সরকারি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ

শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের সংযোগ ঘাটতিতে কমছে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

পোশাক শিল্পে আশানুরূপ কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়ায় নতুন শিক্ষার্থীদের মধ্যে টেক্সটাইল শিক্ষায় আগ্রহ কমছে ছবি: সংগৃহীত

দেশে যেসব খাতে সবচেয়ে বেশি জনবলের চাহিদা তার মধ্যে বস্ত্র অন্যতম। তবে দক্ষ জনবল না থাকায় পোশাক কারখানাগুলোকে নির্ভর করতে হয় বিদেশীদের ওপর। বর্তমানে দেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতেই সবচেয়ে বেশি বিদেশী কর্মী কাজ করছেন। সে সংকট থেকে উত্তরণে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নির্মাণ করেছে সরকার। 

জানা গেছে, মোট নয়টি সরকারি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান। নির্মাণাধীন রয়েছে আরো দুটি। এছাড়া তিনটি টেক্সটাইল কলেজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে চলছে সমীক্ষা। তবে বিশেষায়িত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেও সেগুলোয় ভর্তি হতে আবেদনকারীর হার আগের থেকে কমছে। মূলত প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের সংযোগ ঘাটতির কারণেই শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। 

সরকারি টেক্সটাইল কলেজগুলোর মধ্যে কেবল বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা বিএসসি কোর্সে ভর্তি হতে পারেন। বাকি আটটি কলেজ প্রতি বছর সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে শিক্ষার্থী নেয়। এসব কলেজের দায়িত্বে আছে বস্ত্র অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে কলেজগুলোর ৯৬০টি আসনের বিপরীতে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ৪ হাজার ৬৬৬ জন, যা গত তিন শিক্ষাবর্ষের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগের শিক্ষাবর্ষে একইসংখ্যক আসনে ভর্তি হতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ৯ হাজার ২ শিক্ষার্থী। সে হিসাবে চলতি শিক্ষাবর্ষে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী কমেছে ৪৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। 

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জানান, অবকাঠামোগত ভিত তৈরি হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক সংকট প্রকট। পাশাপাশি পোশাক শিল্পে আশানুরূপ কর্মসংস্থানের সুযোগ না পাওয়ায় নতুনদের মধ্যে টেক্সটাইল শিক্ষায় আগ্রহ কমছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দুটি ব্যতীত সরকারি প্রতিটি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই অর্ধেকের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য। সবচেয়ে বেশি সংকট তুলনামূলক নতুন কলেজগুলোয়। এর মধ্যে শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৩৮টি পদের বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন কেবল চারজন, শেখ রেহানা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৩৬টির বিপরীতে আট, শেখ কামাল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৩৪টির বিপরীতে নয় এবং এমএ ওয়াজেদ আলী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৩৬টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন আট শিক্ষক। এছাড়া নোয়াখালী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৩৩টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১৬ শিক্ষক। যদিও তাদের মধ্যে আটজন আবার দেশের বিভিন্ন টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে ডেপুটেশনে রয়েছেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে কর্মসংস্থান। কিন্তু দেশে একটি বড় সমস্যা হলো শিক্ষার সঙ্গে কর্মবাজারের সম্পৃক্ততা কম। পোশাক খাতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে এবং এখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশী কর্মরত। অথচ যারা টেক্সটাইল নিয়ে পড়ছেন তাদের অনেককেও দেখা যায় চাকরি পাচ্ছেন না। এর কারণ তারা ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি। তারা যখন চাকরি পাচ্ছেন না তখন অন্যরাও তাদের দেখে টেক্সটাইল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন। শুরুর দিকে যে ধারণাটা ছিল—টেক্সটাইল নিয়ে পড়লে বেকার থাকতে হবে না, সে ধারণাটি এখন আর নেই।

টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর একাডেমিক বিষয় দেখভাল করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)। জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহ আলিমুজ্জামান বেলাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। আমাদের কারিকুলাম এখন বেশ আধুনিক এবং আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের বর্তমান কর্মবাজারের উপযোগী করে গড়ে তোলার। বিশেষত ইন্টার্নশিপে যাতে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতই কাজ শেখে, দায়সারাভাবে না হয়, সে বিষয়ে জোর দেয়া হচ্ছে। কারণ এটি এমন একটি সেক্টর যেখানে অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো শিক্ষার্থী যদি শুরু থেকে কাজের বিষয়ে মনোযোগী হয় তাহলে এ সেক্টরে তার পক্ষে দ্রুতই উন্নতি করা সম্ভব।’

শিল্পের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংযোগের ঘাটতির বিষয়টি উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনেও। ২০২২ সালে প্রকাশিত ‘ব্রিফ অ্যানালাইসিস অন দ্য পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার অব টেক্সটাইল এডুকেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে টেক্সটাইল শিক্ষার দুর্বলতা হিসেবে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক, কারিকুলামে ইন্ডাস্ট্রি ওরিয়েন্টেড বিষয় এবং প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাব। এছাড়া এ গবেষণাপত্রে টেক্সটাইল শিক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সদ্য স্নাতক শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত পদে নিয়োগ না দেয়া এবং বেতনস্বল্পতার বিষয়টিকে।

দেশের একটি বায়িং হাউজে কর্মরত মো. ফেরদৌস আলীম। বেশির ভাগ দিনই তাকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। বাকি দিনগুলোয়ও ন্যূনতম ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানই নয়, এ সেক্টরের সব প্রতিষ্ঠানেই কাজের এমন চাপ। এছাড়া পুরো পৃথিবী ক্রমেই ডিজিটালাইজড হলেও আমাদের দেশের পোশাক কারখানায় ম্যানুয়াল কাজই বেশি হয়। এতে লোক বেশি লাগে। তখন প্রতিষ্ঠানগুলো চেষ্টা করে কম বেতনে বেশি লোক রাখার। এখন যেহেতু গ্র্যাজুয়েট সংখ্যা অনেক, তাই কম বেতনে কর্মী পেয়েও যায় তারা। এ কারণে সেক্টরটিতে প্রত্যাশা অনুযায়ী বেতন পাওয়া যায় না। এসব কারণেই আগের তুলনায় টেক্সটাইলে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে।’

চাহিদা অনুযায়ী বেতন না পাওয়ার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে আশানুরূপ পরিবেশ বা মূল্যায়িত না হওয়ায় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার পাস অনেক শিক্ষার্থী চাকরিতে যোগদান করেও পরে ছেড়ে দিচ্ছেন। তাদেরই একজন রবিউল ইসলাম। ২০১৯ সালে স্নাতক শেষ করার পর পরই তিনি একটি পোশাক কারখানায় যোগদান করেছিলেন। তবে অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং সে অনুযায়ী বেতন না পাওয়ায় মাত্র ছয় মাস পরই চাকরি ছেড়ে দেন। বর্তমানে দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 

রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশে পোশাক খাতে বিপুল কর্মসংস্থানের বিষয়টি চিন্তা করেই এ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ভর্তির পর থেকেই কলেজে শিক্ষক ও ল্যাব সংকটসহ বিভিন্ন সংকট দেখেছি। এরপর স্নাতক শেষে দেখলাম যোগ্যতা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরির সুযোগ কম। যেসব পোশাক কারখানায় আমি চাকরি পেয়েছিলাম তার প্রায় সবগুলোয় বেতন অত্যন্ত কম ছিল। অথচ দেখা যেত তারা একই শিক্ষাগত যোগ্যতার একজন বিদেশীকে অনেক বেশি বেতন দিত। এছাড়া আরেকটি বিষয় ছিল এখানে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো, যা অন্যান্য পেশায় নেই। সব মিলিয়ে এ সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। এমনকি এখন যখন কেউ আমার কাছে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার বিষয়ে পরামর্শ চায় তখন তাদের সুযোগ থাকলে অন্য বিষয়ে পড়ার পরামর্শ দিই।’

তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৈরি পোশাক খাতে উৎপাদন পর্যায়ে তুলনামূলক দক্ষতার ঘাটতি কম। কিন্তু ব্যবস্থাপক পর্যায়ে ঘাটতিটা অনেক বেশি। পোশাক কারখানা মালিকরা যে ধরনের কর্মী চান, সে ধরনের লোক পাওয়া যায় না। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের পোশাক শিল্প বর্তমানে অনেক এগিয়েছে, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলাম সে অনুযায়ী এগোয়নি। চাকরির জন্য আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী তাদের জ্ঞানের পরিধি খুবই কম। ফলে অনেক সময় জনবল সংকট সত্ত্বেও দক্ষতার ঘাটতির জন্য তাদের নেয়া সম্ভব হয় না। এতে চাকরিপ্রার্থীরাও যেমন হতাশায় ভোগেন তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলোও দক্ষ জনবল সংকটে ভোগে। আরেকটি বিষয়, শিক্ষার্থীরা যদি চাকরির ক্ষেত্রে আশানুরূপ সফলতা না পায় তাহলে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহও কমে যায়।’

ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বস্ত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো, নুরুজ্জামানও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদার সঙ্গে কারিকুলামের পার্থক্যের বিষয়টি আমরা কমানোর চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে গার্মেন্টস মালিকদের সঙ্গে একাধিক সভা করা হয়েছে এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রমে পরিবর্তন করা হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষক সংকট নিরসনেও কাজ করছি। কলেজগুলোয় শিক্ষক নিয়োগ হয় পিএসসির মাধ্যমে। পিএসসির কাছে এরই মধ্যে আমরা প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষকের চাহিদা দিয়ে রেখেছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন