ইন্টার মায়ামিতে যোগ দিলেন মেসি

পেলের পর আমেরিকান ফুটবলে আরেক মহাতারকা

ক্রীড়া ডেস্ক

লিওনেল আন্দ্রেস মেসি ছবি: এপি

ব্রাজিলীয় ফুটবল গ্রেট পেলে তিন-তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন, গোলের পর গোল করে গড়েছেন অসংখ্য রেকর্ড। এভাবে হয়ে ওঠেন বিশ্ব ফুটবলের আইকন, জীবন্ত কিংবদন্তি। কিন্তু কাজ তখনো শেষ হয়নি। ১৯৭৫ সালের জুনে নামলেন নতুন অভিযানে। নাম লেখালেন নর্থ আমেরিকান সকার লিগে (এনএএসএল) নিউইয়র্ক কসমস ক্লাবে ৪৫ লাখ ডলারে তিন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন। ফুটবলেরকালো মানিক বদলে দিলেন আমেরিকান ফুটবলের মানচিত্রটা। বিপ্লব ঘটল দেশটির ফুটবলে।

গত বছর পেলের মৃত্যুর পর এক বিবৃতিতে কসমস বলেছে: ‘কসমসের হয়ে তিন মৌসুমে ঘরোয়া ফুটবলের মানচিত্রটাই পাল্টে দেন পেলে। যেখানে একটি সময় ছিল বেসবল ডায়মন্ড, সেখানে এখন ফুটবলের মাঠও আছে।

দেশটিতে পেলের পর এবার আরেক মহাতারকার আগমন। এবার উত্তর আমেরিকার ফুটবলে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা হবেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। আর্জেন্টাইন মহাতারকা, ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তিকে দলে ভিড়িয়েছে ইন্টার মায়ামি। 

ইউরোপের তারকা ফুটবলার টানার মিশনে রয়েছে সৌদি আরবের ক্লাবগুলো। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নাম লিখিয়েছেন আল নাসরে, আর সদ্যই করিম বেনজেমাকে চুক্তিবদ্ধ করেছে আল ইত্তিহাদ। দুটিই দুনিয়া কাঁপানো পারিশ্রমিক দিয়ে। তৃতীয় সুপারস্টার হিসেবে লিওনেল মেসিকে দলভুক্ত করার আশায় ছিল আরেক সৌদি ক্লাব আল হিলাল। তাকে বছরে ৪০ কোটি ডলার পারিশ্রমিক দিতে চেয়েছিল সৌদি ক্লাবটি। যদিও সৌদি আরবকে হতাশ করে এবং ফুটবল বিশ্বকে অবাক করে মেসি ঠিকানা গড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। মেজর লিগ সকারের দল ইন্টার মায়ামিতে যোগ দিচ্ছেন তিনি। লাতিন ফুটবল শিল্পীর কারিকুরি এবার সচক্ষে দেখবেন আমেরিকান ফুটবল অনুরাগীরাও।

মেসি মূলত নতুন অভিজ্ঞতা নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চেয়েছেন বলেই মায়ামিতে নাম লেখান। তাকে পেতে একাধিক প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে হয়েছে মেজর লিগ সকারকে। সৌদি আরবের অকল্পনীয় অর্থ প্রস্তাব, বার্সেলোনায় ফেরার হাতছানি আর শৈশবের ক্লাব নিউয়েল ওল্ড বয়েজ ছিল প্রতিপক্ষ। তবে সবাইকে হতাশ করেছেন মেসি। মায়ামিকে বেছে নেয়ার পর মেসি বলেছেন, ‘আমি ইন্টার মায়ামিতে যাচ্ছি। সিদ্ধান্ত ১০০% নিশ্চিত। যদি অর্থের জন্যই হতো, তবে আমি সৌদি আরব কিংবা অন্য কোথাও যেতাম। মনে হতে পারে, আমি অনেক টাকা পাব। সত্যটা হলো, আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি শুধু টাকার জন্যই নয়।

মাত্র ছয় মাস আগেই যে কিনা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছেন দাপটে, সেই খেলোয়াড়টির মেজর লিগ সকারের একেবারে তলানির দলে নাম লেখানোটা ফুটবল বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, প্রশ্ন জাগিয়েছে, সংশয়ও।

প্রশ্ন উঠছে, কী এমন বিষয় মেসিকে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করল? আবার মেজর লিগ সকার কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে তিনি কতটা প্রভাব ফেলতে পারবেন? যে ক্লাবটির হয়ে ৩৫টি শিরোপা জিতেছেন, গোলের রেকর্ড গড়েছেন, সেই বার্সেলোনায় ফিরতে না পেরে তিনি কতটা হতাশ? আর যেসব ভক্ত অনুরাগীরা তাকে ভালোবাসেন, তারা কি মেজর লিগ সকারের ফুটবলেও তাকে অনুসরণ করবেন?

মেসি দুই বছর খেলেছেন প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে (পিএসজি) ফরাসি ক্লাবটির সঙ্গে তার চুক্তির মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়। তাই একজন ফ্রি এজেন্ট হিসেবেই তিনি নতুন ক্লাবে যোগ দিচ্ছেন। এজন্য ট্রান্সফার ফি লাগেনি। যদিও বাস্তবিক অর্থে এটি ফ্রি এজেন্ট সাইনিংয়ের চেয়েও বেশি কিছু। এটি ছিল ইন্টার মায়ামি, মেজর লিগ সকার, লিগের সম্প্রচারস্বত্বাধিকারী অ্যাপল, দলগুলোর কিট স্পন্সর অ্যাডিডাস এবং লিওনেল আন্দ্রেস মেসি করপোরেশনের মধ্যে জয়েন্ট ভেঞ্চার।

২০০৭ সালে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে মেজর লিগ সকারের দল লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যালাক্সিতে নাম লেখান ডেভিড বেকহ্যাম। তখন যে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, এবার মেসি নাম লেখানোয় আরেকবার আমেরিকান ফুটবলে ঢেউ উঠল। এরই মধ্যে মায়ামিসহ দেশটির সংবাদমাধ্যমে বীরের মর্যাদায় স্বাগত জানানো হয়েছে মেসিকে।  

তবে মেসিই প্রথম ফুটবল সুপারস্টার নন, যিনি উত্তর আমেরিকান ফুটবলে পা রাখলেন। ১৯৭৫ সালে দেশটিতে পা রাখেন পেলে। তারপর বেকহ্যাম, ইয়োহান ক্রুইফ, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারসহ আরো অনেক তারকা ইউরোপ লাতিন আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে নাম লিখিয়েছেন। তবে পেলের পর মেসিই সবচেয়ে বড় সুপারস্টার, যিনি উত্তর আমেরিকার ফুটবলে খেলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন।

মেসি সাতবারের বিশ্বসেরা ফুটবলার। হয়তো এবার অষ্টমবার বিশ্বসেরা ফুটবলারের পুরস্কার হাতে নেবেন। এছাড়া তার শোকেসটা নানা পুরস্কারে ঠাসা। ক্লাব দেশের হয়ে আটশরও বেশি গোল তার। বিশ্বকাপ শিরোপা ছিল না বলে তাকে ইতিহাসের সেরা ফুটবলার মানতে রাজি ছিলেন না অনেকে। সেই অপূর্ণতাটুকুও ঘুচিয়েছেন। ছয় মাসও হয়নি বিশ্বসেরার মুকুট পরেছেন মেসি। এবং হয়েছেন কাতার বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়। ৩৫ বছর বয়সেও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এক ফুটবলার। গতি হয়তো কমেছে, স্ট্যামিনা আগের মতো নেই, কারিকুরিও আগের মতো মুগ্ধ করে না সমর্থকদের; তবে ম্যাজিক মাঝেমধ্যেই দেখান।

ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ানে এবার সর্বোচ্চ ১৪টি অ্যাসিস্ট মেসিরই। গোল করেছেন ১৬টি এবং এর একটিও পেনাল্টি থেকে করা নয়। সব মিলিয়ে পঁয়ত্রিশের মেসি এখনো ইউরোপের গতিময়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগে খেলে যেতে পারতেন আরো কয়েকটি মৌসুম। তাই সময় তার মেজর লিগ সকারে নাম লেখানোয় অবাকই হয়েছেন অনেকে।

তিনি সাবেক ক্লাব বার্সেলোনা কিংবা সৌদি আরবের ৪০ কোটি ডলারের হাতছানিকে উপেক্ষা করে উত্তর আমেরিকাকে বেছে নিয়েছেন। উত্তর আমেরিকার ফুটবল সমর্থকরা ভাগ্যবানই। কেননা আপনি যদি মেজর লিগ সকারের কোনো মাচে মেসির খেলার দর্শক হয়ে থাকেন, তবে একদিন বলতে পারবেন, রক্ত-মাংসের মেসিকে দেখেছেন। যেভাবে আপনার বাবা আপনাকে বলেছেন, তিনি মাইকেল জর্ডানকে দেখেছেন কিংবা আপনার দাদা আপনার বাবাকে বলেছেন, তিনি মোহাম্মদ আলীকে দেখেছেন। মেসি সত্যিকার অর্থে, মাপেরই খেলোয়াড়, যার গল্পটা যুগ যুগ ধরে মানুষ করে যাবে।  

মেজর লিগ সকারে এমন দিন কমই এসেছে। লিগটির কর্মকর্তারা এখন কল্পনার সুখরাজ্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন হয়তো। এমনই এক জ্বালানির সন্ধান মিলেছে যে লিগটি এখন রকেটের গতিতে ছুটবে। লিগটিকে জাগাতে এমন জ্বালানির যে বড় প্রয়োজন ছিল।

২০১৮ সালে ইন্টার মায়ামির কর্তৃত্ব পান জর্জ ম্যাস, ডেভিড বেকহ্যাম হোসে ম্যাস। সেই থেকে মেসিকে দলে টানার স্বপ্ন দেখতে থাকেন জর্জ ম্যাস। অবশেষে জর্জ ম্যাসের স্বপ্ন পূরণ হলো।

২০০৭ সালে বেকহ্যাম যখন মেজর লিগ সকারে নাম লেখান তখন উচ্চ পারিশ্রমিকের সঙ্গে একটি শর্তও জুড়ে দিয়েছিলেন ইংলিশ গ্রেট। তিনি লিগে নতুন যুক্ত হওয়া একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানায় থাকবেনএমন শর্ত ছিল। আর ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানায় থাকতে অনেকটাডিসকাউন্ট পাবেন তিনি, পেয়েছেনও। অবশেষে তিনি খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে ইন্টার মায়ামির মালিকানায় যুক্ত হন। গুঞ্জন রয়েছে, মেসিও ইন্টার মায়ামিতে শেয়ার কিনবেন। যদিও তিনি বেকহ্যামের মতোডিসকাউন্ট পাবেন না। 

বেকহাম যখন যোগ দেন তখন মেজর লিগে মাত্র ১৩ দলের লড়াই ছিল। ইংলিশ মহাতারকার আগমন আমেরিকান ফুটবলে বড় প্রভাব ফেলেছে। সেই দল বেড়ে এখন ত্রিশের কাছাকাছি। আগামী মৌসুমে মোট ৩০টি দল মেজর লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এমনকি, বেকহ্যামের পথ অনুসরণ করে ফরাসি গ্রেট থিয়েরি অঁরি, ব্রাজিলীয় সুপারস্টার কাকা নাম লেখান মেজর লিগে। মেসি আরো বড় তারকা, সক্রিয় ফুটবলারদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বড় সফলতম। তার আগমনে মেজর লিগ সকারে আরেকটি বড় ঝড় উঠবে।

মেজর লিগ সকারের টেলিভিশন চুক্তিটা এখন অ্যাপল টিভির। ২০২৬ বিশ্বকাপ সামনে রেখে মেজর লিগ যখন বাড়তি আলো পাবে, তখন মেসির মতো সুপারস্টারের আগমন এটিকে বহুগুণ গতি দেবে। এদিক ভেবেই অ্যাপল অ্যাডিডাসের মতো কোম্পানি অর্থ ঢেলে মেসিকে ইন্টার মায়ামিতে নিতে সাহায্য করেছে।

মেসি যে ক্লাবটিতে যোগ দিচ্ছেন সেটি এবার ১৩ দলের লিগে ১৩তম হয়েছে। প্রতি ৯০ মিনিটে তাদের গোল গড় শূন্য দশমিক ৮২ (.৮২), যা লিগের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটিকে টেনে তোলার দায় এখন তারই কাঁধে। যদি তার সাবেক বার্সা সতীর্থ সার্জিও বুসকেটস যোগ দেন, তবে কাজটা সহজ হবে মেসির।

যুক্তরাষ্ট্রের মিলিয়ন মিলিয়ন শিশু মেসির জার্সি পরে থাকে। তারা বেসবল সুপারস্টার প্যাট্রিক মাহোমেস কিংবা এনবিএ সুপারস্টার স্টিফেন কারির চেয়েও মেসিকে বেশি চেনে। এটা কাকতালীয় নয়। উত্তর আমেরিকায় ফুটবলটা ক্রমেই বড় হচ্ছে, জনপ্রিয় হচ্ছে। মেসি এমন এক লিগে নাম লিখিয়েছেন, যার বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে। সেখানে অ্যাপল কিংবা অ্যাডিডাসের বড় বাজার। আবার এমন শহরে মেসির আগমন যেখানে তাকে ইংরেজি শেখার তাড়াও দেবে না কেউ। কেননা সেখানে হাজার হাজার লাতিন আমেরিকানের বাস, আর মিশ্র এক সংস্কৃতি বহমান। এমন এক দেশে পা রাখছেন, যেটি ২০২৬ বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক। মেসির সিদ্ধান্তের নেপথ্যেও কি ২০২৬ বিশ্বকাপ?

ঠিক কারণেই মেসির সিদ্ধান্ত আমেরিকান ফুটবলের জন্য বিরাট ঘটনা। সেখানে এরই মধ্যে উঠতি বয়সী ফুটবল সমর্থক বাড়ছে, যাদের বড় একটি অংশের আইডল মেসি। এখন স্বপ্নের সেই নায়ককে সরাসরি নিজেদের লিগে দেখতে পাবেন তারা। যারা ফুটবল খেলতে চায়, এটিকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে চায়, তারা এখন সুন্দরতম খেলাটির প্রতি আরো ভালোবাসা অনুভব করার উপলক্ষ খুঁজে পাবে নিশ্চয়ই।

মেসির পরিকল্পনার কথা অজানা। তবে ২০২৬ বিশ্বকাপ ঘিরে পরিকল্পনা আছে আর্জেন্টিনারও। তারা মায়ামিতে দলের ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজ বানাতে চায়, আর শহরটিকে বানাতে চায় আর্জেন্টিনার ফুটবল হাব হিসেবে তৈরি করতে।

মায়ামিতে একটি বাড়ি রয়েছে মেসির, যা তিনি ভাড়া দিয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো নিজের পরিবার নিয়েই নিজের বাড়িতে থাকবেন আর্জেন্টাইন ফুটবল সুপারস্টার।

১৫ জুন বেইজিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলবে আর্জেন্টিনা। এর চারদিন পর জাকার্তায় আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ইন্দোনেশিয়া। জুলাইয়ে তিনি যোগ দেবেন নতুন ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে।   

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন