শিশুদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস বেশি হয়

ডা: বিশ্বজিত ভৌমিক

ডা: বিশ্বজিত ভৌমিক, ছবি: স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি

ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত সমস্যা, যেখানে রক্তের গ্লুকোজ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায়। বংশগত বা পারিপার্শ্বিক কারণে ইনসুলিন নামক হরমোনের নিঃসরণ কমে গেলে বা ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে গেলে বা এ দুইয়ের মিলিত প্রভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। 

ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের। টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস। জেনেটিক পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিকভাবে টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস আলাদা করা হয়ে থাকে। এটা অনেক ব্যয়বহুল। 

সাধারণত কম বয়সীদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। এরা সাধারণত ক্ষীণকায় হয়ে থাকে। এদের শরীরে ইনসুলিন নিঃসরণ একদম হয় না। অটোইমিউন, বিশেষ কিছু ভাইরাস ও পরিবেশগত কারণ এটাকে ত্বরান্বিত করে থাকে। হঠাৎ করে শনাক্ত হয়ে থাকে। শনাক্তের সময় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সাধারণত অনেক বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া সাধারণত প্রস্রাবে কিটোন পাওয়া যায়। যেহেতু এদের শরীরে ইনসুলিন নিঃসরণ একদম হয় না তাই সারা জীবন ইনসুলিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করাতে হয়।

রোগের লক্ষণগুলো হলো বেশি বেশি প্রস্রাব হওয়া, বেশি বেশি পিপাসা পাওয়া, বেশি বেশি ক্ষুধা লাগা, ওজন কমে যাওয়া ও দুর্বল হয়ে যাওয়া। উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে সকালে খালি পেটে রক্ত পরীক্ষা অথবা ওজিটিটি পরীক্ষার মাধ্যমে গ্লুকোজের মাত্রা শনাক্ত করা হয়ে থাকে।

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মতো এদের মধ্যেও কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া, হৃদরোগ, স্ট্রোক বা পক্ষাঘাত, অন্ধত্ব এবং পায়ে পচনশীল ক্ষতের হার বেশি হয়ে থাকে। 

জীবনযাপনে শৃঙ্খলা ও পরিবর্তনের মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বহুলাংশে প্রতিরোধ করা গেলেও শরীরে ইনসুলিন নিঃসরণ একদম হয় না বলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস এখন পর্যন্ত প্রতিরোধ করা যায় না। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টাইপ-১ ডায়াবেটিস কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। 

ইউরোপ বিশেষ করে নর্ডিক দেশগুলো, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোয় টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার তুলনামূলক অনেক বেশি। 

বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে আট হাজার শিশু শুধু টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতি বারডেমের পেডিয়াট্রিক ডায়াবেটিস কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের পাশাপাশি সাতটি জেলা শহরে টাইপ-১ ডায়াবেটিস কর্নার চালু করেছে। লাইফ অব চিলড্রেনস ও সিডিআইসি প্রোগ্রামের মাধ্যমে সব টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সিরিঞ্জসহ বিনামূল্যে ইনসুলিন, অ্যানালগ ইনসুলিনসহ স্ট্রিপসহ গ্লুকোমিটার, রক্তের গ্লুকোজ, ঐনঅ১প, মাইক্রো অ্যালবুমিনের জন্য প্রস্রাব, লিপিড প্রোফাইল এবং নেফ্রোপ্যাথি ও রেটিনোপ্যাথিসহ ডায়াবেটিস জটিলতার স্ক্রিনিং করা হয়ে থাকে। 

সরকারও বেশকিছু সেন্টার তৈরির কাজ করছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ টাইপ-১ ক্লিনিক চালু করছে।

মুজিব বর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সব টাইপ-১ শিশুদের বিনামূল্যে ইনসুলিন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির মাধ্যমে বিনামূল্যে ইনসুলিন দেয়া শুরু করেছে।

বাংলাদেশে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আক্রান্তের হার ও এর প্রকৃত কারণ খুঁজে দেখার উদ্দেশ্যে ২০২১ সালে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থায়নে সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি তিন মাসব্যাপী একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। দেশের আট বিভাগের ১০ জেলায় একটি করে শহর ও একটি করে গ্রামে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষাটি করা হয়েছে। 

সেখানে ১৫-১৯ বছরের মধ্যে ১০০ জনের মধ্যে চারজন টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ওজন বাড়া, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হওয়া, শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া, ঘুম কমে যাওয়া টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে বের হয়ে এসেছে। 

টাইপ-১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনো পর্যন্ত কোনো সঠিক পন্থা বের করতে পারেনি। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত চিকিৎসার ভেতরে নিয়ে আসতে হবে এবং সময়মতো ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। তা অবশ্যই স্পেশালাইজ সেন্টারের অধীনে হতে হবে।

সরকারের পরিকল্পনার মধ্যে প্রান্তিক পর্যায়ে শিশুদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস শনাক্তের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি দেশব্যাপী টাইপ-১ ডায়াবেটিস শনাক্ত ও করণীয় নিয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। টাইপ-১-এর সংখ্যা এখনো কম, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এখন অ্যালার্মিং পর্যায়ে চলে গেছে। ওজন কমানো, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা, জাঙ্কফুড, সফট ড্রিংকস, মিষ্টিজাতীয় খাবার, যেসব খাবার ওজন বাড়ায় সেগুলো পরিহার করতে হবে। সাধ্যমতো কায়িক পরিশ্রম বাড়াতে হবে, বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় প্রমাণিত যে প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট দ্রুতভাবে হাঁটলে ৪০-৫০ ভাগ ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়া শিশু-কিশোরদের দৈনিক পর্যাপ্ত সময় ঘুমাতে হবে।

লেখক: প্রকল্প পরিচালক, সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন