স্কুল খোলার প্রথম দিনে অসুস্থ শিক্ষক-শিক্ষার্থী

‘হিট স্ট্রোকে’ ২৪ ঘণ্টায় ৩ শিক্ষকের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছাতা ও ফ্যান হাতে মা-মেয়ের স্কুলযাত্রা। গতকাল পুরান ঢাকা থেকে তোলা ছবি: সালাহউদ্দীন রাজু

দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে। এক সপ্তাহ ছুটি শেষে গতকাল চালু হয় প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাপপ্রবাহের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়েছে। হিট স্ট্রোকে ২৪ ঘণ্টায় তিন শিক্ষকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

অভিভাবকরা জানান, তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে তারা টিকতে পারছেন না। এর মধ্যে শিশুদের স্কুলে পাঠানো অনেক কষ্টের। এত গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরো কিছু দিন বন্ধ থাকলে ভালো হতো। নিজেরা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে বের হচ্ছেন না। কিন্তু শিশুদের নিয়ে স্কুলে যেতেই হচ্ছে। সকাল থেকে ক্লাস করে দুপুরে সূর্যের প্রখর রোদ ও তাপের মধ্যে বাড়িতে ফেরা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফরিদপুরের সালথায় তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে টিউবওয়েলের পানি খেয়ে তিন শিক্ষক ও ১০ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থদের মধ্যে এক শিশুসহ তিন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের রামকান্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ও হাতিয়া উপজেলার দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৪ শিক্ষার্থী ও একজন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েন। গতকাল সকালে বেগমগঞ্জের জয়নারায়ণপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও হাতিয়া জনকল্যাণ শিক্ষা ট্রাস্ট হাই স্কুলে এ ঘটনা ঘটে।

এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় তিন শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, হিট স্ট্রোকে তাদের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া তিন শিক্ষকের মধ্যে রয়েছেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক, একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এর মধ্যে দুজন গতকাল সকালে মারা গেছেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট ফেরিতে মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা মো. মোস্তাক আহমেদ কুতুবী (৫৫) মারা যান। তিনি বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচর আজিজিয়া মাবুদিয়া আলিম মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন। এদিন সকালে মাদ্রাসা খোলা থাকায় তিনি নগরের চান্দগাঁও মোহরা এলাকার বাসা থেকে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হন। অন্যদিকে সকালে যশোরে স্কুলে আসার পর আহসান হাবীব নামে এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়। গতকাল সকাল ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আহসান হাবীব যশোর সদর উপজেলার আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তিনি গতকাল সকালে মাঠে কৃষিকাজ করে ৯টার দিকে বিদ্যালয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থ হয়ে মারা যান। স্বজনদের ধারণা, ওই শিক্ষক হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন। এছাড়া মানিকগঞ্জে শনিবার দুপুরে হিট স্ট্রোকে হাছিনা পারভীন (৪২) নামে এক শিক্ষিকার মৃত্যু হয়েছে। তিনি সদর উপজেলার বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

নুরে আলম নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘‌আমরা তীব্র তাপপ্রবাহের মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি সম্প্রতি। গত বছরও আমরা একই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছি। এ বছর তা আরো বেড়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আমাদের জাতীয় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল। জাতীয়ভাবে আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই, নির্দেশনাও নেই।’

আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থীরা জানায়, গরমের মধ্যে স্কুল খোলা ঠিক হয়নি। তাদের অনেক অসুবিধা হয়। অনেক শিক্ষার্থী একসঙ্গে বসলে গরম বেশি লাগে। প্রচুর এনার্জি খরচ হয়। আরো কয়দিন ছুটি দিলে তাদের জন্য ভালো হতো।

তবে ভিন্নমত প্রকাশ করে ভিকারুন্নিসা নূন স্কুলের এক ছাত্রী বলে, ‘‌বাসায় বসে না থেকে স্কুলে আসতে চাই। স্কুলে আমাদের বন্ধুরা আছে। আমরা গল্প করতে পারি, পড়তে পারি। কিন্তু বাসায় একা একা বসে থাকতে মন সায় দেয় না। বাসা আমাদের বিরক্তিকর জায়গা হয়ে উঠেছে। বাসার চেয়ে স্কুল অনেক ভালো।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‌ছোট শিশুদের জন্য স্কুল খোলা উচিত হয়নি। তারা তো ছোট মানুষ। স্কুলে গেলে লাফালাফি করবে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক কম, যা তাদের জন্য ঝুঁকি হয়ে পড়বে। স্কুলের আশপাশের দোকান থেকে ঠাণ্ডা পানীয় কিনে যাতে না খায়, সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। এসব কারণে শিশুরা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েডের মতো ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’

তিনি জানান, সকালে স্কুলে কিছুটা ঝুঁকি কম, কিন্তু যে হারে তাপ পড়ছে কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যায়। অনেক স্কুলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফ্যান নেই, অনেক শিক্ষার্থী একসঙ্গে বসলে তাপ অনেক বেশি অনুভূত হয়। আগামী কয়েক দিন চাইলে স্কুল বন্ধ রাখা যেত।

ঢাকাসহ ৫ জেলার মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ ১ দিনের বন্ধ ঘোষণা

দেশের পাঁচটি জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা ছাড়া বাকি জেলাগুলো হলো চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী। গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এসব এলাকার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ চাইলে খোলা রাখতে পারবে। জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান তুহিন বলেন, ‘‌প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেই। যেহেতু প্রাথমিকের সব ক্লাস মর্নিংয়ে হবে, তাই প্রাথমিক খোলাই থাকবে।’

এর আগে গতকাল দুপুরে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘‌ কোনো নির্দিষ্ট এলাকার তাপমাত্রার জন্য সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিপক্ষে আমি। তবে কোনো জেলায় যদি তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে যায়, সেখানে বিদ্যালয় নিজস্ব পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা আঞ্চলিক পর্যায়ে আলোচনা করে সে জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে পারেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন