প্রসঙ্গ: ভিডিও আর্ট

তানভীর পারভেজ

টিভি বুদ্ধ, ১৯৭৪, শিল্পী: ন্যাম জুন পাইক ছবি: আল্ট্রা

বিশ্বব্যাপী ভিডিও আর্ট আজ দৃশ্য শিল্পের মূল ধারার কেননের অংশ। কী ধরনের চিন্তা, ভাবনা, বিশ্বাস ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিডিও আর্টকে দৃশ্য শিল্পে একটি জনরা (Genre) হিসেবে স্বীকৃতি দিল তার পরিচ্ছন্ন ধারণার জন্য ভিডিও আর্টের সূচনা পর্বের পর্যালোচনা আবশ্যক। সূচনা পর্ব নিয়ে মতভেদ থাকলেও যতদূর জানা যায় দৃশ্য শিল্পে সর্বপ্রথম ভিডিওর ব্যবহার করেন জার্মান শিল্পী উলফ ভোস্টেল (Wolf Vos tell) তার একটি অ্যাসেমব্লেজে। শিল্পী উলফ ভোস্টেল সে সময় একজন ফ্লাক্সাস (Fluxus) শিল্প আন্দোলনের সদস্য ছিলেন। ফ্লাক্সাস শিল্প আন্দোলনের আরেক শিল্পী ‘ন্যাম জুন পাইক’ পরবর্তী সময়ে ভিডিও আর্টের জনক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। বলা হয় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দশকগুলোয় একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের শিল্প আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়। মূলত ভিডিও আর্টের সূচনা পর্বে শিল্পীরা সে সময় যাত্রা শুরু করা নতুন শিল্প আন্দোলনগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তারা ভিডিও আর্টের সঙ্গে যুক্ত হন। ফলে ভিডিও আর্টও এসব শিল্প আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিল—ফ্লাক্সিজম (Fluxism), পারফরম্যান্স আর্ট, আর্ট পভেরা, মিনিমাল স্কাল্পচার, কনসেপচুয়াল আর্ট, আভঁ-গার্দ মিউজিক, এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম, কনটেম্পোরারি ডান্স, থিয়েটারসহ নানা আন্দোলনের নানা ধারণা ভিডিও আর্টকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। মনে রাখতে হবে, ভিডিও আর্টের নামকরণ করা হয় অনেক পরে, নানা রকম জনরার সান্নিধ্যে সূচনাকালে তাই এ শিল্পকে বিভিন্ন নামে শনাক্ত করা হতো।

সে সময়ের ক্রস ডিসিপ্লিনারি কালচারাল ক্রিয়াকলাপ, বৈশ্বিক ভাবনা, দার্শনিক তত্ত্ব, রাজনৈতিক ও সামাজিক অ্যাক্টিভিজম ভিডিও আর্টকে একটি বৈচিত্র্যময় পরিসর রচনায় সহায়তা দিয়েছিল। তাই দেখা যাবে যে এসব মিথস্ক্রিয়ার ফলে ভিডিও আর্টের উপস্থাপনা পদ্ধতির অভিনবত্বের মধ্য দিয়ে ভিডিও আর্টকে বেশ কয়েকটি উপশৈলীতে বিভক্ত করা হয়। শিল্প সমালোচক গ্রেগরি ব্যাটকক (Gregory Battcock) ভিডিও আর্টের শৈলীকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথমটি হচ্ছে রেকর্ডকৃত ভিডিও আর্ট, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইনস্টলেশন ভিডিও আর্ট। অন্যদিকে রেকর্ডকৃত ভিডিও আর্ট বিষয়ের দিক থেকে আমেরিকান ভিডিও শিল্পী আইরা স্নাইডার (Ira Schneider) ও বেরিল কোরোট (Beryl Korot) তিনটি বিভাজন পরিলক্ষণ করেন, এক. আর্টিস্ট বা পারফরমার নির্ভর ভিডিও, দুই. পরিবেশনির্ভর ভিডিও, তিন. অ্যাবস্ট্র্যাক্ট সিন্থেসাইজড ইমেজনির্ভর ভিডিও। আমেরিকান লেখক ও কিউরেটর জন হ্যানহার্ড (John Hanhardt) অবশ্য মনে করেন, ‘যেকোনো ফর্মে ভিডিও আর্ট একটি স্ক্রিননির্ভর মাধ্যম এবং ইনস্টলেশনভিত্তিক একটি শিল্পশৈলী, একে কোলাজ কৌশলের একটি সম্প্রসারণ মাধ্যম হিসেবেও দেখা যেতে পারে।’

ভিডিও মাধ্যমটি মূলত বৈদ্যুতিক তরঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কিত যতক্ষণ বৈদ্যুতিক প্রবাহ আছে ততক্ষণ এটি স্থায়ী থাকবে এবং যখন এ বৈদ্যুতিক তরঙ্গের প্রবহমানতা বন্ধ হয়ে যাবে তখন এটি অস্থায়ী হয়ে পড়বে। এ মাধ্যমগত সীমাবদ্ধতাকে অনেক প্রারম্ভিক অনুশীলনকারী শিল্পী গুণ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। বিশেষ করে যেসব শিল্পী শিল্প বাজারের প্রভাব ও বাণিজ্যিকতা এড়াতে চেয়েছিলেন তারা ভিডিওর এ অস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ভিডিওর ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যে কিন্তু থিয়েট্রিক্যাল সিনেমাও উপস্থিত ছিল, কিন্তু ভিডিও আর্ট ও থিয়েট্রিক্যাল সিনেমার মধ্যে মূল পার্থক্যগুলো হলো ভিডিও আর্ট অগত্যা থিয়েট্রিক্যাল সিনেমাকে সংজ্ঞায়িত করে এমন বেশির ভাগ কনভেনশনের ওপর নির্ভর করে না। ভিডিও আর্টে পারফরমার নাও থাকতে পারে, কোনো সংলাপ নাও থাকতে পারে, কোনো অডিও নাও থাকতে পারে, সিনেমার মতো প্লট বা চরিত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশিত ধারণাকে ভিডিও আর্ট অস্বীকার করে। ভিডিও আর্টে কোনো বোধগম্য বর্ণনা নাও থাকতে পারে, পরিশেষে থিয়েট্রিক্যাল সিনেমায় বিনোদন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে এমন কোনো প্রথাকে প্রশ্রয় দেয় না। এসব পার্থক্য ভিডিও আর্টকে সিনেমা ও সিনেমার উপশ্রেণী তথা শর্ট ফিল্ম থেকেও আলাদা করে। প্রকৃতপক্ষে ভিডিও আর্ট একজন শিল্পীর আবেগের বিবৃতি বা স্ন্যাপশটকে নির্দেশ করে। কিছু ক্ষেত্রে ভিডিও আর্ট কোনো বাস্তব ব্যাখ্যা দেয় না, কিন্তু শুধু শিল্পীর মনের একটি আভাসকে উন্মোচন কল্পে থিমের একটি প্রতিফলন ঘটায়। আমরা দেখে থাকব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো আঁটসাঁট বুনন ছাড়াই এ ধরনের কাজগুলোর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত ছিল ভিডিও আর্টের সূচনা পর্বে।

বস্তুত এক বাক্যে ভিডিও আর্টের ডেফিনেশন বা সংজ্ঞা উপস্থাপন করা কঠিন; বরং ফরাসি লেখক সমালোচক ও চলচ্চিত্রতত্ত্ববিদ ফিলিপ ডুবইসের (Philippe Dubois) কথা অনুকরণ করে বলা যায় ভিডিও আর্ট হলো শিল্পমাধ্যমের একটি পরীক্ষামূলক অবস্থান, যা প্রতিটি উপস্থাপনেই উত্তর দেয়ার পরিবর্তে প্রশ্নের বা চিন্তার জন্ম দেয়। বস্তুত ভিডিও আর্ট একটি প্রযুক্তিগত মাধ্যম, যা তার উৎকর্ষ ও বিকাশের মধ্যে দিয়ে একটি শিল্পধারার নাম হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ ভিডিও আর্টিস্ট, লেখক ডেভিড হল (David Hall) শিল্পীদের ভিডিওকে ভিডিও আর্ট নামে শনাক্ত করেন এবং একে শিল্প হিসেবে দাবি করেন।

আগেই বলা হয়েছে, ন্যাম জুন পাইক ভিডিও আর্টের জনক। পশ্চিম জার্মানি রেডিও স্টেশনের স্টুডিওতে কাজ করার সময় পাইক অসংখ্য সুরকারের সংস্পর্শে নিজেই জার্মান আভঁ-গার্দ সংগীতের অংশ হয়ে ওঠেন। পাইক আমেরিকান সুরকার জন কেজের দ্বারা প্রভাবিত হন।

জন মিল্টন কেজ অন্যতম প্রভাবশালী আমেরিকান সুরকার ও সংগীত তাত্ত্বিক। জন কেজ তার কাজের মাধ্যমে সব সময় সুরের মুক্তি ঘটাতে চেয়েছেন। প্রাচ্যের জেন দর্শনের প্রতিও তার ছিল গভীর আগ্রহ। মনে রাখতে হবে, ভিডিও আর্টের আলোচনা জন কেজকে বাদ দিয়ে প্রায় অসম্ভব। কারণ ১৯৬৩ সালের মার্চে জার্মানির পার্নাস (Parnass) গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় পাইকের প্রথম একক প্রদর্শনী ‘এক্সপোজিশন অব মিউজিক-ইলেকট্রনিক টেলিভিশন’ মূলত কেজের কাজ ‘ইমাজিনারি ল্যান্ডস্কেপ নং ৪’-এর অনুপ্রেরণায় করা। কেজ তার কাজে সুর তৈরির জন্য ১২টি ‘লাইভ’ রেডিও ব্যবহার করেছিলেন। অন্যদিকে, পাইক তার প্রদর্শনীতে টেলিভিশনকে শিল্পের মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন।

প্রদর্শনীতে পাইক টেলিভিশনের বাণিজ্যিক ব্যবহারকে এড়িয়ে মাধ্যমের প্রযুক্তিগত সম্ভাবনাগুলো অন্বেষণ করছিলেন। তিনি রেকর্ড করা ফুটেজগুলোর স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে রূপান্তর করে, বিকৃত ছবি উপস্থাপনের মাঝে একটি নতুন নান্দনিকতা তৈরিতে দৃশ্যকলাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল ‘বিকৃতিই মুক্তি’ সুন্দরের প্রাচীন নৈপুণ্যের পরিবর্তনের মাধ্যমে শিল্পকলার সমগ্র কৌশলকে রূপান্তর করে ইলেকট্রনিকভাবে নতুন ভিজুয়াল ইমেজ তৈরি করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ইলেকট্রনিক টেকনোলজির এ প্রক্রিয়া ভবিষ্যতের ডিজিটালভিত্তিক শিল্পকর্মের পথকে প্রশস্ত করে। এ সময় থেকে পৃথিবীর মানুষ টেলিভিশন সেটকে সাংস্কৃতিক বস্তু হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে।

পাইক ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। এখানে এসে বুঝতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার মিডিয়ার আধিপত্য বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও সামরিক স্বার্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। টেলিভিশন যেন একটি ইলেকট্রনিক আয়না, যার সাহায্যে সামাজিক পরিচয়—নারীত্ব, পুরুষত্ব, যৌনতা ও জাতীয়তার রূপরেখা শাসকদের নির্দেশমতো তৈরি করা যায়। ভিডিও আর্টের শিল্পীরা তখন মিডিয়ার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। ন্যাম জুন পাইক তখন বলেছিলেন, ‘টেলিভিশন আমাদের সারা জীবনকে গ্রাস করে নিয়েছে, এখন আমরা একে প্রতিহত করতে পারি।’ পাইকের অনবদ্য কাজ ‘বুদ্ধ ওয়াচিং টিভি’ শিল্পকর্মটির মাঝে তার কথার পূর্ণ রূপ ফুটে ওঠে। কাজটিতে আমরা দেখব বুদ্ধের ২৩ বছরের ধ্যানে পরিণত পাথরের মূর্তিটি বাণিজ্যিক টেলিভিশনের আধিপত্যে বুঁদ হয়ে আছে। যেন আধুনিক প্রযুক্তির ভোগবাদী লালসার দৃশ্যরূপের সঙ্গে সমসাময়িক মানুষের সম্পর্কের গভীরতা আধ্যাত্মিকভাবে প্রাচীন মানুষকেও প্রভাবিত করে ফেলেছে। বুদ্ধ যেন নিজেই নিজেকে নির্মাণ করছেন। মূলত পাইক ও তার সমসাময়িকরা বিশ্বাস করেছিলেন যে তারা বিশ্বকে একটি নতুন, বিকল্প সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করার জন্য আধিপত্যবাদী বাণিজ্যিক গণমাধ্যমের সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করবে। যার মধ্য দিয়ে আভঁ-গার্দ ও র‍‍্যাডিক্যালিস্টরা সক্রিয়ভাবে শিল্প ও সমাজে বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হবে। তাই রেইনড্যান্স করপোরেশন দ্বারা প্রকাশিত ‘র‌্যাডিক্যাল সফটওয়্যার’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় বলা হয়, ‘যতক্ষণ না আমরা বিকল্প কাঠামোর ডিজাইন সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করি যা বিদ্যমানগুলোকে পূর্ণভাবে অতিক্রম করে, ততক্ষণ আমাদের বিকল্পধারার প্রক্রিয়া বিদ্যমান প্রক্রিয়ার পণ্যরূপেই থেকে যাবে’।

বস্তুত পৃথিবীতে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের অবক্ষয়ের কালে ভিডিও আর্টের জন্ম হয়েছিল। ভিডিও আর্টের শিল্পী ও কর্মী তথা অ্যাক্টিভিস্টরা বিশ্বাস করতেন যে তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলো স্থানীয় ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে। পাইকের মতো অনেক শিল্পীই তখন দারিদ্র্যের দুঃখ বিলাসের বিপরীতে আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেদের মতপ্রকাশে ভিডিও আর্টের চর্চাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

তথ্যসূত্র:

1. Agains t Immediacy by William Kaizen Publish by Permissions, University Press of New England,

2. Video Art Theory, A Comparative Approach by Wes tgees t Publish by Wiley Blackwell, UK

3.  A His tory of Video Art by Chris Meigh-Andrews, Publish by Bloomsbury Publishing Plc. New York, London.

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন