.

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন