রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেয়া হবে কি না সে ব্যাপারে আদেশ আসবে ২৩ জানুয়ারি। আদেশের জন্য আদালত এ তারিখ নির্ধারণ করেছে বলে সোমবার এক টুইটে জানিয়েছে গাম্বিয়ার বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে আইসিজের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করা হয়নি। খবর রয়টার্স ও আল জাজিরা।
২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বসতিতে সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে মিয়ানমারকে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতের মুখোমুখি করেছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর মামলার শুনানি হয়। তাতে গাম্বিয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির বিচারমন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। অন্যদিকে মিয়ানমারের নেতৃত্ব দেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি।
আবুবকর তামবাদু শুনানিতে নৃশংসতার জন্য দায়ী সেনা সদস্যদের বিচার ও সহিংসতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর ‘আস্থা রাখা যায় না’ মন্তব্য করে মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা চান গাম্বিয়ার প্রধান কৌঁসুলী পল রিখলার। অন্যদিকে গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে সু চি দাবি করেন, রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে গাম্বিয়া যে চিত্র আদালতে উপস্থাপন করেছে তা ‘অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর’। গণহত্যার মামলা খারিজ করার আবেদন জানান তিনি।
দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনার পর আইসিজের ১৭ সদস্যের বিচারক প্যানেল বিষয়টি আদেশের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। আইসিজের বিচারক প্যানেলের প্রধান আবদুলকাভি আহমেদ ইউসুফ গত ১৩ ডিসেম্বর বলেন, যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত দেবেন তারা।
অন্তর্ববর্তীকালীন আদেশে যা চেয়েছে গাম্বিয়া:
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিচারবিহর্ভুত হত্যা অথবা শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ অথবা অন্যান্য যৌন সহিংসতা, বাড়িঘর বা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, ভূমি ও সম্পদ নষ্ট, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকে বঞ্চিত রাখা বা এমন কোনো ধরনের উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বা এর অংশ বিশেষ শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারশর্ত তৈরি হয় বা ভূমিকা রাখে- এমন কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে মিয়ানমারকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মিয়ানমারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, সামরিক, আধা সামরিক অথবা সশস্ত্র অনিয়মিত বাহিনীকে সরসারি নির্দেশনা বা সমর্থনের মাধ্যমে; পাশাপাশি কোনো সংগঠন এবং গোষ্ঠী যা সরকারের নিয়ন্ত্রিত বা নির্দেশিত বা প্রভাবিত যাই হোক না কেন কোনো ক্রমেই যেন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটন, ষড়যন্ত্র, সাধারণ মানুষকে এ কাজে নির্দেশনা বা উসকানি বা সহযোগিতা যেমন: বিচারবিহর্ভুত হত্যা অথবা শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ অথবা অন্যান্য যৌন সহিংসতা, বাড়িঘর বা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, ভূমি ও সম্পদ নষ্ট, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকে বঞ্চিত রাখা ও অংশগ্রহণ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে না পারে।
আবেদনে উল্লেখিত অপরাধের কোনো দুষ্প্রাপ্য বা দুর্গম তথ্য প্রমাণ মিয়ানমার যেন নষ্ট বা পরিবর্তন বা বিকৃত না করে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোনো সদস্য যে সম্ভাব্য গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের শিকার তার নির্দশন কোনোভাবেই পরিবর্তন বা স্থানান্তর করা যাবে না। এটি নিশ্চিত করতে হবে।
মিয়ানমার এবং গাম্বিয়া এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না এবং এটি নিশ্চিত করবে যাতে বিদ্যমান পরিস্থিতি ও বিতর্ক আরো জোরালো হয় বা উসকানিমূলক মনে হয়। যাতে পরিস্থিতি জটিলতর রূপ ধারণ করে।
অন্তর্বর্তী আদেশে উল্লেখিত নির্দেশ বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে মিয়ানমার ও গাম্বিয়া পৃথকভাবে আদালতকে অবহিত করবে। নির্দেশ ঘোষণার চার মাসের মধ্যে এ প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে রেহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি নির্মূল করাই ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে সেনা অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল- পরের বছর জাতিসংঘের স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে এমন পর্যবেক্ষই উঠে আসে। সেনাবাহিনীর ওই সাঁড়াশি অভিযানে অন্তত ১০ হাজার মানুষ নিহত হয় বলে তদন্তকারীদের ধারণা। আর প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর অভিযানে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে তার মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতি বিবেচনা করলে সেখানে ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ সুস্পষ্ট।
আর অং সান সু চির বেসামরিক সরকার ‘বিদ্বেষমূলক প্রচারকে উসকে’ দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ ‘আলামত ধ্বংস’ করেছে এবং সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে ‘ব্যর্থ হয়েছে’। এর মধ্যে দিয়ে মিয়ানমার সরকারও নৃশংসতায় ‘ভূমিকা’ রেখেছে। প্রতিবেদনে এমনটিই উল্লেখ করা হয়েছে।