সাত দশকের শিল্পীর করতলের ছাপ

জান্নাতে নাঈম

শিল্পী: সফিউদ্দীন আহমেদ। উডকাট, ১৯৪৪ ছবি: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

জ্যৈষ্ঠের রৌদ্র ঝরা বিকাল। ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। অনেকটা ক্লান্ত প্রাণ। মূল ফটক পেরিয়ে প্রশস্ত আঙিনায় গিয়ে দাঁড়াতেই প্রশান্তির ছোঁয়া লাগতে শুরু করল। সামনে সারি সারি চেয়ার-টেবিল পাতা। মুখরিত প্রাঙ্গণে শামিয়ানার ভূমিকা পালন করছে প্রবেশপথের সুউচ্চ বৃক্ষ দুটি। এর মধ্যে হঠাৎ এক হলকা বাতাসে শর শর করে উঠল গাছের পাতাগুলো। আর সেই সঙ্গে ঝর ঝর করে পড়তে লাগল ফুল। যেন ফুলবৃষ্টি। কুকুরচিতা বা পিপুলটি গাছের পুঁতির মতো ফুলগুলোই যেন বরণ করে নিচ্ছে আগতদের। মুহূর্তেই মন ফুরফুরে হয়ে উঠল। একটু ধাতস্থ হতেই চোখ গেল সিঁড়ির ওপর টবে সাজানো কাঠগোলাপের চারাগাছটির দিকে। কচি গাছটিতে ফুটে থাকা সাদা ফুল দুটি সাদর সম্ভাষণ জানাল। কেননা ওই ফুল থেকে ডান দিকে চোখ ফেরালে দৃষ্টি আকর্ষণ করলছাপাইচিত্রের পরম্পরা লেখা সাইনবোর্ডটি। তাই একটুও দেরি না করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলাম। ঢুকে পড়লাম ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের ৪২ নম্বর বাড়ির বেঙ্গল শিল্পালয়ের কামরুল হাসান প্রদর্শনশালার প্রদর্শনীতে। এখানে চলছে ছাপাইচিত্রের পরম্পরা প্রদর্শনী। গ্যালারিজুড়ে শোভা পাচ্ছে গত সাত দশক ধরে করা বিভিন্ন শিল্পকর্ম। আর প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া সব দৃশ্যইছাপচিত্র

শুরুতে শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের করাবাড়ির পথে ফেরা শিরোনামের কাঠ খোদাইয়ের চিত্রকর্মটি দেখে মনটা উদাস হয়ে গেল। আক্ষরিক অর্থে মনটা বাড়ির পথে নিয়ে গেল। ১৯৪৭ সালের কাজটি দেখে যন্ত্র-যাতনায় আটকে থাকা নাগরিক প্রাণের সঞ্চার জোগায়।

এর পর গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতির সামনে। ১৯৫৯ সালে আঁকা ছাপচিত্রটি শিল্পী যৌবন বয়সে কেমন ছিলেন, তা দেখার সুযোগ হলো।

শিল্পী তার রঙের তুলিতে পৃথিবী রঙিন করে তুলতে চান। এজন্য প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ছন্নছাড়া ক্ষুধিতের চিত্র এঁকেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তার ছাপচিত্র দেখার সুযোগ ঘটল এখানে এসে। সাপ, কুমির, শিয়ালসহ নানা প্রাণী ফুটে উঠেছে কামরুল হাসানের ছবিতে। গ্যালারির ডান দিকটা ধরে এগোতেই চোখে পড়ল

আনিসুজ্জামান আনিসের আঁকানাপিত দৃশ্যটি। গ্রামীণ পটভূমির ছাপচিত্রে নাপিত একটি ছোট ছেলের মাথার চুল কাটছেন। তার সামনে অপেক্ষমাণ অভিভাবক এবং ছোট্ট আরেকটি শিশু। সে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাপিতের ক্ষুরের দিকে। চিত্রটির সামনে দাঁড়িয়ে অনেকেই ছবি তুলছেন। এমন একজন দর্শনার্থী আহমেদ রনি। এই প্রদর্শনী কেমন লাগছে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে বিচিত্র রকমের কাজ দেখার সুযোগ হলো। দেশের প্রথিতযশা সব শিল্পীর কাজই দেখলাম। বিশেষ করে এইনাপিত ছবিটিতে মূলত আমাদের ফেলে আসা নব্বই দশকের গ্রামীণ জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে। দর্শনার্থী আরো বলেন, ‘এখন চাইলেও আমাদের সন্তানদের গ্রামে নিয়ে এমন দৃশ্য দেখাতে পারব না। দর্শকের মতো আরো অনেকেরই স্মৃতির ভাবনার সঙ্গে সেতুর বন্ধন ঘটিয়েছে ছাপচিত্রটি।

সহজ অর্থে যদি বলি শিল্পীর তুলিতে সত্য, সৌন্দর্য, ভালোবাসা আর এসবের যোগসাজশে হয়ে ওঠে প্রকৃত শিল্পকলা। রুহুল আমিন তারেকের আঁকা আয়না হাতে নারীর দৃশ্যটি সেটাই প্রমাণ করে। ১৯৮২ সালে হাবিবুর রহমানের করামেয়ের যত চিন্তা ছবিটিও দর্শককে ভাবনার দ্যোতনায় ফেলে দেবে। রুমানা রহমানের করোনাকালীনের একটি ছাপচিত্র অনেকটুকু আবেগপ্রবণ করে দেয়।

পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে সমকালীন শিল্পীদের আঁকা ৭৬ শিল্পীর ৮০টিরও বেশি ছাপচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী। নান্দনিক আয়োজন দেখার সময় গ্যালারি প্রাঙ্গণে পরিচয় হয় শিল্পী রফি হকের সঙ্গে। এখানে তার ছাপচিত্রও স্থান পেয়েছে। কথা প্রসঙ্গে এই শিল্পী জানান, শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়াসহ আরো যে গুরুস্থানীয় শিল্পীর হাত ধরে আমাদের দেশের ছাপচিত্রের বিকাশ ঘটেছে, তাদের শিল্পকর্মের সঙ্গে একেবারে নবীন শিল্পীর চিত্রও এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রদর্শনীর নামছাপাইচিত্রের পরম্পরা অর্থাৎ গুরুর কর্মও যেমন এখানে আছে, আবার শিষ্যের কাজও স্থান পেয়েছে। ঐতিহাসিক বর্তমান প্রেক্ষাপটের কাজের ধারাবাহিক বয়ান প্রদর্শনী।  ‘ছাপচিত্র বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে শিল্পকে পৌঁছানোর সহজ মাধ্যম ছাপচিত্র। এই শিল্পীর সঙ্গে কথা শেষ করে দাঁড়ালাম কাচঘেরা একটি টেবিলের সামনে। অপার বিস্ময় নিয়ে একটি শিশু টেবিলের ওপর সাজানো তুলি, ব্রাশসহ নানা সরঞ্জাম দেখছে। এসব উপকরণ দিয়েই শিল্পী গড়ে তোলেন তার নান্দনিক শিল্পকর্ম। কাঠখোদাই, রাবিং, লিথোগ্রাফি, এচিং, ইনতাগ্লিও, ড্রাই পয়েন্ট বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পকর্ম গড়ে তুলতে টেবিলের উপকরণগুলো ব্যবহার করে থাকেন। এটাও দর্শনার্থীর কাছে জানান দিচ্ছে ভিন্ন একটি বিষয়। বহুমুখী শিল্পীর কয়েক দশকের বাছাই করা ছাপাই ছবি দিয়ে সাজানো প্রদর্শনী।

একেবারে নবীন শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ রয়েছে। প্রদর্শনীতে জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে হামিদুজ্জামান খান, অসীত মিত্র, আনিসুজ্জামান আনিস, আবুল বারক আলভী, আব্দুল্লাহ আল বশীর, আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, কালিদাস কর্মকার, মাহমুদুল হক, রফিকুন নবী, রোকেয়া সুলতানা, শহিদ কবির, নাজিব তারেক, জাফরিন গুলশান, সুবর্ণা মোর্শেদা, সুজিত সরকারসহ অনেকেরই কাজ ঠাঁই পেয়েছে।

১১ মে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে আগামী ১১ জুন পর্যন্ত। সাপ্তাহিক বন্ধ রোববার ব্যতীত প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন